বাংলা

চীনে আর্থিক লেনদেনে নোট ব্যবহারের দিন কি শেষের পথে? অথবা হাসিতেই মূল্য পরিশোধ?

CMGPublished: 2022-08-03 15:48:48
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

প্রযুক্তি চীনকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে বা দেশটি কতটা উন্নতি করেছে বাইরে থেকে তা অনুমান করা কঠিণ। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। সত্যিকারের ডিজিটাল সমাজ বলতে যা বোঝায় তা এখন চীনে বাস্তব। একমাত্র প্রযুক্তিগত এই উন্নতির কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। যেমন কাগুজে মুদ্রা স্পর্শবিহীন লেনদেনের কথাই ধরা যাক। বর্তমানে চীন কাগুজে মুদ্রাস্পর্শবিহীন সমাজের একটা বড় উদাহরণে পরিণত দেশ। লেনদেনের সবকিছুই চলছে গণনা ও স্পর্শবিহীন ডিজিটাল পদ্ধতিতে। প্রাচীনকালে পণ্যদ্রব্যের মাধ্যমে বিনিময়ের কাজ সারতো মানুষ। যার যে পণ্য দরকার হত সে সেই পণ্য গ্রহণ করতো নিজের উৎপাদিত পণ্যের বিনিময়ে। এই পন্থায় দুরীভূত হত মানুষের অভাব। কালের পরিক্রমায় উদ্ভব হল মুদ্রার। মুদ্রা হিসেবে মানুষ স্বর্ণ, রৌপা, তামাসহ নানা ধাতুর ব্যবহার করে। সবশেষ চালু হয় কাগজী মুদ্রার। যা বর্তমানেও বিশ্বের প্রায় সবদেশে প্রচলিত। মুদ্রাকে কেন্দ্র করেই মানুষের গোটা অর্থব্যবস্থা পরিচালিত হয়। কিন্তু চীনে বর্তমানে মনে হয় এই কাগুজে মুদ্রা বা নোটের দিন শেষ হতে চলেছে। চায়না সমাজে নোটের প্রচলন নেই বললেই চলে। কেনাকাটা থেকে শুরু করে সবধরনের আর্থিক লেনদেন চলে অনলাইনে। এই ক্ষেত্রে দেশটি এক বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধন করেছে। কি যানবাহনে চড়া, কি কেনাকাটা করা, কি হোটেল-রোস্তেরাঁর বিল দেয়া-সব জায়গায় এখন চলে ডিজিটাল মূল্য পরিশোধ। মানিব্যাগ ছাড়া বের হলেও খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা সবকিছুই চলে। একজন মানুষের কোন সমস্যাই হয় না এসব করতে। এর জন্য থাকতে হবে শুধু একটা স্মার্ট ফোন ও ডিজিটাল একাউন্ট। চীনে বর্তমানে একজন মানুষ দিন কেন মাসের পর মাস কাগুজে মুদ্রা ছাড়াই দিব্যি জীবন যাপন করতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উইচ্যাট দিয়েই সবকিছুর মূল্য পরিশোধ করা যায়। ধরা যাক কেউ কোন চাকরি করেন। মাস শেষে তার বেতন চলে যাবে ব্যাংক একাউন্টে। ব্যক্তিটি ব্যাংক একাউন্টের সাথে উইচ্যাট কানেক্ট করে নেবে। এরপর সব লেনদেন করবে উইচ্যাটে। মাসের পর মাস কাগুজে মুদ্রা ছাড়া চলতে তার কোন অসুবিধা হবে না। শুধু লেনদেনই নয়, উইচ্যাটের মাধ্যমে অন্যের কাছে টাকা ট্রান্সফারও করা যায়। উইচ্যাটের পরই রয়েছে আলি পে’র মাধ্যমে লেনদেন। আলি পে’র মাধ্যমে লেনদেনও চীনাদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়।

এছাড়া চায়না সরকার দেশব্যাপী ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবস্থা ই-ইউয়ান চালু করেছে। এরই মধ্যে প্রায় অর্ধশত কোটি মানুষ এই ওয়ালেট অ্যাপ ডাউনলোড করে তাদের লেনদেনের কাজ সারছে। শহুরে প্রায় শতভাগ লোক কাগুজে মুদ্রাবিহীন ডিজিটাল বিনিময় ব্যবস্থার সাথে জড়িত। পিছিয়ে নেই গ্রামীণ সমাজও। শেনজেন শহরে শতভাগ মানুষ ডিজিটাল লেনদেন করে। একেবারে দু চারজন বয়স্ক লোক যারা মোবাইল অ্যাপের ব্যবহার জানে না তারাই শুধু কাগুজে মুদ্রায় কেনাকাটা করে। এমনকি করোনার কারণে ভিক্ষুক বা সাহায্য প্রার্থী পর্যন্ত সরাসরি ইউয়ানে ভিক্ষা বা সাহায্য নেন না। তার কাছে একটি কিউআর কোড থাকে। এই কোড স্ক্যান করে ভিক্ষা বা সাহায্য দিতে হয়। বিদেশীরাও পিছিয়ে নেই মোবাইল লেনদেনে। কারও নিজদেশে ব্যাংক একাউন্ট এবং ভিসা কার্ড থাকলে আলি পের মাধ্যমে চীনে লেনদেন করতে পারে। এরই মধ্যে দুটি ব্যাংক কাগুজে মুদ্রার ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে। ব্যাংক দুটি হল ঝংকুচান এবং নিউআপ ব্যাংক অফ লিয়াওনিং। জেডিসহ বড় বড় কোম্পানি চালু করেছে ক্যাসলেস বা সরাসরি মুদ্রাবিহীন ক্রয়-বিক্রয় ব্যবস্থা।

চীনে শুধু মোবাইলেই পেমেন্ট বা লেনদেন থেমে রয়নি। টাকা নাই, কার্ড নাই, মোবাইল নাই? তাতেও সমস্যা নাই। শুধুমাত্র ফেস রিকগনিশন সিস্টেমের মাধ্যমে মুখের অভিব্যক্তি দিয়েও লেনদেন করা যায়। প্রযুক্তি আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? চীনের থিয়ানজিনে এমনই একটি সেল্ফ সার্ভিস সুপারমার্কেট চালু হয়েছে। মার্কেটে রয়েছে নির্দিষ্ট একটি ডিজিটাল ডিভাইস। ক্রয় করা পণ্য এই ডিভাইসে রাখলে পণ্যের গায়ের কোড স্ক্যান করে এর দাম নির্ধারিত হয়। এরপর ডিভাইসের ক্যামেরার দিকে মুখ ফেরালেই ক্রেতার একাউন্ট থেকে মূল্য পরিশোধ হয়ে যায়। এছাড়া একশ’র বেশি শহরে আলিবাবা ফেস রিকগনিশন লেনদেন ব্যবস্থা চালু করেছে। ফেস রিকগনিশন অ্যাপ চালু করে হাসি দিলেই এটা নির্দিষ্ট ক্রেতাকে চিনতে পারে। তার একাউন্ট থেকে মূল্য পরিশোধ হয়ে যায়। এই ব্যবস্থা আরও সুবিধাজনক এবং নিরাপদ। মুখের হাসিই সিগনেচার হিসেবে কাজ করে।

ডাবলিন ভিত্তিক রিসার্চ এন্ড মার্কেটস.কম এর এশিয়া-প্যাসিফিক ডিজিটাল পেমেন্ট রিপোর্ট-২০২২ এ বলা হয়েছে ২০২১ সালে চীনে প্রতি ৫ জন ক্রেতার মধ্যে ৪ জনই মোবাইল পেমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার করেছেন। করোনার কারণে কাগুজে মুদ্রাবিহীন বা মুদ্রা স্পর্শবিহীন লেনদেন বেড়েছে বলে ওই সংস্থার জরীপে বলা হয়েছে। এতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ডিজিটাল লেনদেনে সবার শীর্ষে আছে আলি পে। ২০২৩ সালের মধ্যে ১.৩ বিলিয়ন জনসংখ্যার দেশটির ৬০ শতাংশ মানুষ মোবাইল পেমেন্টের মাধ্যমে লেনদেন করবে। তবে চীনের বহুল প্রচলিত চায়না ডেইলির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে (২১ জুন ২০২২) দাবি করা হয়েছে দেশটিতে বর্তমানে ৮০ শতাংশ মানুষ অনলাইন পেমেন্ট অ্যাপ বা মোবাইলে লেনদেন করে। ক্যাসলেস বা কাগুজে মুদ্রাবিহীন লেনদেন দ্রুত এবং সহজ। এই লেনদেন ব্যবস্থা মানুষকে বেশি করে কেনাকাটায় উৎসাহী করে। এটাকে অর্থনীতিবিদরা একটি দেশের অর্থনীতির জন্য ভাল বা ইতিবাচক হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। চীনের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ই-পেমেন্ট বা মোবাইল পেমেন্ট ব্যবস্থা ইতিবাচক অবদান রাখছে। তাছাড়া নানা সময়ে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া চীন সরকার অভ্যন্তরীণ কেনাকাটা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ই-পেমেন্ট ব্যবস্থার ওপর জোর দিয়েছে। যাতে ওসব নিষেধাজ্ঞার কোন ক্ষতিকর প্রভাব না পড়ে। এতে দেখা গেছে নতুন এই পেমেন্ট ব্যবস্থা যথেষ্ট ফলদায়ক। করোনাকে নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রেও গণনাবিহীন স্পর্শবিহীন এই বিনিময় ব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। কাগুজে মুদ্রাবিহীন বিনিময় ব্যবস্থা চীনাদের জীবনযাত্রাকে করেছে আরও সহজ।

ইমরুল কায়েস

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn