দেহঘড়ি পর্ব-০০৫
‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং চীনা জীবনধারা নিয়ে পরামর্শ ‘হেলথ টিপস’।
#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা
পিত্তথলির পাথর দূর করতে টিসিএম
গলব্লাডার বা পিত্তথলিতে পাথর অনেকেরই হতে পারে। যেসব কারণে পেটে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়, সেগুলোর অন্যতম পিত্তথলির পাথর। প্রতি বছর কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ৫ লাখের বেশি অস্ত্রপচার হয় শুধু পিত্তথলির পাথর অপসারণে। পিত্তনালীতে পাথর নড়াচড়ার কারণে সৃষ্টি তীব্র পেটে ব্যথা, পিত্ত প্রবাহের বাধার কারণে যকৃত ও অগ্ন্যাশয়ের সম্ভাব্য ক্ষতি এবং পিত্তথলির প্রদাহসহ বিভিন্ন সমস্যা প্রতিরোধে অস্ত্রোপচার করা হয়।
পশ্চিমা চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিশ্বাস করা হয়, পিত্তথলিতে কোলেস্টেরল ও অন্যান্য পদার্থ জমার কারণে গলস্টোন তৈরি হয়, যা আস্তে আস্তে কঠিন হতে থাকে। এ চিকিৎসা ব্যবস্থায় আরও মনে করা হয়, পিত্তথলির পাথরে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কোনো উপসর্গ না থাকলে তাদের কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না, তবে যাদের উপসর্গ থাকে তাদের পিত্তথলি অপসারণের জন্য অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়।
তবে ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থা বা টিসিএমে মনে করা হয়, মানসিক চাপের কারণে যকৃত ও পিত্তথলিতে মূল শক্তি বা ‘ছি’র ভারসাম্য তৈরি হয়। এই ভারসাম্য থেকে সৃষ্ট ক্লেদ, তাপ বা কফের কারণে পাথর হয়। অস্বাস্থ্যকর বা অপরিচ্ছন্ন খাবার কিংবা অত্যধিক ভিটামিনযুক্ত খাবারের সঙ্গে ঝিনুক ও বালিযুক্ত খাবারের সংমিশ্রণেও পিত্তথলিতে পাথর তৈরি হতে পারে। এছাড়া, রাগ ও চরম ক্ষুধার কারণে পরজীবীদের নড়াচড়া কিংবা তীব্র আবহাওয়ার কারণে রক্ত প্রবাহে সৃষ্ট ভারসাম্যহীনতার ফলেও পিত্তথলিতে ব্যথা হতে পারে।
লক্ষণ
ব্যক্তি ভেদে গলস্টোনের উপসর্গ ভিন্ন হতে পারে। তবে সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:
• পেটের উপরের ডান চতুর্ভুজাটিতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হওয়া। এ ব্যথা নিরবিচ্ছিন হতে পারে কিংবা গিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে।
• বমি বমি ভাব কিংবা বমি হওয়া, জ্বর ও ঠান্ডা ঘাম দেখা দেওয়া, অঙ্গ শীতল হওয়া, জন্ডিসের লক্ষণ দেখা দেওয়া, প্রস্রাব ও ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া এবং কোষ্ঠকাঠিন্য ও তীব্র পেটে ব্যথা হওয়া, যা ৬ ঘন্টার বেশি স্থায়ী হতে পারে।
• ডান স্ক্যাপুলার অঞ্চল বা কাঁধের অস্থিতে ব্যথা ছড়িয়ে পড়া
• পিত্তথলি সংবেদনশীল হয়ে ওঠা
• খাবার গ্রহণের পর পেটে ব্যথা বৃদ্ধি পাওয়া
• নিরবিচ্ছিন্ন তীব্র ব্যথা হওয়া, যা ১৫ মিনিট থেকে ৬ ঘন্টা স্থায়ী হতে পারে।
চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
পিত্তথলির পাথরে দূর করা বা প্রতিরোধ করার জন্য টিসিএমে জন্য বেশ কিছু ভেষজ সুপারিশ করা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে লাইসিমাচিয়া, বাইক্যাল স্কালকাপ শিকড়, ডেইজি ফুল, কমলার খোসা, হানিসাকল ফুল, রুবার্ব রুট বা মূলাজাতীয় সবজি।
টিসিএমে মনে করা হয়, যকৃত ও পিত্তথলির মূল শক্তি ‘ছি’ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এসব ভেষজ পিত্তপ্রবাহ ও রক্তপ্রবাহে ভারমাস্য আনে। যার ফলে একদিকে পেটের ব্যথা উপশম হয় এবং অন্যদিকে পিত্তথলির পাথর জমা প্রতিরোধ হয়। এছাড়া এসব ভেষজ পিত্তথলির ‘ছি’র ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টিকারী তাপ ও ক্লেদ দূর করে।
ডায়েটের মাধ্যমে প্রতিরোধ
• আপনার শরীর সুস্থ রাখতে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করতে প্রতিদিন ব্যায়াম করুন, নিয়মিত সুষম খাবার খান। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়লে, তা প্রকারান্তরে পিত্তথলিতে পাথর জমা প্রতিরোধ করবে।
• চকলেট, রান্না না করা অর্থাৎ কাঁচা খাবার, চর্বিযুক্ত ও অধিক মশলাদার খাবার এবং ঝিনুকের মতো সামুদ্রিক খাবার এড়িয়ে চলুন।
• ধূমপান, সিন্থেটিক ভিটামিন, অ্যালকোহল, কফি এবং উচ্চ মাত্রা খনিজ পদার্থ থাকে এমন কোমল পানীয় পরিহার করুন।
#চিকিৎসার_খোঁজ
চীন-জাপান মৈত্রী হাসপাতাল
চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের শীর্ষ হাসপাতালগুলোর একটি চীন-জাপান মৈত্রী হাসপাতাল। সংক্ষেপে এই হাসপাতালকে চীন-জাপান হাসপাতালও বলা হয়। প্রতিবেশী এ দু’দেশের সরকারের সহযোগিতার মাধ্যমে গত শতাব্দির আশির দশকে এ চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে চালু হয়। বেইজিংয়ের ছাওইয়াং জেলায় অবস্থিত এ হাসপাতালটি সরাসরি চীনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়।
দেড় হাজার শয্যার হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২৪ একর জায়গা জুড়ে। এখানে রয়েছে ৫৮টি বিভাগ এবং একটি ক্লিনিকাল গবেষণা ও শিক্ষা কেন্দ্র। হাসপাতালটির অন্যতম বৈশিষ্ট হলো এখানে অসাধারণ সম্মিলন ঘটেছে পূর্ব ও পশ্চিমা চিকিৎসাব্যবস্থার। শতাধিক দেশ ও অঞ্চলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরকে নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার অন্যন্য মাইলফলক অর্জন করেছে এ প্রতিষ্ঠানটি।
বেইজিং ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল স্কুল, বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন, চায়না মেডিকেল ইউনিভার্সিটি এবং থিয়ানচিন মেডিকেল ইউনিভার্সিটিসহ বেশ কয়েকটি চিকিৎসাশিক্ষা প্রতিষ্ঠান যুক্ত চীন-জাপান মৈত্রী হাসপাতালের সঙ্গে। চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পাশাপাশি এ হাসপাতাল খ্যতি অর্জন করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসাবেও।
চীন-জাপান হাসপাতালকে ১৯৯৩ সালে একটি সর্বোচ্চ-স্তরের টারশিয়ারি হাসপাতাল হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এটি বেইজিংয়ের শীর্ষ ১০টি হাসপাতাল এবং চীনের শীর্ষ ১০০ হাসপাতালের একটি। ২০০১ সালে এ হাসপাতালটি কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্যসেবা হাসপাতালগুলোর একটি হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়। এটি পিকিং ইউনিভার্সিটি এবং বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব চাইনিজ মেডিসিনের ইন্টার্নদের জন্য শিক্ষা-হাসপাতাল হিসেবেও কাজ করে।
চীনের অ্যাসোসিয়েশন ফর ফরেনার্স এ হাসপাতালটিকে "বেইজিংয়ে বিদেশীদের জন্য সেরা হাসপাতাল" হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাপান ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সাথে বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালিত হয় এখানে।
এ হাসপাতালে কর্মরত সাড়ে ৪শ জনের বেশী দক্ষ কর্মী, যাদের মধ্যে প্রায় ৪শ’ জনের রয়েছে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি বা উচ্চতর স্তরের শিক্ষা। এখানকার চিকিৎসা সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে এমআরআই, স্পাইরাল সিটি, ডিএসএ, এমএলএ, কালার ডপলার, অপারেশন পাইলট সিস্টেম এবং স্বয়ংক্রিয় বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার।
প্রায় সব ধরনের চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয় এ হাসপাতালে। এখানকার বিভাগগুলোর মধ্যে রয়েছে আকুপাংচার, কার্ডিওলজি, কার্ডিওভাসকুলার সার্জারি, কোলোরেক্টাল সার্জারি, ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরি, ডায়াবেটিস, এন্ডোক্রানোলজি, চর্মরোগবিদ্যা, দন্ত চিকিৎসা ও অর্থোডন্টিক্স, পরিপাক, ক্যান্সার, শিশুরোগ, মনোরোগ, বক্ষব্যাধি, থোরাসিক সার্জারি, ইউরোলজি, নাক-কান-গলা, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, সাধারণ শল্য চিকিৎসা, স্ত্রীরোগবিদ্যা, রোগতত্ত্ববিদ্যা, সংক্রামক রোগ, ফুসফুস ও প্লীহা, ম্যাসেজ, নিউরোলজি, নেফ্রোলজি, নিউরোসার্জারি, অর্থোপেডিকস, স্ত্রীরোগবিদ্যা, চক্ষুরোগবিদ্যা ও আল্ট্রাসাউন্ড।
হেলথ টিপস
এটা সর্বজনবিদিত যে, চীনা জীবনযাপন পদ্ধতি অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর। আপনি যদি চীনাদের মতো একটি সুস্থ জীবন যাপন করতে চান তাহলে মেনে চলতে পারেন তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি-সম্পর্কিত পরামর্শ।
নিয়মিত চা খান
চীনা জীবনযাত্রা পদ্ধতিতে বিভিন্ন ভেষজ চায়ের মতো করে খাওয়া হয়; মনে করা হয়, এসব ভেষজ শারীরিক সুস্থতা রক্ষা এবং রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে।
একেক ভেষজের একেক ধরনের উপকারিত রয়েছে। শরীর ও মনের সুস্থতায় কোন কোনটিকে আলাদাভাবে বা কোন কোনটিকে একসাথে ব্যবহার করা হয়। যেমন হজম প্রক্রিয়াকে ঠিক রাখতে আদা বা পিপারমিন্টের চা এবং এবং ভারসাম্যপূর্ণ রক্ত সঞ্চালনের জন্য দারুচিনির চা খাওয়া হয়।
টিসিএমে চাকে দুই ভাগে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে -- ‘উষ্ণ’ ও ‘শীতল’। যেমন সবুজ ও সাদা চাকে শীতল হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং এগুলো বসন্ত ও গ্রীষ্মের মাসগুলোর জন্য আদর্শ। অন্যদিকে, কালো চা ও ওলং চাকে উষ্ণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। উষ্ণ চা শীতের মাসগুলোর জন্য বেশি উপযুক্ত। কোনভাবে খাওয়া হচ্ছে অর্থাৎ গরম পানিতে খাওয়া হচ্ছে না কি বরফজলে খাওয়া হচ্ছে তাতে চায়ের এই উষ্ণ বা শীতল বৈশিষ্টের কোনও পরিবর্তন হয় না। সঠিক মৌসুমে সঠিক চা গ্রহণ শরীরের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য আনতেও সাহায্য করতে পারে।
‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।