বাংলা

‘জাগতেন পা মিগ সেলভ’ প্রামাণ্যচিত্রে উন্নত দেশগুলোর সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় উন্মোচিত

CMGPublished: 2022-04-07 14:20:57
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

একদিন উয়েননিক শরীর চেক করার জন্য হাসপাতালে যান। নার্স তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি মাদকাসক্ত? নার্স আরও বলেন যে, তার সব অসুস্থতা ইন্সটিটিউট অফ সাইকোলজিতে রিপোর্ট করতে হবে। কারণ তার মেডিকেল রেকর্ড বইয়ে একটি গোলাপি নোট ছিল। এ কথা শুনে উয়েননিক অবাক হন। তারপর তিনি ইন্সটিটিউট অফ সাইকোলজিতে যান এবং সেখানে নিজের মেডিকেল রেকর্ড বই দেখার সুযোগ পান।

তখনই তিনি মনে করতে পারেন যে, তিনি ছোটবেলায় মানবিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুসারে, তিনি দুটি মূল তথ্য খুঁজে পান। একটি হলো যে ডাক্তার পরীক্ষার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি মনোরোগবিদ্যার ক্ষেত্রের একজন বিরাট অধ্যাপক হয়েছিলেন। তার পিএইচডি থিসিস ছিল ডেনিশ শিশুদের মানবিক পরীক্ষা প্রসঙ্গে। উদ্দেশ্য হলো- ‘সাইকোসিস প্রতিরোধের’ সম্ভাবনা অন্বেষণ করা।

দ্বিতীয়ত, পরীক্ষাটি চালাতে সিআইএ’এর উদ্যোগে (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি) অর্থায়ন করা হয়েছিল। যেহেতু মার্কিন আইনে শিশুদের উপর মানুষের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে কঠোর বাধা রয়েছে; তাই তারা গোপনে পরীক্ষা চালানোর জন্য ডেনমার্কে আসে। পরীক্ষার আসল উদ্দেশ্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিশুদের এবং তাদের অভিভাবকদের জানানো হয়নি।

তদন্ত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উয়েননিক আরও জঘন্য তথ্য উন্মোচন করেন। কিছু পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য তার শিক্ষকদেরও নিয়োগ করা হয়েছিল। ১১ বছর বয়স পর্যন্ত তার শিক্ষক উয়েননিকের ফাইল আপডেট করেছেন। তার ক্ষমতা, ব্যক্তিত্ব, দৈনন্দিন কর্মক্ষমতা তত্ত্বাবধান করা হয়েছে এবং কিছু নোটও রাখা হয়েছে।

অনাথ আশ্রমে শিশুদের অকথ্য নির্যাতনকে নিয়ম হিসাবে গণ্য করা হতো। উয়েননিকে প্রায়শই লকার রুমে আটকে রাখা হতো এবং তার শিক্ষক তাকে হ্যাঙ্গার বা চাবির চেইন দিয়ে মারতেন। কিন্তু, তিনি এতটাই অন্তর্মুখী ছিলেন বলে অন্য কাউকে বলেননি। এই তদন্তের সময় তিনি অন্য লোকেদের অভিযোগপত্র আবিষ্কার করার পর বুঝতে পারেন যে, তিনিই একমাত্র শিকার নন। এ ছাড়া, অনাথ আশ্রমে প্রায়শই হয়রানির ঘটনা ঘটত। বড় ছেলেরা ছোট ছেলেদের টয়লেটে নিয়ে যৌন নিপীড়ন করত। কিন্তু সবাই তা দেখেও এড়িয়ে যেতো।

উয়েননিকের কাছে সবচে অগ্রহণযোগ্য একটি বিষয় ছিল।তা হলো কয়েক বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিত্সকরা দেখেন যে, তার মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। তার শরীরের দাগ থেকে প্রমাণিত হয় যে, তিনি সহিংসতা, এমনকি যৌন নিপীড়নে শিকার ছিলেন। কিন্তু চিকিত্সকরা পুলিশকে ডাকেননি বা হস্তক্ষেপ করেননি। এমনকি এতিমখানার শিক্ষকদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতাও শুরু করেন। এটা অন্যায়কারীদের সাহায্য করার শামিল।

এই পরীক্ষা আসলে শেষ হয়নি। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত তার মানসিক অবস্থা ক্রমাগত ট্র্যাক করা হয়েছিল। একবার তিনি হাসপাতালে ভর্তি হলে তার শারীরিক অবস্থা সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন সিঙ্ক্রোনাসভাবে আপলোড করা হবে। ডাক্তার তাকে কখনোই আবেগপ্রবণ ব্যক্তি হিসেবে দেখেননি, শুধুই একটি ঠান্ডা পরীক্ষা। কিন্তু যখন তিনি প্রাসঙ্গিক কর্মীদের প্রশ্ন করেছিলেন, তখন তিনি একটি অসহায় উত্তর পেয়েছিলেন: ‘আমার বলার সাহস নেই।’

যারা এ ব্যাপারটি জানেন তারা কেন চুপচাপ থাকেন? মানবিকতা লঙ্ঘনমূলক এসব পরীক্ষার পেছনের রহস্য কী? উত্তর স্পন্সরের সঙ্গে জড়িত। উয়েননিক যে সিজোফ্রেনিয়া পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন তা আসলে গত শতাব্দীর ৫০ ও ৭০-এর দশকে সিআইএ-র উদ্যোগে পরিচালিত ‘মন নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির’ একটি অংশ ছিল। এর উদ্দেশ্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের ‘ব্রেনওয়াশ’ করা। এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে বিশেষ করে জার্মান নাৎসি ডাক্তার এবং জাপানি-৭৩১ যুদ্ধাপরাধীকেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

স্টিফেন কিনজে নামে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রাক্তন সংবাদদাতা ‘চিফ পয়জন মাস্টার’-এ বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেছেন। একজন ব্যক্তির মনকে ধ্বংস করার উপায় খুঁজে বের করার জন্য সিআইএ সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরীক্ষা চালিয়ে বৈদ্যুতিক শক এবং শক্তিশালী হ্যালুসিনোজেন ব্যবহারের পথ বেছে নেয়। ‘ওয়ান ফ্লু ওভার দ্য কোকিওস নেস্ট’ নামে চলচ্চিত্রের একই নামের উপন্যাসের লেখকও এই পরিকল্পনার শিকার হয়েছিলেন। ১৯৫৯ সালে, তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শক্তিশালী হ্যালুসিনোজেন নিয়ে পরীক্ষায় অংশ নেন এবং এই বাস্তব অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে এমন একটি দৃশ্যবিন্যাস তৈরি করেন, যা পরে বড় পর্দায় আনা হয়েছিল।

চলচ্চিত্রের প্রধান নায়ক, যিনি একসময় প্রাণশক্তিতে পূর্ণ ছিলেন, তাকে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে চিকিত্সা করা হয়েছিল। তার মস্তিষ্কের সামনের লোবগুলো সরানো হয়েছিল এবং অবশেষে তিনি হাঁটাহাঁটি করা মৃত মানুষ হয়ে ওঠেন।

উয়েননিক এবং স্টিফেন কিনজে ছাড়াও, আরো অনেক শিকারকারী তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছে। কানাডার বিষণ্ণতায় আক্রান্ত জিনাকে ১৯৬০ সালে সিআইএ’র অর্থায়নে গড়ে তোলা মানসিক হাসপাতালের উদ্যোগে পরীক্ষার বস্তু বানানো হয়। ফলে তার অসুস্থতা আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠে।

অন্য একজনের অবস্থা আরো দুঃখজনক। মাত্র ১৯ বছর বয়সী মানুষটিকে এক মাসে ৯বার বৈদ্যুতিক শক এবং ২৮টি হিপনোথেরাপি দেওয়া হয়। অবশেষে তার মস্তিষ্কের ভীষণ ক্ষতি হয়, চলাচল ও কথা বলার যোগ্যতা সম্পূর্ণ লোপ পায়।

আসলে যারা এমন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অংশ নেন, তাদের মধ্যে অনেকে আজীবনের জন্য রোগী হয়ে ওঠে। আরও গুরুতর বিষয় হলো, কারও মানসিক ব্যাধি, স্মৃতিভ্রংশ হয়ে যায়।

‘ব্রেনওয়াশ’ ছাড়াও, সিআইএ নানা খাতে তথাকথিত বিজ্ঞানসম্মত গবেষণার পরীক্ষায় অর্থ ঢেলেছে।

১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ১৫০০ জনেরও বেশি লোককে গুয়াতেমালায় পরীক্ষা করা হয়। এসব পরীক্ষার উদ্দেশ্য হলো পেনিসিলিন যৌনবাহিত রোগ নিরাময় বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কিনা তা প্রমাণ করা।

পরীক্ষার প্রক্রিয়ায় তারা অজান্তেই সিফিলিস এবং গনোরিয়া রোগে আক্রান্ত হন। তাদের মধ্যে রয়েছে শিশু, এতিম, ভাড়াটে, মানসিকভাবে অসুস্থ রোগী, বন্দী ও পতিতা নারী প্রমুখ। ২০১০ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এ ঘটনার জন্য ক্ষমা চান। কিন্তু অর্থ বন্ধের দাবি শেষ পর্যন্ত খারিজ হয়ে যায়।

চলমান শতাব্দীতে এমন মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী আচরণ অব্যাহত ছিল। ২০১৫ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় এবং আমেরিকান ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করে। যেহেতু ভারতে পরীক্ষার খরচ যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ৬০ শতাংশ কম। তাই, কিছু ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ৯ বছর বয়সী ভারতীয় শিশুদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করে নতুন অ্যান্টি-সারভিকাল ক্যান্সার ভ্যাকসিনের প্রভাব পরীক্ষা করে। শিশুদের শরীরে তখন বমি ভাব, মাথা ঘোরা এবং ওজন হ্রাসের মতো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

এসব মানব পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি স্থায়ী মানসিক ক্ষতিও সৃষ্টি হয়। উয়েননিকের এখনও দীর্ঘস্থায়ী ভয় রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মীরা তাকে জানিয়েছিলো যে, সিআইএ ৭০ দশকের শেষ দিকে এসব পরীক্ষার প্রতিবেদন ধ্বংস করে। এটি ছিল সুস্পষ্ট মিথ্যা কথা। শেষ পর্যন্ত, তিনি তার পরিচিতিদের মাধ্যমে হাসপাতালের বেসমেন্টে ৩৪টি বাক্স তথ্য খুঁজে পান। সেগুলোর মধ্যে তার শৈশবের ঘটনাগুলো রয়েছে। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং এমনকি ঘটনাস্থল থেকে পালানোর চেষ্টা করেন। তিনি বলছিলেন, ‘আমি ভাবছি তারা আমার জীবনে কী পেয়েছিল?’

首页上一页123全文 3 下一页

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn