বাংলা

মেড ইন চায়না: পর্ব-১৩: বারুদ

CMG2024-08-24 16:33:24

চীনের আছে মহান চারটি আবিষ্কার। এর মধ্যে তিনটি আবিষ্কার হলো কাগজ, উডব্লক প্রিন্টিং ও কম্পাস। এ তিনটি আবিষ্কারের গল্প আমরা মেড ইন চায়নার আগের পর্বগুলোয় জেনেছি। মহান চারটি আবিষ্কারের মধ্যে আরেকটি হলো বারুদ বা গান পাউডার। দেখতে নিরীহ হলেও একটি স্ফূলিঙ্গেই ঘটে যেতে পারে অনেক কিছু। সারা দুনিয়ার হালচাল বদলে দেওয়া এ আবিষ্কারটিও পুরোপুরি মেড ইন চায়না।

বারুদ। শব্দটি শুনলেই যেন কানে ভাসে বিস্ফোরণের শব্দ, যুদ্ধের শব্দ।

তবে ১৪২ সালে চীনের হান রাজবংশের সময় যখন চীনা রসায়নবিদ ওয়েই বোইয়াং প্রথম বারুদ আবিষ্কার করেন, তখন এটাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের চিন্তাভাবনা তিনি করেননি। তিনটি পদার্থকে একত্র করেই তিনি তৈরি করেছিলেন বারুদ। ছানতং ছি নামে বিশ্বের প্রথম লেখা রসায়ন বিজ্ঞানের বইটিতে ওয়েই বোইয়াং ওই বারুদকে উল্লেখ করেছিলেন ‘উড়ন্ত ও নৃত্যরত’ একটি বস্তু হিসেবে। অর্থাৎ বারুদের আবিষ্কারের পর সেটাকে মূলত আতশবাজি হিসেবেই দেখেছিলেন ওই চীনা গবেষক। সেই হিসেবে আতশবাজিও যে চীনেরও আবিষ্কার, সেটাও কিন্তু জানা হয়ে গেল।

তবে সেই গল্পে যাওয়ার আগে জেনে নেওয়া যাক বারুদ আবিষ্কারের নেপথ্যে থাকা একটি মজার ইতিহাস। প্রাচীন চীনের তাওয়িজম মতাদর্শের অনুসারী যে রসায়নবিদরা ছিলেন তাদের কেউ কেউ মরিয়া হয়ে খুঁজছিলেন অমরত্বের ওষুধ। মানে যে ওষুধ খেলে বেঁচে থাকা যাবে দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ। নানা রাসায়নিক নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার পর শেষে তারা হাতে পেলেন পটাশিয়াম নাইট্রেট, সালফার ও কাঠকয়লা। এ তিনটি উপাদানকে নির্দিষ্ট অনুপাতে মেশানোর পর গবেষকরা ধরে নিয়েছিলেন যে তারা অমরত্বের ওষুধ বুঝি হাতের মুঠোয় পেয়েই গেলেন। কিন্তু সেই ওষুধে আগুন লাগাতেই ঘটল বিপত্তি। জ্বলে উঠলো স্ফূলিঙ্গ। তৈরি হলো জ্বলজ্বলে আলো। অর্থাৎ অমরত্ব লাভের ওষুধ বানাতে গিয়ে কিনা তৈরি হয়ে গেল বারুদ।

এরপর তিনশ সালের দিকে চিন রাজবংশের সময় আরেক তাওয়িস্ট দার্শনিক কে হোংয়ের লেখাতেও পাওয়া যায় বারুদ তৈরির আরেক গল্প। বারুদের উপকরণ দিয়ে কে হোং মূলত তৈরি করতে চেয়েছিলেন স্বর্ণ। কারণ গবেষণাগারে একবার স্বর্ণের ফর্মুলা পেয়ে গেলে ধনরত্নের আর অভাব হবে না, এই ভেবে চলছিল জোর গবেষণা।

আর ওই পরীক্ষা চালাতে গিয়েই তিনি আবিষ্কার করেন বারুদের স্ফূলিঙ্গের উজ্জ্বল বেগুনী শিখা। অর্থাৎ এবারও স্বর্ণ বানাতে গিয়ে চীনা বিজ্ঞানী বানিয়ে ফেললেন বারুদ।

এরপর কিন্তু গান পাউডার নিয়েই চলতে থাকে গবেষণা। জাদুকরি এ গুঁড়ো দিয়ে কী কী ঘটানো যায় বা কত সহজে আরও কত শক্তিশালী বারুদ তৈরি করা যায় তা নিয়েই মূলত উঠেপড়ে লাগেন থাং রাজবংশের গবেষকরা। ওই সময়ই আবিষ্কার হয় গান পাউডারের সবচেয়ে কার্যকর ফর্মুলা।

৮০৮ সালে রচিত থাইশাং শেংচু চিনতান মিচুয়ে নামের গ্রন্থে উঠে আসে শক্তিশালী বারুদের কথা। ওই সময় বারুদকে চীনারা নাম দিয়েছিল হুয়োইয়াও বা আগুনের ওষুধ। এখনও কিন্তু চীনে বারুদ বোঝাতে ব্যবহার করা হয় হুয়োইয়াও শব্দটি।

এবার আসা যাক, গান পাউডার ওরফে বারুদের প্রথম পরিপূর্ণ লিখিত ফর্মুলার প্রসঙ্গে। শুরুর দিকে যে ফর্মুলায় বারুদ তৈরি করা হতো তাতে কিছু সমস্যা থেকে যেত। ১০৪৪ সালে চীনে লেখা হয় সমরবিদ্যার একটা ম্যানুয়াল, যার নাম উচিং চোংইয়াও। ওই ম্যানুয়েলেও ছিল বারুদের উপযুক্ত একটা ফর্মুলা। সেটাকেই ধরা হয় বারুদের প্রথম কার্যকর রাসায়নিক সূত্র।

তবে দুর্ভাগ্যক্রমে উচিং চোংইয়াওর ফর্মুলাটি একসময় হারিয়ে যায়। এখন যে ফর্মুলাটি টিকে আছে সেটা লেখা হয় ১৫১০ সালে, মিং রাজবংশের সময়কালে।

খ্রিস্টাব্দ এক হাজার সালের দিকে চীনের প্রশাসন সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল বারুদের ফর্মুলাটিকে গোপন রাখতে। কারণ, তখন অনেকেই বুঝতে পেরেছিলেন এই ফর্মুলা ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বব্যাপী দেখা দিতে পারে অশান্তি। তবে এত বড় একটা আবিষ্কার কি আর সহজে গোপন রাখা যায়। চীনের সঙ্গে যুদ্ধের সুবাদে মঙ্গোলিয়ানরা বারুদ সম্পর্কে জেনে যায়। এরপর ওরাই এর কথা ছড়িয়ে দেয় সবখানে। তারা নিজেরাও এই পাউডার প্রস্তুত করা শিখে ফেলে। পরে সিল্ক রোডের মাধ্যমে ভারতবর্ষসহ অন্যান্য দেশেও পৌঁছে যায় বারুদের ফর্মুলা।

নিজেদের আবিষ্কারের এমন বিস্তৃতি দেখে তৎকালীন চীনের শাসকরাও বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এতে করে তারা বিদেশিদের কাছে বারুদের অন্যতম উপকরণ পটাশিয়াম নাইট্রেটের খনিজ তথা সল্টপিটার বিক্রির ওপর নিষেদ্ধাজ্ঞাও জারি করেন। তাতেও অবশ্য থেমে যায়নি বারুদের প্রসার।

আরব বিশ্বে শাসকরা ১২৪০ থেকে ১২৮০ সালের মধ্যে কোনো এক সময় বারুদ সম্পর্কে জানতে পারেন। সিরিয়ার রসায়নবিদ হাসান আল-রামাহ সল্টপিটার বিশুদ্ধ করার নির্দেশাবলী এবং বারুদ জ্বালানোর বর্ণনা লিখেছিলেন। গবেষক আল-রামাহ তার লেখায় সল্টপিটারকে বলেছিলেন ‘চীনা তুষার’ এবং বারুদ দিয়ে তৈরি আতশবাজিকে বলেছিলেন ‘চীনা ফুল’।

ইউরোপে বারুদ আসে আরও অনেক পরে। কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন, মঙ্গোলিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ থেকে ইউরোপ বারুদ তৈরি করা শিখেছে।

এবার যথারীতি আমরা শুনবো বারুদ নিয়ে অন্যরকম কিছু তথ্য

অষ্টম শতকের দিকে চীনে বারুদ দিয়ে ত্বকের চিকিৎসাও করা হতো। ত্বকে পোকা-মাকড়ের কামড় বা ব্যাকটেরিয়ার কারণে সৃষ্ট ক্ষতের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হতো গান পাউডার।

কথিত আছে যে চীন যুদ্ধে বারুদের প্রথম ব্যবহার করেছিল ৯১৯ সালে। আবার ১০০০ সালের দিকে থাং ফু নামের এক চীনা যোদ্ধা নাকি প্রথম গানপাউডার বম্ব বা বারুদের বোমা আবিষ্কার করেছিলেন।

অনেকে বিশ্বাস করেন যে অনুসন্ধানকারী মার্কো পোলো প্রাচীন সিল্ক রোডের মাধ্যমে ইউরোপে চীনা গানপাউডার প্রবর্তন করেছিলেন। ঠিক এর পরের কয়েক বছরের মধ্যেই ঢাল-তলোয়ার যুগের ইতি ঘটে ইউরোপে।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বারুদই ছিল একমাত্র রাসায়নিক, যেটাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো। গানপাউডারের পর আসে ধোঁয়াহীন আরেক ধরনের বারুদ।

এবার জানা যাক বারুদের কিছু অন্যরকম ব্যবহারের কথা

চীনের আবিষ্কার বারুদকে কেবল ধ্বংসাত্মক ভাবলেই চলবে না। প্রতিটি আবিষ্কারের ভালো-মন্দ ব্যবহার রয়েছে। যেমন বারুদের একটা বড় কাজ আছে খনিতে। খনির পাথুরে দেয়ালে ফাটল তৈরি করতে এখনও ব্যবহৃত হয় বারুদ। একইভাবে টানেল তৈরিতেও কাজে লাগে বারুদের শক্তি। বিশ্বজুড়ে নানা ধরনের উৎসব উদযাপনেও পোড়ানো হয় বারুদের তৈরি অগণিত আতশবাজি। যে আলো ঝলকানো বাতিটা ছাড়া জন্মদিনের কেক অসম্পূর্ণ থেকে যায়, সেখানেও আছে বারুদের কারসাজি। এমনকি সাগর, মরুভূমি বা জঙ্গলে কেউ বিপদে পড়লে আকাশের দিকে তাক করে যে সিগনাল ফ্লেয়ার ছোড়া হয়, সেটা বানাতেও লাগে বারুদ।

এ ধরনের নানা কাজে বিশ্বজুড়ে রয়েছে বারুদের বেশ ভালো চাহিদা। আর সেই চাহিদারও সিংহভাগ ‍পূরণ করে চলেছে চীন। বিশেষ করে আতশবাজি রপ্তানিতে এক নম্বরেই আছে দেশটি। এক হিসাবে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসের দিন সেখানে সবচেয়ে বেশি আতশবাজি পোড়ানো হয়। আর সেই আতশবাজির ৯৯ ভাগই আসে চীন থেকে।

গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: ফয়সল আবদুল্লাহ

অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ

সার্বিক তত্ত্বাবধান: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী

Close
Messenger Pinterest LinkedIn