বাংলা

মার্কিন ডলারের আধিপত্য: বিশৃঙ্খল বিশ্ব অর্থনীতির শিকড়

CMGPublished: 2022-11-23 15:12:27
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

ইউএস ফেডারেল রিজার্ভ ২ নভেম্বর আবারও ৭৫ বেসিস পয়েন্ট সুদের হার বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। চলতি বছরের মার্চ থেকে, ফেডারেল রিজার্ভ টানা ছয় বার সুদের হার বাড়িয়েছে। ফলে ২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে সুদের হার হয়েছে সর্বোচ্চ। মার্কিন সাবেক অর্থমন্ত্রী জন কনালি একবার বলেছিলেন, ‘ডলার আমাদের মুদ্রা, তোমাদের সমস্যা।’ যখন বিশ্ব অর্থনীতি করোনা মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘর্ষের নেতিবাচক ধাক্কা সামলাচ্ছে, তখন সাবেক মার্কিন অর্থমন্ত্রীর কথা যেন আবার সত্য প্রমাণিত হয়েছে। মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি হলে যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে পুঁজি আকৃষ্ট করবে, যা অন্যান্য দেশের স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটাবে, ঋণ পরিষেবার খরচ বাড়াবে। যার ফলে কিছু দেশ এমনকি মুদ্রা বা ঋণ সংকটে পড়ে যাবে।

ডলারের আধিপত্য হল আর্থিক ক্ষেত্রে মার্কিন বিশ্ব আধিপত্যের প্রতিফলন এবং বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের জন্য সমর্থনও বটে। তাই নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে চাইলে, যুক্তরাষ্ট্রকে ডলারের আধিপত্যও বজায় রাখতে হবে। যুদ্ধ, জবরদস্তি ও আর্থিক সংন্ত্রাসের মাধ্যমে ডলারের আধিপত্য বজায় রাখে যুক্তরাষ্ট্র। যেমন, গত শতাব্দীর ৮০-র দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জাপানের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত দ্রুত বেড়ে যায় এবং ইয়েনের আন্তর্জাতিকীকরণ এগিয়ে গেলে তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এ ‘সমস্যা’ সমাধানে জাপানের মতো মিত্র দেশের ওপরও জবরদস্তি করে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৮৫ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান ও যুক্তরাজ্য স্বাক্ষর করে প্লাজা চুক্তি। জাপানের রপ্তানির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। জাপান দীর্ঘসময়ের অর্থনীতির মন্দাবস্থায় পড়ে যায়। ইয়েনের বিশ্বায়নও থমকে দাঁড়ায়। ১৯৯৯ সালে যখন ইইরো জন্ম নেয়, তখনও যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ও দমনের মুখে ছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক, লিবিয়া এবং অন্যান্য দেশের বিরুদ্ধে সামরিক হামলা চালানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল পেট্রোডলার ব্যবস্থা এবং প্রধান বাণিজ্য মুদ্রা হিসাবে ডলারের আধিপত্য বজায় রাখা। চলতি বছরের শুরু থেকে, ইউক্রেন সংকট এবং ফেডারেল রিজার্ভের আক্রমণাত্মক সুদের হার বৃদ্ধির কারণে ইউরো, ইয়েন এবং ব্রিটিশ পাউন্ডের মতো মুদ্রার মূল্য হ্রাস পেয়েছে, তবে "নিরাপদ" মুদ্রা হিসেবে ডলারের অবস্থান জোরদার হয়েছে। নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্য বেশিরভাগ দেশের স্বার্থকে উপেক্ষা করা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে স্বাভাবিক ব্যাপার।

মার্কিন ডলারের আজকের মূল্যবৃদ্ধি আসলে কিছু দুর্বল অর্থনৈতিক সত্তাকে আঘাত করেছে। ডলারের ঘাটতি শ্রীলঙ্কাকে ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সঙ্কটে ফেলে। শেষ পর্যন্ত পুরো দেশ দেউলিয়া হয়ে যায়, দেশটির প্রেসিডেন্ট দেশ ত্যাগে বাধ্য হন। ডলারের সাথে বিনিময়ের হারে পাকিস্তানি রুপি রেকর্ড নিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে, যা পাকিস্তানকে তার বৈদেশিক ঋণ খেলাপির দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়। যেহেতু বিশ্বের প্রায় ৭০ শতাংশ বাণিজ্য ডলারে হয়, তাই ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়ানোর পর ডলারের মূল্য বৃদ্ধির ফলে তুরস্কের আমদানিকৃত জ্বালানি, খাদ্য এবং কাঁচামালের দাম বেড়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের অনুমান অনুসারে, নিম্ন আয়ের দেশগুলোর মধ্যে ৬০ শতাংশ সরকার ঋণ সংকটের মধ্যে রয়েছে বা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ।

সৌদি আরব একটি প্রধান তেল উত্পাননকারী দেশ যে "পেট্রোডলার" ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সম্প্রতি অপরিশোধিত তেল উত্পাদন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বিমত পোষণ করে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তেলের দাম কমাতে সৌদি আরবকে উত্পাদন বাড়াতে বলে। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করে সৌদি। প্রকৃতপক্ষে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মার্কিন ডলারের আন্তর্জাতিক স্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিশ্ব মুদ্রা তহবিলের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে, বিশ্বব্যাপী সরকারি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সম্পদের মধ্যে ডলারের অনুপাত ছিল প্রায় ৫৯.৫ শতাংশ। অথচ ২০০১ সালে যা ছিল ৭২.৭ শতাংশ। বিশ্ব অর্থনীতির "ডি-ডলারাইজেশন"-এর প্রবণতা তীব্রতর হচ্ছে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর গুরুত্ব বাড়ছে। স্পষ্টতই, যুক্তরাষ্ট্রের বিশৃঙ্খল আর্থিক নীতি বাজারে আস্থা আনতে পারছে না, পারছে কেবল বহু দেশের অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা আনতে। বিশ্ব তাই এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn