বাংলা

ফুকুশিমার স্মৃতি ভোলা যাবে না, পরমাণু দূষিত জল নিষ্কাশন বন্ধ করা উচিত

CMGPublished: 2023-06-27 16:32:19
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

জাপানি চলচ্চিত্রের একটি চরিত্র খুব বিখ্যাত। তা হল গডজিলা। চলচ্চিত্রে সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে একটি দুর্ঘটনা সমাধান করা হয়। পরে সরকারের তার দায়িত্বহীন আচরণে পরমাণু লিক হবার দুর্ঘটনা ঘটে। ঠিক যেন ২০১১ সালের বাস্তব ঘটনার মতো। এখন পর্যন্ত ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুত্ কেন্দ্রের দুর্ঘটনার ক্ষতি অব্যাহত রয়েছে। জাপানিদের তৈরি মুভি চরিত্র গডজিলা হল পারমাণবিক বিকিরণের ফলাফল। আর পারমাণবিক বিকিরণকে মানুষ অনেক ভয় পায়।

তবে বাস্তবতা চলচ্চিত্রের চেয়ে আরো বিপদজনক এবং ভয়ংকর।

টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি সম্প্রতি ফুকুশিমা পরমাণু দূষিত পানি নিষ্কাশনের সরঞ্জামের ট্রায়াল অপারেশন শুরু করেছে। যা দুই সপ্তাহ ধরে চলবে। এই পদক্ষেপকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জনমত সমালোচনা করেছে। জাপান সরকার এমন দায়িত্বহীন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় কি ফুকুশিমা দুর্ঘটনায় কবলিত মানুষের দুঃখময় জীবনের কথা ভুলে গেছে? তারা এখনো এই দুর্ঘটনার ছায়াতলে আছেন। তাহলে ফুকুশিমা দুর্ঘটনায় পরমাণু দূষণ কতটা বিপদজনক, আমরা কয়েকটি বাস্তব উদাহরণ দেখি।

পরমাণু দুর্ঘটনার পর, ফুকুশিমা প্রিফেকচারে কমপক্ষে তিন শতাধিক শিশু থাইরয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়, যা অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি। ফুকুশিমা কমন ক্লিনিকের পরিচালক ইউকিহিকো বুসি বলেন পেশাদার দৃষ্টিকোণ থেকে, শিশুদের থাইরয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার হার দশ লাখের মধ্যে এক থেকে দুইজন। তবে ফুকুশিমাতে ঘটনার পর প্রতি ৬০ হাজারে এক থেকে দুইজন আক্রান্ত হচ্ছে। তিনি বিশ্বাস করেন, এর কারণ পরমাণু দুর্ঘটনা ছাড়া অন্য কিছু নয়। ২০২২ সালের মে মাসে, টোকিও আদালত ফুকুশিমা প্রিফেকচারে টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা হয়। ছয়জন থাইরয়েড ক্যান্সারের রোগীর মামলার শুনানির পর বিচারকাজ শুরু হয়। পরমাণু বিকিরণের কারণে স্বাস্থ্যের ক্ষতির জন্য এটি টেপকো’র (TEPCO) বিরুদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ। তবে, টেপকো আদালতে কোন দায় স্বীকার করেনি।

ফুকুশিমা প্রিফেকচারে, কিছু বাসিন্দা পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর থাইরয়েড ক্যান্সার-সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার মুখে পড়েছেন। দুই সন্তানের একক মা মিকা সাতো ফুকুশিমা শহরে থাকেন। পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর, তার ছোট ছেলের হাইপারটেনশন হতো, খেতে অসুবিধা হতো এবং তার পা নাড়াতে পারতো না। দশ বছরেরও বেশি সময় পরে, তিনি চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন জায়গায় যান, কিন্তু তিনি এখনও সমস্যার কারণ খুঁজে পাননি। মিকা সাতো বলেন প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার পথে বিকিরণের মাত্রা ৩০ মাইক্রোসিয়েভার্ট, যেখানে সাধারণ পরিবেশগত বিকিরণ মান প্রায় ০.২ মাইক্রোসিয়েভার্ট হওয়া উচিত। সেই রাস্তার বিকিরণ মান সাধারণ মানের থেকে ১৫০ গুণ বেশি ছিল। যাই হোক, সরকারের কোন সতর্কতা ও সুরক্ষা ছিল না, এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে পরিবেশ একেবারে নিরাপদ।

আমরা আরেকটি উদাহরণ দেখি।

ফুকুশিমায় একটি বেসরকারি সংস্থা রয়েছে—ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশেপাশে পরিবেশগত বিকিরণ তত্ত্বাবধান দল রয়েছে। তারা স্বেচ্ছায় দশ বছর ধরে ফুকুশিমায় পরিবেশগত বিকিরণ নিয়মিত পরীক্ষা করছে। দলে ৮০ জনেরও বেশি লোক রয়েছে। দলের সদস্য বাছাইয়ের একটি নিয়ম হল- বয়স ৬০ বছরের বেশি হতে হবে। এর কারণ হলো- পরীক্ষাকারী দলের প্রধান মাসামি আওকি বলেন, তাদের জীবন শেষের দিকে। তবে যুবকদের দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকার সুযোগ আছে। তারা জানেন যে দশ বছরেরও বেশি সময় পর, ফুকুশিমা পারমাণবিক বিকিরণের ঝুঁকি এখনও অনেক বেশি রয়েছে। তাই তারা তাদের বৃদ্ধ শরীর নিয়ে এই ধরনের বিপজ্জনক কার্যকলাপ চালান।

আওকি বলেন যে, জাপান সরকার বর্তমানে পারমাণবিক বিকিরণ দূষণের মাত্রা অনুযায়ী ফুকুশিমাকে একাধিক অঞ্চলে ভাগ করেছে। ফুকুশিমা প্রিফেকচারের সরকারি ওয়েবসাইটের জানা যায়, গোলাপি এলাকা সবচেয়ে দূষিত, একে বলা হয় "বাড়িতে ফেরা কঠিন এলাকা"। জাপান সরকার তথাকথিত বিকিরণ নির্মূলকরণের কাজ করে। দূষিত মাটি সংগ্রহ করে নির্ধারিত জায়গায় রাখে। এই কাজের পর লোকজন বাসায় ফিরতে পারবে।

তবে আওকি বলেন, সরকারের দূষণমুক্ত কাজের পর বিকিরণ মাত্রা এখনো অনেক বেশি। সরকার শুধু বাসার কাছাকাছি ২০ মিটার এলাকায় এমন কাজ করে, অন্য জায়গা পর্যবেক্ষণ করে না। তাই তিনি মনে করেন, যত সময় হোক না কেন, এই পরমাণু দূষণ অবস্থা ভালো হবে না।

এখন জাপান সরকার বিভিন্ন পক্ষের বিরোধিতা উপেক্ষা করে পরমাণু দূষিত জল সমুদ্রে নিষ্কাশন করতে যাচ্ছে। টেপকোর দাবি, নিষ্কাশন হওয়া জল হল "এএলপিএস শোধিত জল" যা ট্রিটিয়াম ছাড়া অন্য তেজস্ক্রিয় পদার্থ নেই। তা সামুদ্রিক জলের সাথে ব্যাপকভাবে মিশে যাবে। জাপান সরকার আরও বলেছে যে, এই ধরনের জল মানুষের জন্য নিরাপদ এবং ক্ষতিকারক নয়।

তবে উপরোক্ত উদাহরণগুলো বিবেচনা করলে আমরা কিভাবে জাপান সরকারের কথা বিশ্বাস করতে পারি?!

ফুকুশিমা পারমাণবিক দুর্ঘটনায় সৃষ্ট দূষিত জল সাগরে নিঃসরণ করতে যাচ্ছে, যা স্বাভাবিক অপারেশনের মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিষ্কাশন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ফুকুশিমা পারমাণবিক দূষিত জলে সহস্রাধিক ধরণের তেজস্ক্রিয় পদার্থ রয়েছে।

টেপকো শুধুমাত্র ৩০ ধরনের তেজস্ক্রিয় পদার্থ যেমন সিজিয়াম ১৩৭ এবং প্লুটোনিয়ামকে পরীক্ষামূলক বস্তু হিসাবে গ্রহণ করেছে এবং এসব পদার্থের নির্দিষ্ট সীমার নিচে থাকলে, জলের মান ঠিক আছে- ধরা যায়। তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিশেষত্বের কারণে, কিছু দীর্ঘজীবী নিউক্লাইড সমুদ্রের পানির সাথে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে।

আমাদের কানেও বিপদের ঘণ্টা বাজছে। জাপান ইতোমধ্যে ফুকুশিমা পারমাণবিক দুর্ঘটনা সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় ভুল করেছে, যার ফলে ফুকুশিমা ও এর আশেপাশের এলাকায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে। গোটা মানবজাতির সামগ্রিক স্বার্থের মুখে, জাপানের উচিত সাগরের আইন সম্পর্কিত জাতিসংঘ কনভেনশনের অধীনে তার বাধ্যবাধকতা কঠোরভাবে মেনে চলা এবং সমুদ্রে বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক দূষিত জল নিষ্কাশনের মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন পরিকল্পনা বন্ধ করা।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn