বাংলা

একশ’ বছর আগে, একজন প্যারিস অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন তার জীবন চীনকে উৎসর্গ করেছিলেন

CMG2024-08-08 16:06:31

একশ’ বছর পর অলিম্পিক গেমস আবার প্যারিসে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ১৯২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিকে অনেক অগ্রগামী অনুশীলন ছিল, যেমন প্রথমবারের মতো অলিম্পিক নীতিবাক্য ‘আরো দ্রুত, উচ্চতর ও শক্তিশালী’ প্রবর্তন এবং প্রথমবারের মতো অলিম্পিক ভিলেজের ধারণার প্রবর্তন। একই সময় অনেক কিংবদন্তি সুপারস্টারও এই অলিম্পিক গেমসে আবির্ভূত হয়েছেন, উদাহরণস্বরূপ, ফিনিশ ট্র্যাক এবং ফিল্ড অ্যাথলিট পাভো জোহানেস নুরমি এক অলিম্পিকে প্রথমবারের মতো পাঁচটি স্বর্ণপদক জেতেন।

চীনাদের কাছে সেই অলিম্পিকের সবচে বড় তারকা একজন ব্রিটিশ অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন। তিনি একটি বিশ্ব রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলার সাথে পুরুষদের ৪০০ মিটার চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন, তার অলিম্পিকের গল্পের ভিত্তিক অভিযোজিত ‘চ্যারিয়টস অফ ফায়ার’ শিরোনামে মুভিটি অস্কারের চারটি পুরস্কার পেয়েছে। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয় যে, তিনি চীনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং মারা গিয়েছিলেন, তিনি তাঁর জীবন চীনের জন্য উত্সর্গ করেছিলেন। তার নাম এরিক হেনরি লিদ্দেল, চীনা নাম লি এ রুই। বর্তমানে থিয়েনচিনের স্পোর্টস মিউজিয়ামে, লি এ রুইয়ের জীবন এবং কিংবদন্তির সাথে পরিচিত একটি বিশেষ অধ্যায় রয়েছে।

লি এ রুই ১৯০২ সালে চীনের থিয়েনচিনে জন্মগ্রহণ করেন এবং তার বাবা-মা উভয়েই স্কটিশ ছিলেন। যখন তিনি ৫ বছর বয়সী ছিলেন, তখন তিনি স্কটল্যান্ডে শিক্ষার জন্য ফিরে যান। ছোটবেলায় তিনি ক্রীড়ায় প্রতিভা দেখিয়েছিলেন। তিনি স্কুলের ফুটবল দল এবং ক্রিকেট দলের অধিনায়কও হন। ১৯২০ সালে, লি এ রুই এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের জন্য প্রবেশ করেন এবং তার ক্রীড়া প্রতিভা আরও বিশিষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি স্কটল্যান্ড এবং এমনকি যুক্তরাজ্যে অনেকবার স্প্রিন্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিলেন।

১৯২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিকে লি এ রুই একশ’ মিটার স্বর্ণপদকের জন্য সবচে শক্তিশালী প্রতিযোগী ছিলেন। তবে অলিম্পিক সময়সূচি দেখায় যে, পুরুষদের ১০০ মিটার এবং ৪ X১০০ মিটার রিলে প্রতিযোগিতার তারিখগুলো তার ধর্মীয় কার্যকলাপের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল, তাই তিনি এই দুটি ইভেন্ট পরিত্যাগ করার এবং পরিবর্তে পুরুষদের ২০০ মিটার এবং ৪০০ মিটারে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্তটি সেই সময়ে প্রচুর সমালোচনা সৃষ্টি করেছিলো। তিনি এই দুটি ইভেন্টে ভাল ছিলেন না এবং প্রতিযোগিতার জন্য তার কাছে মাত্র কয়েক মাস সময় ছিল।

কিন্তু লি এ রুই শেষ পর্যন্ত পুরুষদের ২০০ মিটার ব্রোঞ্জ পদকই জিতেছিলেন, আর ৪৭.০৬ সেকেন্ডের ফলাফল নিয়ে পুরুষদের ৪০০ মিটার বিশ্ব রেকর্ডও ভেঙেছিলেন।

ফুল, করতালি, এবং সম্মান একের পর এক আসে, যা’হোক, লি এ রুই আরেকটি আশ্চর্যজনক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন - এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে ডিগ্রি পাওয়ার পর ২৩ বছর বয়সে তার ক্রীড়া জীবনের শীর্ষে থাকা অবস্থায় তিনি তাঁর জন্মস্থান থিয়েনচিনে ফিরে আসেন এবং এখানে বসতি স্থাপন করেন।

অনেক লোক এখনও লি এ রুইয়ের সিদ্ধান্ত দেখে বিস্মিত হন। থিয়েনচিন স্পোর্টস মিউজিয়ামের কর্মী চাও ইয়ান বিশ্লেষণ করেছেন যে, একদিকে তার পিতামাতা থিয়েনচিনে থাকেন, তাই তিনি ফিরে এসেছেন এবং অন্যদিকে তিনি তার পরিবারকে আবার একত্রিত করার আশা করছেন; তিনি মনে করেন যে, তার ভবিষ্যত এবং জীবন কেবল চীনেই বেশি অর্থবহ হবে। যেমন লি এ রুই একবার বলেছিলেন: যদিও প্রত্যেকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একই পথে রয়েছে বলে মনে হয়, তবে প্রত্যেকের কাজ আলাদা, তাই জীবনের অর্থও আলাদা।

লি এ রুই থিয়েনচিনে ফিরে আসার পর একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ও শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। তিনি রসায়ন এবং গণিত শেখান, ক্রীড়া প্রশিক্ষক হন এবং অলিম্পিক শিখা ছড়িয়ে দেন। তার প্রচেষ্টায় স্কুলটি ফুটবল দল, বাস্কেটবল দল, বেসবল দল, টেবিল টেনিস দল, টেনিস দল, ভলিবল দল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে, যা থিয়েনচিনের সবচে জনপ্রিয় এবং উচ্চ-স্তরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরিণত হয়।

থিয়েনচিনে লি এরুইকে ‘মিনইউয়েন স্টেডিয়ামের জনক’ নামেও ডাকা হয়। থিয়েনচিনের সবচে বিখ্যাত স্টেডিয়াম হিসাবে, যখন ১৯২৫ সালে মিনইউয়েন স্টেডিয়ামটি সংস্কার করা হয়েছিল, তখন লি এরুই যুক্তরাজ্যের স্ট্যামফোর্ড ব্রিজ স্টেডিয়ামের নকশা অঙ্কন অনুসরণ করেছিলেন এবং এর রানওয়ের কাঠামো, আলোর সরঞ্জামসহবেশ কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছিলেন, ফলে শেষ পর্যন্ত মিনইউয়েন স্টেডিয়াম সেই সময়ে এশিয়ার সেরা স্টেডিয়ামগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছিল।

১৯৩৪ সালে, ৩২ বছর বয়সী লি এরুই থিয়েনচিনে একজন কানাডিয়ান মেয়ে এফ ম্যাকেঞ্জিকে বিয়ে করেন এবং পরে দুটি কন্যার জন্ম দেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাদুর্ভাব বিশ্বজুড়ে অসংখ্য সুন্দর পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়। ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধের নির্মমতা এবং নিষ্ঠুরতা অনুভব করার পরে, ১৯৪১ সালে লি এরুই তার গর্ভবতী স্ত্রী এবং সন্তানদের কানাডায় ফেরত পাঠান, যখন তিনি থিয়েনচিনে থেকে যান এবং আহত সৈন্য ও শরণার্থীদের চিকিৎসায় অংশ নেন। ১৯৪৩ সালে লি এরুইকে জাপানী সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে এবং তাকে ওয়েইসিয়েন (বর্তমানে ওয়েইফাং) বন্দি শিবিরে আটক রাখা হয়।

বন্দি শিবিরে লি এরুই যুবকদের বিজ্ঞান শিখিয়েছেন, খেলাধুলার কার্যক্রম সংগঠিত করেছেন এবং তার আশাবাদী মনোভাবের সাথে সহবন্দিদের সংক্রামিত করেছেন। যাহোক, দীর্ঘমেয়াদী কারাবাস এবং অপুষ্টি তার স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। ১৯৪৫ সালের প্রথম দিকে লি এরুই মস্তিষ্কের টিউমারের কারণে মারা যান এবং তাঁর ৪৩ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনযাত্রা শেষ করেন।

লি এরুইয়ের গল্প এবং কিংবদন্তি সারা বিশ্ব থেকে প্রশংসিত হয়েছে। এই বছর প্যারিস অলিম্পিকে তার স্বর্ণপদক জয়ের ১০০তম বার্ষিকীতে, অনেক জায়গায় লি এরুইয়ের স্মারক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিতও হয়েছিল।

চীনে স্কটিশ সরকারের প্রতিনিধি খ্য ছুন না বলেন, লি এরুই স্কটিশ জনগণের একজন নায়ক, এবং চীনা জনগণের ভাল বন্ধু। অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন এবং অসামান্য ক্রীড়া কৃতিত্ব ছাড়াও যে কারণে তাকে স্মরণ করা হয়, তা হল তার আবেগ, সততা, সহানুভূতি, জীবনের প্রতি উদ্যম এবং সমাজের প্রতি ভালোবাসা।

থিয়েনচিন স্পোর্টস মিউজিয়ামের পরিচালক লিউ চিয়েনবিন মনে করেন, লি এরুইয়ের পরিচয় এবং পরিবেশ যতই পরিবর্তিত হোক না কেন, তার হৃদয় স্থির থাকে— তার সরল বিশ্বাসগুলো অটল এবং অনুশীলন অব্যাহত থাকে, এবং জীবনের অর্থ অনুসরণ করে। এই আত্মা এবং শক্তি সময় এবং স্থান অতিক্রম করে এবং মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।

Close
Messenger Pinterest LinkedIn