বাংলা

কেনিয়ায় অবকাঠামো নির্মাণে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা

CMGPublished: 2024-03-11 09:49:19
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

২০১৫ সালের ডিসেম্বরে চীন-আফ্রিকা সহযোগিতা ফোরামের জোহানেসবার্গ শীর্ষসম্মেলনে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং চীন-আফ্রিকা নতুন কৌশলগত অংশীদারিত্বের সম্পর্ককে সার্বিক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বের সম্পর্কে উন্নীত করার কথা ঘোষণা করেন। তখন থেকেই চীন আফ্রিকার সঙ্গে শিল্পায়ন, কৃষির আধুনিকায়ন, অবকাঠামো, ব্যাংকিং, সবুজায়ন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, দারিদ্র্যবিমোচন, জনস্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, শান্তি ও নিরাপত্তা—এই দশটি ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। চীন আফ্রিকার সঙ্গে বাস্তব সহযোগিতার একটি বড় সবুজ নকশা গড়ে তোলে।

গত মে মাসে কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুর কেনিয়াত্তা এক ভাষণে পুনরায় কম খরচে আবাসনের কথা বলেন। তিনি বলেন, 'আমরা আশা করি, কর্মসংস্থান ও আয় ব্যাপক বৃদ্ধির পাশাপাশি আমাদের স্বল্প মূল্যের আবাসন নির্মাণের সামর্থ্য বাড়বে। আমার স্বপ্ন হল, অদূর ভবিষ্যতে কেনিয়ায় মধ্যম আয়ের সকল মানুষের জন্য উপযুক্ত আবাসন-সুবিধা সরবরাহ করা।'

স্বল্প মূল্যের আবাসন নির্মাণ ২০১৭ সালে কেনিয়াত্তার উত্থাপিত কেনিয়ার জাতীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক চারটি উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার একটি। তাঁর পরিকল্পনা মোতাবেক, ২০২২ সালের মধ্যে কেনিয়ায় ৫ লাখ স্বল্প মূল্যের গৃহ নির্মিত হবে।

২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কেনিয়ায় প্রতিবছর আবাসিক গৃহ নির্মাণের সংখ্যা ৫০ হাজারেরও কম। দেশটিতে ২০ লক্ষাধিক গৃহের ঘাটতি। কেনিয়ার প্রায় ৬১ শতাংশ শহুরে নাগরিক-পরিবার বস্তিতে বাস করে। কেনিয়ায় শহরাঞ্চলের আয়তন মাত্র ৪.৪ শতাংশ। প্রতিবছর শহরে নাগরিকের সংখ্যা বৃদ্ধি হয় ৫ লাখ করে। প্রশ্ন হচ্ছে: কিভাবে গৃহের অভাব দূর হবে এবং গৃহনির্মাণ ব্যয় কমিয়ে আনা যাবে? কিভাবে পরিবেশবান্ধব ও মূল্য-সাশ্রয়ী গৃহ নির্মাণ করা সম্ভব? এ-প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে শুধু যে কেনিয়ার নাগরিকরা ও নেতারা হয়রান হয়েছে, তা নয়; বরং সেদেশে গৃহনির্মাণে অংশগ্রহণকারী চীনা শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোকেও যথেষ্ট মাথা ঘামাতে হয়েছে।

পরিদর্শন ও তদন্তের মাধ্যমে চীনের উই শিল্পায়ন কোম্পানি লিমিটেডের স্থায়ী উপ-ব্যবস্থাপক লিন ই হুয়া বুঝতে পারেন যে, কেনিয়ায় শহরায়নে অনুসৃত ঐতিহ্যগত পদ্ধতির অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ-সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আমরা নাইরোবি, মোম্বাসা ও এলডোরেট পরিদর্শন করেছি। এসব শহরের পথ সংকীর্ণ। সেজন্য সেখানে নির্মাণ-উপকরণ ও যন্ত্রপাতি রাখার জায়গা নেই বা থাকলেও তা খুবই অপ্রতুল। এ ছাড়া, এখানে নির্মাণকাজে দূষণও সৃষ্টি হয়।'

এ পরিস্থিতিতে চীনের উই কোম্পানির কেনিয়া আবাসিকভবন নির্মাণের অধিকাংশ কাজ কারখানায় সম্পন্ন করার ধারণা ব্যবহার করে। ২০১৬ সালে কোম্পানিটি নাইরোবিতে ১০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে নির্মাণ শিল্পায়ন গবেষণা ও উন্নয়ন উত্পাদনকেন্দ্র এবং গুদাম নির্মাণ উপকরণ সুপারমার্কেট নির্মাণ করে। কেন্দ্রটি মোট ২৯.৬ একর এলাকাজুড়ে স্থাপিত হয়। কারখানার আয়তন ১৮.২ লাখ বর্গমিটার।

লিন ই হুয়া বলেন, ঐতিহ্যগত পদ্ধতির চেয়ে আমাদের নির্মাণ-পদ্ধতির অনেক সুবিধা রয়েছে। বিশেষ করে, জ্বালানিসম্পদ সাশ্রয়ের ক্ষেত্রে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আমরা গৃহ-কাঠামোর বেশিরভাগ কারখানায় উত্পাদন করি। তারপর নির্মাণস্থলে তা পরিবহন করি। এর ফলে রাস্তার বা রাস্তার পাশের ভূমি ব্যবহারের হার অনেক কমেছে। আগের তুলনায় যা এক থেকে পাঁচ শতাংশ। আমাদের কারখানায় দূষিত পানি পরিশোধণের ব্যবস্থাও রয়েছে।'

চীনা কোম্পানি যে শুধু উপাদান ব্যবহারের ক্ষেত্রে সক্ষমতা বাড়িয়েছে, তা নয়; স্থাপত্যের মানও উন্নত করেছে। এ সম্পর্কে লিন ই হুয়া বলেন, 'আগে এখানে কাঠের ছাঁচ ব্যবহার করা হতো, যা তেমন একটা ভালো নয়। কিন্তু বর্তমান আমাদের ইস্পাতের ছাঁচে সে-সমস্যা নেই। সেজন্য বর্তমানে নির্মিত স্থাপত্যগুলোর মান ভালো হচ্ছে।'

লি ই হুয়া বলেন, বর্তমানে কেনিয়ায় আবাসিক ঘর ও অন্যান্য বেসামরিক স্থাপত্যের চাহিদা বেশি, কিন্তু সরবরাহ অনেক কম। কারখানায় নির্মিত ভবনের জন্য খরচ কম লাগে এবং সময়ও বাঁচে। সেজন্য তা স্থানীয় প্রয়োজন পূরণ করেছে। তিনি উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন তার কোম্পানি কর্তৃক নির্মিত কেনিয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভবনের কথা। তিনি বলেন, 'আমরা যে-পদ্ধতিতে আবাসিকভবন নির্মাণ করছি তাতে তিন ভাগের এক ভাগ সময় সাশ্রয় হচ্ছে। অন্য কথায়, আরও কম সময়ে একই ধরনের আবাসিকভবন নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে। এতে কেনিয়া সরকার দ্রুততম সময়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারছে। এক্ষেত্রে আমাদের আনুমানিক খরচ ও কেনিয়ার প্রস্তাবিত খরচ প্রায় এক।'

চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্ব উত্পাদন-পদ্ধতি কেনিয়ায় নিয়ে গেছে এবং স্থানীয় জনগণ তা শিখছে। এর মাধ্যমে কেনিয়ার উন্নয়নের নিজস্ব সামর্থ্য ক্রমশ বাড়ছে। এ সম্পর্কে লি উ হুয়া বলেন, 'কেনিয়ার আবাসিকভবন বাজারে আমাদের বিনিয়োগের উদ্দেশ্য হচ্ছে: স্থানীয় প্রযুক্তিকে উন্নত করা, স্থানীয় কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, এবং চীনের শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি 'এক অঞ্চল, এক পথ' উদ্যোগের আওতায় কেনিয়ায় সরবরাহ করা। এ পর্যন্ত আমাদের উত্পাদন-কেন্দ্রগুলোতে প্রযুক্তি খাতে স্থায়ী কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় দুই শ। পরিকল্পনা অনুসারে, কেনিয়ায় আমরা এ খাতে প্রায় ২৫০০টি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারবো।'

পেপিলা এডউইন হলেন নাইভাশার একজন উদ্যানরক্ষক। ২০১৪ সালে তিনি উ ই কোম্পানিতে কাঠের কাজ শিখেছেন। বর্তমানে তিনি গবেষণা ও উত্পাদনকেন্দ্রের একটি গ্রুপের প্রধান। তিনি মনে করেন, চীনের উ ই কোম্পানি তাঁর কর্মদক্ষতা বাড়িয়েছে। তিনি বলেন, 'এখানে কাজ করা আমার সামর্থ্য উন্নয়নের জন্য অনেক সহায়ক। প্রথমে আমি কিছু সহজ কাজ করতাম। পরে আমি কাঠের কাজ শিখেছি। এখন আমি এ গ্রুপের প্রধানে পরিণত হয়েছি। আমার জীবন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখানে কাজ করার আগে আমার কোনো চাষক্ষেত্র ছিল না। কিন্তু এখন আমি বিয়ে করেছি এবং নতুন গৃহ নির্মাণ করেছি। কাঠের কাজ শেখার পর আমি নিজে নিজেই কাঠের আসবাবপত্র তৈরি করতে পারি। আমি এখন নিজের গাড়ি কিনতে চাই।'

স্থানীয় নাগরিকদের সঙ্গে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পর্কও অনেক ঘনিষ্ঠ। এ সম্পর্কে লিন ই হুয়া বলেন: 'কেনিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে আমরা স্থানীয় নাগরিকদের জন্য পুকুর তৈরি করে দিয়েছি। সেখানে একটা স্কুলও নির্মাণ করি আমরা। দুর্যোগের সময়ে আমরা স্থানীয় নাগরিকদেরকে খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করতাম। আমরা কেনিয়ায় সামাজিক দায়িত্বও পালন করে থাকি। আমাদের ৯০ শতাংশ কর্মী হল স্থানীয় নাগরিক।'

কেনিয়ার রিয়েল এস্টেট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রেসিডেন্ট কেনিয়াত্তার 'স্বল্প মূল্যের আবাসিকভন নির্মাণ প্রকল্প'-এর ফলে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা চলতি বছর আরও চাঙ্গা হবে। চীনের উ ই কোম্পানির কেনিয়া শাখার চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)-এর কমিটির সম্পাদক ওয়াং শু ওয়েন বলেন, দু'দেশ গৃহ নির্মাণ খাতে সহযোগিতা জোরদার করবে। তিনি বলেন, 'আমরা চীনের শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি কেনিয়ায় এনেছি। আমরা এক্ষেত্রে কেনিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা জোরদার করতে চাই এবং পারস্পরিক অভিন্ন কল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করতে আগ্রহী। আমরা আশা করি, কেনিয়ার আবাসিকভবন নির্মাণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমরা সফল হবো।'

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn