আকাশ ছুঁতে চাই ৬৯
১. পদ্মার তীরে ভালোবাসার ঘর
২. নারী কৃষকদের আন্তর্জাতিক বর্ষ
৩. এখন আমার ডানা আছে
নারী ও শিশু বিষয়ক অনুষ্ঠান আকাশ ছুঁতে চাই থেকে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। আমাদের অনুষ্ঠানে আমরা কথা বলি নারী ও শিশুর অগ্রযাত্রা, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, সাফল্য, সংকট সম্ভাবনা নিয়ে। আমরা কথা বলি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের অধিকার নিয়ে।
পদ্মার তীরে ভালোবাসার ঘর
বাংলাদেশের খুব কম সংখ্যক নারী ভিনদেশি নাগরিককে বিয়ে করার সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এমনি একজন নারী ইতি আক্তার।
পদ্মার তীরে ভালোবাসার ঘর বেঁধেছেন মুন্সীগঞ্জের ইতি আক্তার ও চীনের চান চিয়াসিং। চীনা প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুবাদে দুজনের জানা-শোনা এরপর প্রেম।এখন ভালোবেসে পাঁচ বছরের সংসার জীবনে পা দিয়েছেন তারা। এরইমধ্যে তারা বাংলাদেশেই গড়ে তুলেছেন তাদের স্বপ্নের বাড়ি। বিস্তারিত প্রতিবেদনে।
মুন্সীগঞ্জের ইতি আক্তার ও চীনের চান চিয়াসিং। কোনো এক দিন দুজনের অজান্তেই হৃদয়ে আছড়ে পড়ে পদ্মার ঢেউ। এরপর সঙ্গোপনে রচনা করতে শুরু করেন প্রেমের এক নতুন মানচিত্র। দেশ, সংস্কৃতি ও ভাষার সীমানা টপকে যে মানচিত্রে ফুটে ওঠে একটাই রেখা—ভালোবাসা।
ইতি ও চানের প্রেমের গল্পের শুরু পদ্মার পাড়েই। সালটা ছিল ২০১৭, তখনও তৈরি হয়নি পদ্মা সেতু। সেতু না থাকলেও কাজের সুবাদে দুজনের জানাশোনা ছিল বেশ। মূলত দুজনই পদ্মা রেলওয়ে সংযোগ প্রকল্প ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সি আর ইসির কর্মী।
চান চিয়াসিং বলেন, আমার বউ অনেক ভালো মানুষ, অনেক সোজা মানুষ, ঠান্ডা মানুষ ।আমি তাকে খুব ভালোবাসি’।
ইতি আক্তার বলেন, আমার হাজবেন্ড আমাকে এতো বেশি ভালোবাসছে, আমার জন্য অনেক কিছু করছে , আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য, একসঙ্গে থাকার জন্য। ওর ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হয়ে আমি ওকে ভালোবেসেছি।
কাজের সুবাদে প্রথম দিকে কথা হতো অনলাইনে। ফোন নম্বর দেওয়া-নেওয়ার পর্ব চুকে গেলে শুরু হয় দীর্ঘ আলাপচারিতা। এক পর্যায়ে চান ইতিকে জানান নিজের ভালোলাগার কথা, ভালোবাসার কথা।
ইতি আক্তার বলেন, ‘উইচ্যাট থেকেই আমাদের কথা বলা শুরু।এরপর ফোনেও কথা হতো। তারপর বেশিরভাগ সময় আমাদের এখানেই থাকতে হতো। সেভাবেই আমাদের সম্পর্কের শুরু’।
চীনা জামাই চান চিয়াসিং বলেন, আমি যখন ফ্রি থাকতাম তখনই তাকে মেসেজ দিতাম। মাঝেমাধ্যে কথা বললাম, দেখা করতাম। প্রায় প্রতিদিনই দেখা করতাম। এভাবেই আমাদের সম্পর্কের শুরু।
চাপা উত্তেজনায় ভরপুর প্রেমের সফল পরিণতি ঘটে ২০১৮ সালের ৯ মে। কারণ ওই দিনই সাত পাকে বাঁধা পড়েন দুজন। তবে বরাবরের মতোই মেয়ের পরিবারের মন জয় করতে পরীক্ষা দিতে হয়েছে চানকে।
ইতি আক্তার বলেন, ও আমার বাড়িতে আসে। আমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে । যেহেতু আমাদের ধর্ম আলাদা, সেহেতু ও সিদ্ধান্ত নেয় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার। এরপর ইসলাম ধর্ম মতে আমাদের বিয়ে হয়’।
একপর্যায়ে পরিবার মেনে নিলে, শুরু হয় সুখের সংসার। প্রতিষ্ঠানে দিনের বেশিরভাগ সময় পার হলেও সময় পেলে তারা ছুটে যান নিজেদের গড়ে তোলা স্বপ্নের বাড়িতে। ইতির পরিবারের সঙ্গে বেশ ভালো সময় কাটছে চানের।
চান চিয়াসিং জানান,আমার শ্বশুর শাশুড়ি অনেক ভালো। সে আমাকে তার ছেলের মতো দেখে।আমাকে অনেক ভালোবাসে’।
এদিকে চীনা শ্বশুর শাশুড়ির আপ্যায়নে ইতিও মুগ্ধ।
ইতি বলেন, ‘আমি ওর বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চীনে যাই। সেখানকার রিচুয়াল মেনে আমাকে বরণ করে। আমি যখন ওর বাসার গেটে গেলাম, এতো আতশবাজি ফুটিয়েছিল আমি অবাক হয়েছিলাম। আমাকে অনেক খুশি মনে বরণ করেছিল’।
দিনে দিনে সংসারের বয়স হলো পাঁচ বছর। হাসি-আনন্দ আর পদ্মার মৃদুমন্দ হাওয়ার মতো খুনসুটিতে কেটে যাচ্ছে ঝলমলে সব দিন। একসঙ্গে গল্প-আড্ডার ফাঁকে দুজনে মিলে রান্না করেন পছন্দের খাবার।
চান বলেন, আমার বউয়ের রান্না মুরগি পোলাও, গরু পোলাও আমি খুব পছন্দ করি।
কদিন পর স্বামীর সঙ্গে চীনে পাড়ি দেবেন ইতি। তবে যে পদ্মার তীরে রচিত হয়েছিল তাদের মিষ্টি প্রেমগাথা, সেই অমোঘ স্রোতের টানে বাংলার কোলে আবার ফিরে আসতে চান দুজনই। চান জানালেন, কোনো একসময় বাঙালি বধূকে নিয়ে বাংলাদেশেই থিতু হতে চান তিনি।
প্রতিবেদন: আফরিন মিম
নারী কৃষকদের জন্য আন্তর্জাতিক বর্ষ ২০২৬
মানবসভ্যতার যাত্রায় নারীর হাতে কৃষিকাজের সূচনা হয়েছিল। কিন্তু এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারী কৃষকরা নানা রকম জেন্ডার বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এই বৈষম্য থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। সচেতনতা সৃষ্টিতে ২০২৬ সালকে ঘোষণা করা হয়েছে আন্তর্জাতিক নারী কৃষক বর্ষ। বিস্তারিত প্রতিবেদনে।
সমাজ বিবর্তনের ধারায় বিশ্বে প্রথম কৃষির সূচনা হয়েছে নারীর হাতে। এই বিশ্বকে সবুজ করে তোলার ক্ষেত্রে নারীর অবদান অনেক বেশি। তবে নারী কৃষকদের বিভিন্ন রকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ সম্প্রতি গৃহীত এক প্রস্তাবে ২০২৬ সালকে ‘নারী-কৃষকদের আন্তর্জাতিক বর্ষ’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ জানিয়েছে এই বর্ষ পালনের উদ্দেশ্য হবে, গোটা বৈশ্বিক কৃষি ও খাদ্যশস্য ব্যবস্থাপনায় নারী-কৃষকদের সামনে বিদ্যমান বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো এবং কৃষি খাতে জেন্ডারসমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন বাস্তবায়ন করা।
‘এখন আমার ডানা আছে’
সাফল্যের আকাশ স্পর্শ করার আশা নিয়ে অনেক নারী নিজেদের ক্যারিয়ারে এগিয়ে যাচ্ছেন। এমনি একজন নারী কেলসাং পেড্রন। তিনি চীনের স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল সিচাংয়ের নারী। তিনি সিচাংয়ের প্রথম নারী যিনি চীনের গণমুক্তি ফৌজে ফাইটার জেট চালকের সম্মান অর্জন করেছেন। শুনবো তার গল্প।
চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল সিচাং। এই অঞ্চল থেকে প্রথম একজন নারী চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির ফাইটার জেট চালক হলেন। এই নারীর নাম কেলসাং পেড্রোন। তার এই সাফল্য সিচাংয়ের নারীদের সাফল্য হিসেবে গণ্য হচ্ছে। কিভাবে এই সাফল্যের আকাশ স্পর্শ করলেন তিনি?
কেলসাংয়ের জন্ম ২০০০ সালের মে মাসে সিচাংয়ের লোখা সিটিতে। ২০১৭ সালে তিনি বেইজিংয়ের টিবেট মিডল স্কুলে পড়ছিলেন। তখন তিনি শোনেন এই স্কুলের একজন সিনিয়র শিক্ষার্থী এয়ারফোর্স এভিয়েশন ইউনিভারসিটিতে সুযোগ পেয়েছেন এবং মিলিটারি এয়ারক্রাফ্ট চালানো শিখছেন।
তিনি তখন নিজের জন্য এটিকে লক্ষ্য হিসেবে নেন। তখন পর্যন্ত সিচাংয়ের কোন নারী পিএলএর ফাইটার জেট চালক হননি।
তিনি তার শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করেন। বাড়িতেও পরিবারকে তার লক্ষ্যের কথা জানান। তার বাবা মা তাকে উৎসাহ দেন।
দুই বছর পর সুযোগ আসে। তার শিক্ষক ঘোষণা করেন যে পিএলএ এয়ার ফোর্স নারী ফ্লাইট ক্যাডেট রিক্রুট করছে। অনেক কঠিন পরীক্ষার পর তিনি এয়ারফোর্স এভিয়েশন ইউনিভারসিটিতে ভর্তির সুযোগ পান।
২০১৯ সালের আগস্টে কেলসাং পেড্রোন সিচাং এর প্রথম নারী হিসেবে ফাইটার এয়ারক্রাফট চালানো শেখা শুরু করেন।
১৯৫১ সাল থেকেই পিএলএ বিমান বাহিনীতে নারীরা পাইলট হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। ২০০৫ সাল থেকে নারী ফাইটার পাইলটরা পিএলএতে কাজ করছেন। এখন পর্যন্ত অনেক নারী ফ্রন্টলাইন ইউনিটে যুদ্ধবিমান চালাচ্ছেন। ১৯৭০ এর দশক থেকে সিচাং এর তরুণরা পিএলএ বিমানবাহিনীতে কাজ করছেন। ফাইটার জেটের পাইলটও হয়েছেন। কিন্তু কেলসাং পেড্রন তার জাতিগোষ্ঠীর প্রথম নারী যিনি এই গৌরব অর্জন করলেন।
কেলসাং বলেন, ‘এখন আমার ডানা আছে। আমি একক ফ্লাইট টেস্টে পাশ করেছি। আমি একজন সত্যিকারের কমব্যাট পাইলট হতে চাই।’
চীনের অন্যতম প্রথম নারী ফাইটার পাইলট লেফটেন্যান্ট কর্নেল হ্য সিয়াওলি বলেন, ‘ফাইটার জেট চালানো অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং। এরজন্য উচ্চমানের প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং মানসিক শক্তি দরকার। তবে এক্ষেত্রে নারী বা পুরুষের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।’
তিনি কেলসাংয়ের সাফল্য কামনা করেন।
প্রতিবেদন: শান্তা মারিয়া
সম্পাদনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
সুপ্রিয় শ্রোতা আকাশ ছুঁতে চাই অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছি আমরা।
অনুষ্ঠানটি কেমন লাগছে সে বিষয়ে জানাতে পারেন আমাদের কাছে। আপনাদের যে কোন পরামর্শ, মতামত সাদরে গৃহীত হবে। আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। আবার কথা হবে আগামি সপ্তাহে। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। চাই চিয়েন ।
সার্বিক সম্পাদনা : ইয়ু কুয়াং ইউয়ে আনন্দী
লেখা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: শান্তা মারিয়া
অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ