মেড ইন চায়না: পর্ব-২৬: ফ্রায়েড রাইস
হাজার বছর আগের কাগজ, চা এবং নুডলস থেকে শুরু করে আজকের প্যাসেঞ্জার ড্রোন, কিংবা নতুন জ্বালানির গাড়ি। সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বসভ্যতা এগিয়ে চলেছে চীনের শক্তিশালী আবিষ্কারের হাত ধরে। নানা সময়ে দারুণ সব আবিষ্কার করে আধুনিক সভ্যতার ভিত গড়ে দিয়েছে চীন। আর সেই সব আবিষ্কার নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন মেড ইন চায়না।
মেড ইন চায়নার ২৬তম পর্বে সাথে আছি আমি ফয়সল আবদুল্লাহ...আজকের পর্বে থাকছে চীনের আবিষ্কার ফ্রায়েড রাইসের কথা।
কোনো অনুষ্ঠান বা উপলক্ষ হাতের নাগালে এলেই সবাই একবাক্যে বলবেন, আজ একটু অন্যরকম খাবার রান্না করা যাক। কিংবা হতে পারে, আজ বাইরে কোথাও গিয়েই খেয়ে আসি। আর এ খাবারের জগতে গোটা দুনিয়ার মন জয় করে বসে আছে চাইনিজ ফুড ওরফে চীনা খাবার। এবার যদি জানতে চাওয়া হয়, সারা বিশ্ব একনামে চিনবে এমন একটি চীনা খাবারের নাম বলুন তো, ঠিক ধরেছেন! সবার আগেই শোনা যাবে ছাওফান বা ফ্রায়েড রাইসের নাম। খাবারটি দেখতে শুনতে যতই আধুনিক মনে হোক না কেন, আজ থেকে কিন্তু প্রায় দেড় হাজার বছর আগে বিশ্বে প্রথম ফ্রায়েড রাইস রান্না করেছিল চীনারা। আমাদের সবার প্রিয় ছাওফান বা ফ্রায়েড রাইস পুরোপুরি মেড ইন চায়না।
এবার জেনে নেওয়া যাক কেমন করে এলো এই ফ্রায়েড রাইস।
খ্রিস্টাব্দ ৫৮৯ থেকে ৬১৮ সাল পর্যন্ত চীনে যখন সুই রাজবংশের শাসন চলছিল, তখনকার একটি নথিতে ছাওফানের প্রথম লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায়। ওই সময় স্টার ফ্রাই করা খাবার জনপ্রিয় হচ্ছিল চীনজুড়ে। আর সেই ধারাবাহিকতাতেই জনপ্রিয় হয় ফ্রায়েড রাইস বা ছাওফান। আর নথি অনুযায়ী প্রথম ফ্রায়েড রাইস রান্না করা হয় চীনের চিয়াংশু প্রদেশের ইয়াংচৌ শহরে। চীনা শহরটি এখনও তার ফ্রায়েড রাইসের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এমনকি এখনও ফ্রায়েড রাইসের গুণগত মান বিচার কিংবা বিশেষ রেসিপির প্রসঙ্গ এলে উঠে আসে ইয়াংচৌয়ের ফ্রায়েড রাইসের কথা।
সুই রাজবংশের অনেক অনেক দিন পর ১৩৬৮ সালে শুরু হওয়া মিং রাজবংশের সময় মূলত চীনজুড়ে আলাদা একটি ডিশ হিসেবে জনপ্রিয়তা পায় ছাওফান। এর আগ পর্যন্ত ফ্রায়েড রাইস ছিল মূলত বেঁচে যাওয়া ভাতকে কাজে লাগানোর একটা উপায়। অর্থাৎ খাবারের অপচয় বন্ধ করতেই মূলত ফ্রায়েড রাইসের উদ্ভব হয় চীনে। সবজি, মাংস ও সয়া সস দিয়ে ভেজে নিতেই দেখা গেল ওই ভাতের স্বাদ ও পুষ্টিগুণ বেড়ে যায় অনেকটা। আর এ কারণে জনপ্রিয়তা পেতে ফ্রায়েড রাইসকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি।
এর মাঝে চীনের কিছু কিছু প্রদেশে ফ্রায়েড রাইসের রেসিপিতে আসে ভিন্নতা। যেমন ফুচিয়ান প্রদেশে যে ফ্রায়েড রাইসটি জনপ্রিয় হয় সেটার সস হয় বেশ ঘন এবং এতে মাংস ও সবজির সঙ্গে মাশরুমও থাকে। আবার সিছুয়ানের ফ্রায়েড রাইস হয় খানিকটা ঝাল। এতে মেশানো হয় বিশেষ একটি চিলি সস, রসুন, পেঁয়াজের পাতা ও পেঁয়াজ। অন্যদিকে ইয়াংচৌ প্রদেশের আদি অকৃত্রিম ফ্রায়েড রাইসে থাকে বেশি পরিমাণ চিংড়ি, ডিম বারবিকিউ করা মাংস। চীনের রেস্তোরাঁগুলোয় কিন্তু এই ইয়াংচৌ ফ্রায়েড রাইসের চাহিদাই বেশি। এমনকি এটাকে অনেক জায়গায় স্পেশাল ফ্রায়েড রাইস নামেও ডাকা হয়।
অনুষ্ঠানের এই পর্যায়ে চলুন ফ্রায়েড রাইস নিয়ে কিছু তথ্য শোনা যাক শান্তা মারিয়ার কাছ থেকে—
১। দেড় হাজার বছর আগেকার চীনের ফ্রায়েড রাইস আমেরিকায় আসে উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে। ওই সময় ধীরে ধীরে এটি ইউরোপেও জনপ্রিয় হতে থাকে।
২। ফ্রায়েড রাইস তৈরিতে সাধারণত একদিন আগে রান্না করা ভাত ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে ভাত রান্না করে তা ঠান্ডা করে ফ্রিজে রেখে দিতে হয়। তবে আগেকার মতো এখনও অনেকে ফ্রায়েড রাইস তৈরির জন্য ভাত রান্না করে সেটাকে রোদে শুকিয়ে ঝরঝরে করে নেয়।
৩। ফ্রায়েড রাইস রান্নায় কড়াইকে বেশ উত্তপ্ত করে নিতে হয়। এ নিয়ে দ্য জার্নাল অব দ্য রয়েল সোসাইটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, কড়াইকে ১২শ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো উত্তপ্ত করে তৈরি করা যায় নিখুঁত ফ্রায়েড রাইস। অবশ্য, এত উচ্চতাপে খাবারটা পুড়িয়ে ফেলতে না চাইলে, রান্না করতে হবে দক্ষ হাতে।
৪। ২০১৫ সালে ইয়াংচৌতে ৩০০ জন শেফ মিলে একযোগে ৪১৯২ কেজি ইয়াংচৌ ফ্রায়েড রাইস রান্না করে শহরের নাম তুলেছিলেন গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে।
যে ফ্রায়েড রাইস নিয়ে এত কথা শুনছি, সেটার একটা রেসিপি না জানলেই নয়।
1. তিন কাপ বাসমতি চাল ভালো করে ধুয়ে নিয়ে ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন।
2. একটি বড় পাত্রে পরিমাণমতো পানি নিয়ে চাল, তেজপাতা, ২ চা চামচ তেল ও ১ চা চামচ লবণ দিয়ে সিদ্ধ করুন। খেয়াল রাখবেন চাল যেন খুব বেশি নরম না হয়ে যায়। এরপর মাড় ঝরিয়ে বড় একটি পাত্রে চালগুলো ছড়িয়ে শুকিয়ে নিন।
3. ফ্রাইং প্যানে তেল গরম করে এতে ফেটানো ডিম দিয়ে ভেজে নিন।
4. ঘন ঘন নাড়তে থাকবেন, ডিম ঝুরি ঝুরি করে ভেজে আলাদা করে তুলে রাখুন।
5. একটি কড়াইয়ে ৩ চা চামচ তেল গরম করে তাতে তেজপাতা, লবঙ্গ, এলাচ ও দারুচিনি যোগ করে মিনিটখানেক ভাজুন। যোগ করুন এক চা চামচ সয়াসস।
6. এরপর একটি বড় আকারের গাজর কুচি, একটি ক্যাপসিকাম কুচি, সামান্য মটরশুঁটি, বাঁধাকপি, পেঁয়াজ পাতা, বরবটি বা পছন্দের অন্য সবজি এবং কাজুবাদাম, কিসমিস যোগ আরও ৩-৪ মিনিট ভেজে নিন।
7. ভাজা হলে সিদ্ধ করা চাল, লবণ ও চিনি যোগ করে অল্প আঁচে কিছুক্ষণ নেড়ে নিন।
8. এরপর ঘি, গরম মশলা গুঁড়ো ও গোলমরিচ গুঁড়ো যোগ করে আরও কিছুক্ষণ ভেজে নিলেই হয়ে গেল ফ্রায়েড রাইস।
9. সবজির সঙ্গে মাংস কুচি বা চিংড়িও যোগ করতে পারবেন। আবার চাইলে ফ্রিজে রাখা ভাতও ব্যবহার করতে পারেন।
চীনা আবিষ্কার ছাওফান ওরফে ফ্রায়েড রাইসের আছে কিছু স্বাস্থ্যগুণ। এতে নানা ধরনের সবজি ও আমিষ যোগ করা হয় বলে এটি বেশ পুষ্টিকর। নানা ধরনের ভিটামিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর ফ্রায়েড রাইসে আছে শর্করা, যা শরীরে যোগায় শক্তি। আবার হাড়ের স্বাস্থ্য, চোখের স্বাস্থ্য এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বাড়াতেও ভূমিকা রাখে ছাওফান তথা ফ্রায়েড রাইস।
বিভিন্ন গবেষণা জরিপে দেখা গেছে বিশ্বে যত খাবার উৎপাদিত হয়, সেটার ৩ ভাগের এক ভাগই নষ্ট হয়। পরিমাণটা প্রায় ১৩০ কোটি টন। এর মধ্যে বিশাল একটা পরিমাণ দখল করে আছে রান্না করা চাল তথা ভাত। আবার ফেলে দেওয়া এই ভাত থেকে তৈরি হয় মিথেন। যা কিনা বাড়িয়ে দেয় গ্রিনহাউস গ্যাস। দেড় হাজার বছর আগে, রান্না করা চাল যেন নষ্ট না হয় সে ভাবনা থেকেই চীনারা আবিষ্কার করেছিল ফ্রায়েড রাইস। এখন জনসংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে গেলেও বিশ্বের চাষযোগ্য ভূমি কিন্তু বাড়েনি। আর তাই খাবারের অপচয় রোধ করার চিন্তা যারা করছেন, তারা একবার উঁকি দিয়ে দেখতে পারেন ফ্রিজে। আগের দিনের রেখে দেওয়া ভাতটুকু দিয়ে ঝটপট রান্না করে ফেলতে পারেন ছাওফান ওরফে মজাদার ফ্রায়েড রাইস।
গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
অডিও সম্পাদনা: নাজমুল হক রাইয়ান
কণ্ঠ: শান্তা/ফয়সল
সার্বিক তত্ত্বাবধান: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী