মেড ইন চায়না: পর্ব-১০: চপস্টিক
হাজার বছর আগের কাগজ, চা এবং নুডলস থেকে শুরু করে আজকের প্যাসেঞ্জার ড্রোন, কিংবা নতুন জ্বালানির গাড়ি। সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বসভ্যতা এগিয়ে চলেছে চীনের শক্তিশালী আবিষ্কারের হাত ধরে। নানা সময়ে দারুণ সব আবিষ্কার করে আধুনিক সভ্যতার ভিত গড়ে দিয়েছে চীন। আর সেই সব আবিষ্কার নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন মেড ইন চায়না।
মেড ইন চায়নার দশম পর্বে সাথে আছি আমি ফয়সল আবদুল্লাহ...আজকের পর্বে থাকছে চীনের আবিষ্কার চপস্টিকের কথা।
সবজি বা মাছ মাংস কাটার জন্য দরকার হয় ধারাল সব বস্তুর। কিন্তু মজার সব খাবার খেতে বসেও যদি চোখের সামনে সেই সব ছুরি, কাঁচি বা কাঁটাচামচ দেখা যায় তাতে খাওয়ার আনন্দটা মাটি হয়ে যেতেই পারে। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে এমনটাই ভেবেছিলেন চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস। তিনি বলেছিলেন, ছুরি কাঁটাচামচের তীক্ষ্ম প্রান্তযুক্ত এসব বস্তুকে বলা যায় শীতল অস্ত্র, যেগুলো আমাদের মনের ভেতর সহিংস ঘটনার স্মৃতি বা এ ধরনের অনুভূতিকে উসকে দেয়। সুতরাং খাবার টেবিলে এসব ছুরি না থাকাই মঙ্গলজনক। সেই ভাবনা থেকেই মূলত কাঠি দিয়ে খাওয়ার চল চালু হয় চীনে। চীনা ভাষায় যাকে বলে খোয়াই জি আর ইংরেজিতে চপস্টিক। চপস্টিকের জনপ্রিয়তার পেছনে কনফুসিয়াসের বড় ভূমিকা থাকলেও চীনে এর ব্যবহার চালু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। আর এখন বিশ্বের তিন ভাগের এক ভাগ মানুষই ব্যবহার করছে এটি।
এখন পর্যন্ত চীনে আবিষ্কৃত সবচেয়ে পুরনো চপস্টিকগুলোর মধ্যে আছে ছয়টি চপস্টিক। ব্রোঞ্জের তৈরি চপস্টিকগুলো ১০ ইঞ্চি লম্বা। চীনে হ্যনান প্রদেশের এর কাছে একটি ধ্বংসাবশেষ খনন করে এগুলো পাওয়া গিয়েছিল। এগুলো ছিল প্রায় তিন হাজার দুইশ বছর আগেকার শাং রাজবংশের সময়কার। তখন চপস্টিক ব্যবহার করা হতো মূলত রান্নার কাজে।
নুডলসের মতো কিছু খাবার চপস্টিক দিয়ে খাওয়া সহজ বলে চীন থেকে এটি দ্রুত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাকি দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে।
চপস্টিকে খাওয়া কিন্তু সহজ কাজ নয়। এটির ব্যবহার শিখতে হয়। তাই প্রশ্ন হলো, বিশ্বের তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ প্রতিদিন চপস্টিক ব্যবহার করছে কেন? এর কিছু কারণ তো নিশ্চয়ই আছে।
চীনে চপস্টিককে বিবেচনা করা হয় খাবার পরিবেশন ও খাওয়ার গ্রহণের মধ্যে ভদ্রতা ও নম্রতার বহিঃপ্রকাশ করার প্রতীক হিসেবে। আবার কনফুসিয়াস যেহেতু এই চপস্টিকের প্রসারে বেশ নিবেদিত ছিলেন, তাই কনফুসিয়াসিজমের সঙ্গে নিজের একাত্মতা প্রকাশের মাধ্যমও এই চপস্টিক।
তবে কেউ কেউ আবার বলছেন ভিন্ন কিছু কারণের কথা। প্রতিবার চপস্টিক ব্যবহারে আঙ্গুল, কব্জি, বাহু এবং কাঁধসহ শরীরের প্রায় ৫০টি পেশী ও জয়েন্টকে নাড়াতে হয়। এতে করে খেতে খেতেই হয়ে যাবে ব্যায়াম। গবেষণায় এও দেখা গেছে নিয়মিত চপস্টিক ব্যবহার করলে হাতের অস্টিওআর্থারাইটিসের ঝুঁকি অনেকটাই কমে আসে।
অনুষ্ঠানের এই ফাঁকে জেনে নেওয়া যেতে পারে চপস্টিক কী করে ব্যবহার করতে হয় সে তথ্য
প্রথমে একটি চপস্টিককে রাখুন বুড়ো আঙুল ও তর্জনির মাঝে। সেটাকে সাপোর্ট দিতে হবে মধ্যমা আঙুল দিয়ে।
এরপর দ্বিতীয় চপস্টিকটি ধরুন অনেকটা পেনসিল ধরার মতো করে। আর সেটাকে নাড়াতে হবে বুড়ো আঙুল ও তর্জনী দিয়ে। দুটো চপস্টিক একই লেভেল তথা একই স্তরে আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখুন। যদি একই স্তরে না থাকে তবে খাবারের পাত্রে বা টেবিলে চেপে ধরে কাঠি দুটোকে এক স্তরে নিয়ে আসুন।
খাবার তোলার সময় চপস্টিককে ৪৫ ডিগ্রি কোণ করে বা যতটা সম্ভব খাবারের প্লেটের সমান্তরালে ওঠাতে হবে। এতে করে কাঠি থেকে খাবার পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে কম।
নুডলস বা মাঝারি টুকরো জাতীয় খাবার চপস্টিক দিয়ে খাওয়া সহজ হলেও ভাত বা ফ্রায়েড রাইস খাওয়াটা একটু কঠিন বটে। এসব খাবারে চপস্টিক ব্যবহার করতে গেলে খাবারের পাত্রটাকে এক হাতে খানিকটা উঁচু করে মুখের কাছে তুলে ধরতে হয়।
চপস্টিক নিয়ে মজার কিছু তথ্য শোনা যাক এবার
প্রাচীন চীনা রাজবংশের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা রূপার তৈরি চপস্টিক ব্যবহার করতেন নিরাপত্তার খাতিরে। কারণ খাবারে সালফার ভিত্তিক কোনো বিষ মেশানো থাকলে তা রূপার তৈরি চপস্টিকের রং কালো করে দেবে।
চপস্টিক আছে চার ধরনের। চীনারা বৃত্তাকার বা ভোঁতা প্রান্তসহ দীর্ঘ দৈর্ঘ্যের চপস্টিক ব্যবহার করে। জাপানিরা করে খাটো আকৃতির। কোরিয়ানরা ধাতু, প্লাস্টিক বা কাঠ থেকে তৈরি খাটো ও কিছুটা ভোঁতা কাঠি ব্যবহার করে। আর, ভিয়েতনামের লোকেরা ব্যবহার করে লম্বা কাঠের কাঠি।
ঐতিহ্যগতভাবে কাঠ, বাঁশ, নানা ধরনের ধাতু, হাতির দাঁত এবং সিরামিক দিয়ে তৈরি করা হয় চপস্টিক। তবে এখন কাঠের তৈরি ওয়ানটাইম চপস্টিকের ব্যবহার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এ ধরনের চপস্টিক চীনে প্রতিবছর ব্যবহৃত হচ্ছে ৫০ বিলিয়নেরও বেশি। যা বানাতে কাটতে হচ্ছে প্রচুর সংখ্যক গাছ। আর তাই চীন সরকার দেশের জনগণকে নন-ডিসপোজেবল চপস্টিক ব্যবহারে উৎসাহ দিয়ে চলেছে। যাতে করে এক জোড়া চপস্টিক দিয়ে খাওয়া যায় বহু দিন।
এবার জেনে নেওয়া যাক চপস্টিক ব্যবহারের কিছু আদব কায়দা
চপস্টিক খাবারের পাত্রে গেঁথে রাখা যাবে না। খাবারের মধ্যে খাড়া করে চপস্টিক গেঁথে রাখা হয় শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে।
নিজের চপস্টিক দিয়ে সম্মিলিত খাবারের পাত্রে ব্যবহার করা যাবে না। খাবার তুলে নেওয়ার জন্য আলাদা সার্ভিং চামচ বা চপস্টিক রাখা হয়।
চপস্টিক দিয়ে অযথা খাবারে খোঁচাখুঁচি করা যাবে না। একে তুলনা করা হয় গ্রেভ ডিগিং তথা সমাধি খোঁড়াখুড়ির সঙ্গে।
চপস্টিক দিয়ে খাবারের পাত্রে শব্দ করা যাবে না। চীনে এ কাজটা করতে দেখা যায় ভিক্ষুকদের।
ঠিক যে কারণে কারও দিক ছুরি বা কাঁটাচামচ উঁচিয়ে কথা বলা উচিত নয়, ঠিক একই কারণে কারও দিকে চপস্টিক তাক করাও ঠিক নয়। এটি রীতিমতো অভদ্রতার পর্যায়ে পড়ে।
খাওয়া শেষ হলে নিয়ম হলো চপস্টিকের সূঁচাল অংশটিকে বাম দিকে রেখে কাঠিগুলো টেবিলের সঙ্গে সমান্তরাল করে রাখা।
খাওয়ার সময় খেলাচ্ছলে চপস্টিক এদিক সেদিক ঘোরানোটাও এক ধরনের অসৌজন্যতা।
চপস্টিকের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে চীনে। বছরে প্রায় ৮ হাজার কোটি চপস্টিক তৈরি করছে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে ৩ হাজার কোটি চপস্টিক রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। এ বিপুল পরিমাণ চপস্টিক তৈরিতে প্রয়োজন হয় অনেক অনেক গাছের। আর তাই এ ধরনের ডিসপোজেবল চপস্টিকের ব্যবহার কমাতে ২০০৬ সাল থেকেই ওয়ানটাইম চপস্টিকের ওপর ৫ শতাংশ করারোপ করে চীন সরকার।
তবে আর যাই হোক, চপস্টিক কিন্তু এখন শুধু খাওয়ার একটি অনুষঙ্গ নয়। এটাকে স্রেফ চামচের বিকল্প ভাবলে ভুল হবে। কারণ চপস্টিকের রয়েছে হাজার বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাস। এ দীর্ঘ সময়ে চপস্টিকের গঠন বদলে যায়নি একটুও। তাই চপস্টিক দিয়ে খাওয়ার মানে হলো সুপ্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজের একাত্মতা ঘোষণা করা।
আজকের মেড ইন চায়না এ পর্যন্তই। আগামী সপ্তাহে আবার আসবো চীনের সাড়া জাগানো আরেকটি আবিষ্কার নিয়ে। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।
গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: ফয়সল আবদুল্লাহ
অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ
সার্বিক তত্ত্বাবধান: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী