চীনের সংস্কৃতি, চীনের ঐতিহ্য-২২: বর্ণাঢ্য আয়োজনে চীনজুড়ে ড্রাগনবোট উৎসব
‘শুধুমাত্র ড্রাগন বোট প্রতিযোগিতা দেখতে আমি থংরেনে ফিরে এসেছি। থংরেনের দলটি বেশ ভালো পারফর্ম করছে। তাই নিজ চোখে প্রতিযোগিতা দেখতে চলে এলাম’।
এদিকে দক্ষিণ চীনের কুয়াংতোং প্রদেশেও বেশ বড় আকারের নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। পার্ল নদীতে কুয়াংচৌ আন্তর্জাতিক ড্রাগন বোট ইনভাইটেশনাল টুর্নামেন্ট ২০২৩ অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রতিযোগিতায় ১২৫টি ড্রাগন বোট টিমে মোট ৫ হাজার ক্রীড়াবিদ অংশ নেয়।
প্রতিযোগিরা বলেন, নৌকাবাইচের সময় নৌকাকে সর্বোচ্চ গতিতে নিয়ে যেতে দলের সকল সদস্যদের সমান তালে বৈঠা চালাতে হয়। পাশাপাশি পানিতে বৈঠা চালনার গভীরতা ও প্রতিটি ব্যক্তির শক্তি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়।
ড্রাগন বোট উৎসবে ‘চংজি’ নামের একটি বিশেষ খাবার খাওয়ার রীতি আছে চীনাদের। আঠালো ভাত দিয়ে তৈরি গোলাকৃতির এই খাবার বেশ উপভোগ করেন চীনারা।
ড্রাগন বোট উৎসব চীনের ঐতিহ্যবাহী উৎসব হলেও এটি শুধু দেশের ভিতরেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। দক্ষিণ আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, ব্রাজিল, ইতালি ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেশ আয়োজন করে উদযাপিত হয়েছে এই উৎসব।
ড্রাগন বোট উৎসবকে শুধু চীনের নয়, এশিয়ার সবচেয়ে বর্ণিল উৎসব হিসেবেও আখ্যায়িত করেন অনেকে।
২. কবির প্রতি ভালোবাসার গল্প
চীনের মানুষ যে কবি এবং কবিতাকে কত ভালোবাসেন তা বোঝা যায় বা তুয়ান উ চিয়ে বা ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল থেকে। একজন কবির স্মৃতিকে ধারণ করতেই এ উৎসবের সূচনা। খ্রিস্ট পূর্ব ৩০০ শতকের দিকে একটি বিয়োগান্তক ঘটনার স্মরণে এই দিবস।
সে সময় চীনে সাতটি রাজ্য ছিল- ছি, চু, ইয়ান, হান, চাও, ওয়েই এবং ছিন। এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল ছিন রাজ্য।
রাজ্যগুলোর মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকতো। চু রাজ্যের বিখ্যাত কবি ছু ইউয়ান ছিলেন রাজার বিশ্বস্ত কর্মচারী।
রাজা ও জন্মভূমির প্রতি তার বিশ্বস্ততা ছিল অবিসংবাদিত। অভিজাত রাজপরিবারের সন্তান ছু ইউয়ান ছিলেন রাজার প্রধান পরামর্শদাতা। তিনি চু রাজ্যকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য রাজাকে বিভিন্ন সুপরামর্শ দিতেন। ছু ইউয়ান রাজাকে পরামর্শ দেন ছি রাজ্যের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে জোটবদ্ধ হয়ে ছিন রাজ্যের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার। কিন্তু ছু ইউয়ানের পরামর্শ রাজা অগ্রাহ্য করেন। এর পিছনে রয়েছে চিরকালের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। রাজ দরবারে ছু ইউয়ানের প্রতিপত্তিতে ঈর্ষান্বিত অন্য মন্ত্রী ও পারিষদরা তার বিরুদ্ধে রাজার কান ভারি করে।
রাজা ছু ইউয়ানের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে রাজদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করেন এবং নির্বাসনে পাঠান। নির্বাসনে থাকার সময় ছু দেশপ্রেমমূলক অনেক কবিতা লেখেন যার অনেকগুলো এখনও চীনে বেশ জনপ্রিয়। গ্রামবাসী এই কবিকে ভালোবাসতো। তারা তার কবিতা শুনতো এবং তাকে সমাদর করতো।
এদিকে ২৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ছিন রাজ্য চু রাজ্যের উপর হামলা চালিয়ে রাজধানী দখল করে নেয়। নিজের প্রিয় মাতৃভূমির পরাজয়ের সংবাদ যখন কবির কানে পৌঁছালো তিনি সে দুঃখ সইতে পারলেন না। তিনি মিলোও নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করলেন। পঞ্চম চান্দ্র মাসের পঞ্চম দিনে এই বিয়োগান্তক ঘটনাটি ঘটে।
স্থানীয় লোকেরা যখন তাদের প্রিয় কবির আত্ম বিসর্জনের কথা জানতে পারে তখন তারা নদীতে নৌকা নিয়ে তার মৃতদেহের সন্ধান করতে থাকে। অশুভ আত্মাদের তাড়াতে তারা নৌকার বৈঠা দিয়ে নদীর পানিতে বাড়ি মারে এবং ঢাক পিটিয়ে জোরে জোরে শব্দ করতে থাকে। মাছ যেন কবির মৃতদেহ না খায় এজন্য তারা ভাতের ছোট ছোট পুঁটুলি নদীতে ছুঁড়ে ফেলে। একজন বৃদ্ধ চিকিৎসক নদীতে কিছুটা মদিরা ঢালেন যেন অশুভ দানবরা তা পান করে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং ছু ইউয়ান দানবদের গ্রাস থেকে রক্ষা পান। এই ঘটনার স্মরণে এখনও ড্রাগন বোট উৎসব পালন করা হয়।
মধ্য চীনের হুনান প্রদেশে ছাংশা শহরের ৫০ কিলোমিটার উত্তরে মিলোও নদীতে এখনও নৌকা ভাসানো হয়। কালক্রমে এটি নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতায় রূপ নিয়েছে। এ সব রীতি রেওয়াজের মধ্য দিয়ে স্মরণ করা হয় দেশপ্রেমিক কবি ছু ইউয়ানকে।
৩. বেইজিং আন্তর্জাতিক বইমেলা: সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনে বই
বইয়ের মাধ্যমে ‘সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং পারস্পরিক শিক্ষাকে গভীরতর করা'- এ থিম নিয়ে ১৫ থেকে ১৮ জুন হয়ে গেলে বিশ্বের বৃহ্ত্তম বেইজিং আন্তর্জতিক বইমেলা। বেইজিং ন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় চারদিনব্যাপী মেলাটি।