বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা, একটি প্রস্তাবনা
মহান এই লক্ষ্য অর্জনের অনেকগুলো ধাপ রয়েছে। জগতে বহুবার স্বাধীনতা ও অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে, বিপ্লব বেহাত হয়েছে। তাই, সাফল্য রক্ষা করা এবং ‘টেকসই’ করাই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য সর্বাগ্রে নজর দেওয়া উচিত, প্রচলিত ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাকাঠামোর দিকে।
কোনো দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রধানত ২টি উদ্দেশ্য থাকে। মানব-সন্তানকে প্রকৃত মানুষ বানানো এবং দক্ষ জনশক্তি গঠন করা। এর মধ্যে মৌলিক শিক্ষা হলো প্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার সময়কাল। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত এই ১২ বছরের শিক্ষাকে শিক্ষাবিদগণ বুনিয়াদি শিক্ষা বা মৌলিক শিক্ষা বলে থাকেন।
যে ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে শিক্ষার কাঠামো, তাতে বিভেদ করার সুযোগ থাকে না। শিক্ষার্থী মাত্রই মৌলিক শিক্ষা, ভিত্তিমূলক শিক্ষা বা বুনিয়াদি শিক্ষা লাভের সমান দাবিদার। রাষ্ট্রযন্ত্রের শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদের ২৬তম ধারায় মৌলিক শিক্ষার অধিকারকে মানবাধিকারের অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। মৌলিক বা বুনিয়াদি শিক্ষাব্যবস্থা বলতে এমন পদ্ধতিকে বোঝায়, যা সব শিশুর জন্য সহজলভ্য, বিনামূল্যে প্রাপ্য এবং জীবনের দক্ষতা অর্জনের সুযোগ তৈরি করবে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ও ইউনেস্কোর অধীনে মৌলিক শিক্ষা বিষয়ে মৌলিক ধারণা হল যে, এটি সবার জন্য বাধ্যতামূলক ও বিনামূল্যে হওয়া উচিত। ইউনেস্কোর ‘সবার জন্য শিক্ষা’ (Education for All) কর্মসূচিতে এই লক্ষ্যটিই জোর দিয়ে বলা হয়েছে। জীবনমুখী দক্ষতা বলতে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করা বোঝায়। যেমন– লিখতে, পড়তে, গণনা করতে এবং স্বাস্থ্য, পরিবেশ, নাগরিক দায়িত্ববোধ, ও সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন।
জীবনের প্রথম দফার এই মৌলিক শিক্ষার মাঝে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার ভেদাভেদ ঢুকিয়ে দেওয়া গর্হিত অন্যায়! ‘মানব-সন্তানকে প্রকৃত মানুষ বানানোর’ মিশন বাস্তবায়নের জন্যই প্রয়োজন ‘জীবনমুখী শিক্ষা’। ‘জীবনমুখী শিক্ষার’ কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। এ শিক্ষা মানবপ্রকৃতি ও সৃষ্টি বৈচিত্র্যের সঙ্গে জড়িত। পরিবেশ ও বস্তুজগতের কল্যাণ-সম্পর্কিত বাস্তব বিষয়াদি হলো এই ‘জীবনমুখী শিক্ষা’! এই নৈতিকতা সাম্যের শিক্ষা দেয়, বৈষম্য নির্মূলের শিক্ষা দেয়, মানুষের ন্যায্য অধিকারের কথা বলে, প্রাণীকুলের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে। এটাই সেই জীবনমুখী ক্ষা- যা শোষণ-বঞ্চনা-নিগ্রহ বিরোধিতার মানসিকতা তৈরি করে, লিঙ্গ-বর্ণ-জাত নির্বিশেষে সবাইকে সম-মর্যাদার মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়; সবাইকে এক কাতারে স্থান করে দেয়। দেশের প্রয়োজনে, বিশ্বের প্রয়োজনে, মানুষের জীবনধারণের প্রয়োজনে দক্ষ জনশক্তি গড়তে বৈচিত্র্যময় পেশাদার শিক্ষার ব্যবস্থা দেশের সরকার গ্রহণ করে। কিন্তু, একটি মানবসন্তানের শৈশব-কৈশোরের দিনগুলোতে বিজ্ঞান-মানবিক-ব্যবসায় শিক্ষার বিভেদ ও অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়। মানুষ বানানোর আগে শিশু-কিশোরের মনোজগতকে সম্পূর্ণ পেশাগত খাতে প্রবাহিত করা অপরাধ বলেই বোঝা যায়।
কোমলমতি শিশু-কিশোরদের ‘মানুষ’ বানাতে প্রয়োজন এই ‘জীবনমুখী নৈতিক শিক্ষা’। তাদের মন-মনন ও শুদ্ধ চিন্তাদর্শন গঠনে বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম গঠন করা উচিত। দেশজুড়ে উত্কৃষ্ট মানের শিক্ষাব্যবস্থা দৃঢ়ভাবে কার্যকর করে প্রতিটি শিশু-সন্তানকে বাধ্যতামূলক শিক্ষার আওতায় আনা দরকার। যাতে তাদের হাতেই গড়ে ওঠে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ। এভাবেই মানুষের সুখী, নিরাপদ, সমানাধিকারভিত্তিক ও ন্যায়বিচারপূর্ণ জীবনযাপন নিশ্চিত হবে।
মোহাম্মদ তৌহিদ, সিএমজি বাংলা বিভাগ, বেইজিং।