আপনাকে চীনের শস্য চাষের পিছনের গল্প জানাই
চীনে একটি প্রবাদ আছে: শস্যের ফলন হলে দেশ নিরাপদ হয়। খাদ্যশস্যের ফলন আসলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। চলতি বছর আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অনেক কঠোর, চীনে বিভিন্ন জায়গায় বার বার করোনাভাইরাস মহামারি দেখা যাচ্ছে। আবার, চরম আবহাওয়ার কারণে এই বছর দেশের শস্যের ফলন সম্ভব কি না, তা অনেকের মনে এক বিরাট প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি চীনের রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো দেশের খাদ্য উৎপাদনের ফলাফল প্রকাশ করেছে। যার পরিমাণ ৬৬ কোটি টন। যা আগের বছরের চেয়ে ০.৫ শতাংশ বেশি।
চলতি বছর শস্যের ফলন অর্জন করা সহজ ব্যাপার নয়।
গত বছর শরৎকালের বন্যা থেকে জানা যায়, দেশের প্রধান গম উৎপাদন এলাকা এতে প্রভাবিত হয়েছে। এক তৃতীয়াংশ শীত্কালীন গম চাষ এই কারণে দেরি হয়েছে। যা আসলে গ্রীষ্মকালের ফলনের জন্য কঠোর একটি চ্যালেঞ্জ।
আর চলতি বছর অনেক জায়গায় খরা দেখা দেয়। তাই শরৎকালের শস্য উৎপাদন এতে কিছুটা প্রভাবিত হয়েছে।
বলা যায়, উত্তর থেকে দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত, চীনের গ্রীষ্মকালীন ও শরৎকালীন শস্য উৎপাদন বিভিন্ন মাত্রায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে কবলিত হয়েছে।
তবে, বছর শেষে আমরা আবিষ্কার করি যে, দেশের ১৩টি শস্য উৎপাদন এলাকা, যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত হয়, তবুও সব প্রদেশে ফলন সম্ভব হয়েছে।
কেন?
এত বেশি নেতিবাচক চাপে, ফলন কীভাবে সম্ভব হয়েছে?
চীনে একটি কথা প্রচলিত আছে, বেশি পরিশ্রম করলে, বেশি ফলন হয়। চীনা মানুষের চেষ্টাই হল ফলনের ‘গোপন কোড’।
চলতি বছর চীন সরকার বিভিন্ন স্তরের সরকারকে ভালোভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করার নির্দেশনা দিয়েছে। সরকার ১২০ বিলিয়ন ইউয়ান আবাদি জমিতে ভর্তুকি দিয়েছে। কৃষকদের জন্য ৪০ বিলিয়ন ইউয়ান ভর্তুকির ব্যবস্থা নিয়েছে। এর মাধ্যমে কৃষকের শস্য চাষের আগ্রহ অনেক বেড়েছে।
এ ছাড়া, চলতি বছর শস্য ফলনে উচ্চ মানদণ্ডের আবাদি জমিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। গত দশ বছরে চীন জমির জলসেচ কাজকে কেন্দ্র করে উচ্চ মানদণ্ডের জমি নির্মাণে অব্যাহতভাবে বরাদ্দ করেছে। উচ্চ মানদণ্ডের আবাদি জমি চীনের উত্তর-পূর্ব, হুয়াং হ্য নদী ও হুয়াই হ্য নদীসহ ছয়টি শস্য উৎপাদন এলাকার বিভিন্ন অবস্থার আবাদি জমিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এসব আবাদি জমিতে স্থিতিশীল শস্য উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।
তাহলে কীভাবে সাধারণ জমিকে বেশি উৎপাদনে সক্ষম শ্রেষ্ঠ জমিতে পরিণত করা হয়েছে?
এক, জমির আকার বাড়ানো। এভাবে শস্য চাষের আয়তন বৃদ্ধি পায়। দুই, জমিকে সোজা করা, যাতে কৃষি মেশিন সুবিধাজনকভাবে কাজ করতে পারে। এর সঙ্গে জমির পুষ্টি বাড়ানো। কৃষি বিভাগ প্রত্যেক উচ্চ মানদণ্ড জমির নমুনা পরীক্ষা করে, প্রত্যেক জমির অবস্থা অনুযায়ী বিশিষ্ট ব্যবস্থা নেয়, যে উপাদানের অভাব হয়, সে উপাদান যোগ করে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ, চীনে ৬.৬ লাখ বর্গকিলোমিটার উচ্চ মানদণ্ডের আবাদি জমি তৈরি হবে। এতে গড়পড়তা উৎপাদনের পরিমাণ ১০ থেকে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
চলতি বছর চীনের শরৎকালীন ফসলের জমিতে কৃষিকাজে ব্যবহৃত ড্রোন খুব বেশি দেখা যায়। আশার জমিতে বিজ্ঞান আরো বড় ভূমিকা পালন করছে।
এখন চীনে কৃষি জমি চাষাবাদে মেশিন ব্যবহারের হার ৭২ শতাংশ। চীনের নিজস্ব উত্পাদিত চার সহস্রাধিক ধরনের কৃষি মেশিন বিভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থার জমিতে কাজ করছে। সেই সঙ্গে বিগ ডেটা, ক্লাউড কম্পিউটিং এবং পেইতৌ নেভিগেশনসহ বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর ফলে কৃষি খাতের ড্রোন ব্যবহার এবং আয়তনে চীন বিশ্বের শীর্ষে অবস্থান করছে।
গত দশ বছরে চীন ৯৫০ ধরনের বীজ লালন করেছে। এসব নিজস্ব গবেষণার বীজ চরম ঠান্ডা এবং লবণাক্ত জমিতেও চাষ করা যায়, শ্রেষ্ঠ বীজ শস্য উৎপাদনে ৪৫ শতাংশ অবদান রাখতে পারে।
চলতি বছর বার বার করোনাভাইরাসের মহামারি দেখা গেছে, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ওষুধ এসব গুরুত্বপূর্ণ পণ্য সময়মতো কৃষকের হাতে পৌঁছাতে না পারলে সমস্যা সৃষ্টি হয়। এই কাজে চীন সরকার এসব কৃষি পণ্যকে নিশ্চয়তার অন্তর্ভুক্ত করেছে। যাতে কৃষকের চাষাবাদ আরো সুষ্ঠু হয়।
এখন চীনে ১৪টি কৃষিপণ্য উৎপাদন ঘাঁটি, ৭টি লজিস্টিক্স কেন্দ্র, ১টি দশ হাজার টন পর্যায়ের বন্দর, এবং ২০ হাজারেরও বেশি কৃষিপণ্য নেট স্টেশন যৌথভাবে একটি নিশ্চয়তার নেট গঠন করেছে। চরম অবস্থা হলেও কৃষকের হাতে প্রয়োজনীয় সব পণ্য পৌঁছে দেওয়া যায়।
চলতি বছর চীন খাদ্য ও জনগণের জীবিকা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের দাম স্থিতিশীল করা এবং সরবরাহ নিশ্চিত করা আরো জোরদার করেছে। রাসায়নিক সার, কীটনাশক ওষুধ এবং বীজসহ চাষাবাদের গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের নিশ্চয়তায় আরো কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে। যাতে খাদ্যশস্য ফলন ও উৎপাদন করা যায়। চলতি বছরের প্রথম দশ মাসে চীনে নাগরিকের ভোগ্য দামের সূচক অর্থাত্ সিপিআই-এর মধ্যে শস্য ও খাদ্যের দাম বৃদ্ধি যথাক্রমে ২.৮ শতাংশ এবং ২.৫ শতাংশ। যা যুক্তরাষ্ট্রে খাদ্যের দাম বৃদ্ধির ৯.৮ শতাংশের চেয়ে অনেক কম।
জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রকাশিত বিশ্বের শস্য দাম সূচক থেকে জানা যায়, গত মে মাসের দাম গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। অল্প কয়েক মাসের মধ্যে তা ২৩ শতাংশ বেড়েছে।
আর চলতি বছর চীনের গমের দামের প্রবণতা থেকে জানা যায়, বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি এবং ব্যয় বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন উপাদানের প্রভাবে, চীনে গমের দাম আগের বছরের চেয়ে কিছুটা বাড়লেও মোট প্রবণতা মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দামের পরিবর্তন অনেক। সেই তুলনায় চীনে গমের দাম অবস্থা অনেক স্থিতিশীল রয়েছে। চীনের জাতীয় খাদ্য ও তেল তথ্য কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীনে খাদ্যশস্যের দাম মোটামুটি স্থিতিশীল ও যৌক্তিক পর্যায়ে রয়েছে। দামের বড় ধরনের ওঠা-নামা হয় নি। চালের দাম আরো স্থিতিশীল রয়েছে।
খাদ্যশস্যের দাম হল সব পণ্যের দামের মূল অংশ। চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারে খাদ্যশস্যের দাম স্থিতিশীল অবস্থায় বজায় রয়েছে। যা জনগণের মৌলিক জীবনযাপনের চাহিদা কার্যকরভাবে নিশ্চিত করেছে, সেই সঙ্গে পণ্যের দামের মান স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখতে সাহায্য করেছে। এর ফলে বাজারের আকাঙ্ক্ষা এবং আস্থাও অনেক জোরদার হয়েছে। যা দেশের সামষ্টিক নিয়ন্ত্রণকে জোরদার করা এবং অর্থনীতির মূল অবস্থা নিশ্চিত করার ভিত্তি স্থাপন করেছে।
খাদ্যশস্যের অবস্থা ভালো হলে দেশ নিরাপদ থাকে। চীন বিশ্বের ১০ শতাংশ আবাদি জমি দিয়ে বিশ্বের প্রায় ২৫ শতাংশ খাদ্যশস্য উত্পাদন করেছে এবং বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ জনসংখ্যা লালন করেছে। চলতি বছর চীনের শস্যের ফলন খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হচ্ছে; যা চীনের বিভিন্ন স্তরের সরকার এবং জনগণের যৌথ চেষ্টার সুফল। এই সুফল চীনের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দৃঢ় চেষ্টা ও সফলতার প্রতিফলন ঘটায়। চীনারা নিশ্চয় নিজের খাবারের বাটি নিজের হাতে আঁকড়ে ধরে থাকবে।