‘ফুটবল অন দ্য রুফ’: গ্রামীণ মেয়েদের ফুটবল স্বপ্ন
১৬ নভেম্বর ৩৭তম চায়না গোল্ডেন রোস্টার অ্যাওয়ার্ডস একটি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন এবং বিজয়ীদের তালিকা ঘোষণা করে। এতে ‘ফুটবল অন দ্য রুফ’ সেরা শিশু চলচ্চিত্রের সম্মান পেয়েছে। তা ছাড়া, ৯ নভেম্বর সমাপ্ত ৪২তম মিলান আন্তর্জাতিক ক্রীড়া চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন উৎসবে এ চলচ্চিত্রটি ‘ফুটবল ফিল্ম এবং টেলিভিশন’ বিভাগে মনোনয়ন পুরস্কার জিতেছে। এই চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য শুধুমাত্র ২০টি চলচ্চিত্রকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বর্তমানে, এ চলচ্চিত্রের পরিচালক ফেই ইয়ু ৩৬তম অস্ট্রিয়ান আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য ভিয়েনা গেছেন।
‘ফুটবল অন দ্য রুফ’ নামের চলচ্চিত্রটি চীনের ইউননান প্রদেশে শুটিং করা হয় এবং এর প্রধান অভিনেতা অভিনেত্রীও ইউননানের বাসিন্দা।
যখন ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উত্সবের প্রদর্শনীতে দেখানো হয়, তখন চলচ্চিত্রটিতে ইউননান প্রাচীন গ্রাম থেকে তোলা দৃশ্যটি দেখে উপস্থিত অতিথিরা ভুল করে মনে করেছিলেন যে, এটি সিজি (কম্পিউটার অ্যানিমেশন) দ্বারা নির্মিত সুন্দর দৃশ্য। ইউননানের এসব অনন্য সুন্দর দৃশ্যাবলী এবং চরিত্রগুলো ‘ফুটবল অন দ্য রুফ’-এর জন্য একটি উজ্জ্বল সুর ও রং প্রদান করেছে। চলচ্চিত্রের পরিচালক ফেই ইয়ু মনে করেন, পরপর পুরস্কারগুলো পাওয়া তার জন্য একটি দুর্দান্ত স্বীকৃতি এবং উত্সাহও বটে। ইউননানের চলচ্চিত্রের অসীম সম্ভাবনাও রয়েছে।
ইউননানের সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য, সহজ সাংস্কৃতিক পরিবেশ, এবং খেলাধুলা ও জীবনের অধ্যবসায় ‘ফুটবল অন দ্য রুফ’ নামে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি এবং জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং ইউননানের উচ্চমানের ফিল্ম ও টেলিভিশন রিসোর্সও ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অন্বেষণকে আকর্ষণ করেছে।
ফেই ইয়ু পরিচালিত ‘চলচ্চিত্রটি’ ২০২৪ সালের ২০ এপ্রিল দেশব্যাপী মুক্তি পায়। লিইং কালচার মিডিয়া (ইউননান) লিমিটেড কোম্পানি, সাংহাই থ্রি ডাইমেনশন ফিল্ম লিমিটেড কোম্পানি, হুয়া ই ব্রাদার্স ফিল্ম লিমিটেড কোম্পানি এবং ইউননান প্রাদেশিক পার্টি কমিটির প্রচার বিভাগ চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেছে। এটি একটি অনন্য চলমান চিত্রশৈলী এবং মেজাজ ব্যবহার করে, সমৃদ্ধ এবং পূর্ণ রঙের সাথে ইউননানের একদল মেয়ের অনুপ্রেরণামূলক গল্প বর্ণনা করে, যারা ইউনানের পাহাড়ে ফুটবল পছন্দ করেন এবং একটি অ-পেশাদার ফুটবল দল গঠন করতে, আরও বিস্তৃত দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য অসুবিধাগুলো কাটিয়ে ওঠেন। চলচ্চিত্রে মেয়েদের জীবন যাত্রার অবস্থা অনেক কষ্টকর। গ্রামাঞ্চলে কোন আনুষ্ঠানিক শরীর চর্চার জায়গা নেই, একমনকি শালীন খেলার স্থানও নেই। কোচের নেতৃত্বে মেয়েরা ছাদ এবং ধান ক্ষেতকে ফুটবল মাঠ হিসেবে, আর জাম্বুরাকে ফুটবল হিসেবে ব্যবহার করেন। ফুটবল অনুশীলন চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ফুটবল দক্ষতা ধাপে ধাপে উন্নীত হয়েছে। অবশেষে পাহাড় ছেড়ে পেশাদার ফুটবল মাঠে এসে চিত্তাকর্ষক ফলাফল অর্জন করেন তারা।
‘ফুটবল অন দ্য রুফ’ নামে মুভিটি ইউননানে শ্যুট করা হয়েছিল, ইউননানের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক ল্যান্ডস্কেপ দেখানো হয় ছবিটিতে। সিনেমাটি মূলত হোংহ্য প্রিফেকচার লুসি জেলার ইয়োংনিং থানার ছেংচি প্রাচীন গ্রামে শ্যুট করা হয়েছিল। মেয়েরা ছাদে ফুটবল খেলছিল এবং তাদের নিষ্পাপ ও সরল হাসি প্রাচীন গ্রামটিকে প্রতিধ্বনিত করছিল। জীবন এবং খেলাধুলার প্রতি তাদের উত্সাহ ও অধ্যবসায় অগণিত দর্শককে মুগ্ধ করেছে।
২০২৪ সালের নভেম্বরের চীনের সিয়ামেন শহরে ৩৭তম চায়না গোল্ডেন রোস্টার অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। ১৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান এবং সমাপনী অনুষ্ঠান। গোল্ডেন রোস্টার অ্যাওয়ার্ড ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, অর্থাত্ চীনা চান্দ্র ক্যালেন্ডারে রোস্টার বর্ষে।
৩৭তম চায়না গোল্ডেন রোস্টার অ্যাওয়ার্ডে ‘ফুটবল অন দ্য রুফ’ নামে মুভিটি শ্রেষ্ঠ শিশু বিষয়ক চলচ্চিত্রের পুরস্কার ছাড়াও শ্রেষ্ঠ পরিচালকের প্রথম মুভির পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ শিল্প পুরস্কার এবং শ্রেষ্ঠ সংগীত পুরস্কার— এ চারটি মনোনয়ন পায় এবং অবশেষে মুভিটি শ্রেষ্ঠ শিশু বিষয়ক মুভির পুরস্কার জেতে।
এছাড়াও, ‘ফুটবল অন দ্য রুফ’ ৫ থেকে ৯ নভেম্বর ইতালির মিলানে অনুষ্ঠিত ৪২তম মিলান ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ফেস্টিভাল ফাইনালে এ মুভিটি ‘ফুটবল ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন’ বিভাগে মনোনয়ন পুরস্কার জিতেছে। এই পুরস্কারটি ১৩০টি দেশ যৌথভাবে সংগঠিত করে এবং বিশ্বজুড়ে ২০টি চলচ্চিত্রকে প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। ‘ফুটবল অন দ্য রুফ’ বেইজিং ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস ফিল্ম উইক দ্বারা নির্বাচিত হয় এবং মিলান ফুটবল ক্লাবের শহরে প্রদর্শিত হয়। গ্রামীণ মেয়েদের ফুটবলের স্বপ্নকে অনুসরণ করতে অসুবিধাগুলো কাটিয়ে ওঠার চলচ্চিত্রটি মিলানের অনেক দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বেছে নেওয়ার সময়ে ইউননান কিশোর কিশোরীদের অপরিহার্য জীবনীশক্তি পরিচালক ফেই ইয়ুকে গভীরভাবে মুগ্ধ করেছে। তিনি বলেন, ‘ইউনানের পাহাড়ে মেয়েদের ফুটবল খেলা, গ্রামীণ এবং খেলাধুলার বিষয়ভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলোকে দর্শকদের কাছে আড়ম্বরপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য করে তুলতে, আমাদের অবশ্যই ভিন্ন বিষয়বস্তু তৈরি করতে নতুন চিন্তাভাবনা ব্যবহার করতে হবে।’ বড় শহর থেকে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কিশোর কিশোরীদের নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে ইউনানের শিশুদের অভিনয় থেকে তিনি অনুভব করেন যে, তাদের প্রাণবন্ত এবং মুক্ত প্রকৃতি এবং অ্যাথলেটিক ক্ষমতা অন্য শহরের শিশুদের নেই।
যদিও অপেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়ের অভিজ্ঞতা ছিল না, এবং ছবিতে মেয়েরা এবং কুকুরছানাদের একে অপরকে তাড়া করার দৃশ্যে অনিশ্চয়তা ছিল, তবে অবশেষে ক্রুরা অসুবিধাগুলো কাটিয়ে ওঠেন এবং শুটিং কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। তিনি সারা দেশের ২০৩টি স্কুলের ১০ হাজারেরও বেশি জনের মধ্য থেকে ২০টি কিশোর-কিশোরি বেছে নিয়েছিলেন এবং তাদের নিবিড়ভাবে প্রশিক্ষণ দেয়ার পর চিত্রগ্রহণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ছাদে, শস্য শুকানোর ক্ষেতে, এবং গ্রামের ছোট কোর্টে, মেয়েরা জাম্বুরা দিয়ে খেলতে খেলতে বড় হয়ে যাচ্ছে।
‘ফুটবল অন দ্য রুফ’ মুভিটি হল তরুণ পরিচালক ফেই ইয়ু’র প্রথম ছবি, ফিল্মটিতে ইউনান গ্রামীণ মেয়েদের মতো যারা ‘যতই কঠিন হোক না কেন তাদের স্বপ্নকে অনুসরণ করে চলেছেন,’ ফেই ইয়ু’র ছবি তোলার প্রস্তুতিও অসুবিধাগুলো কাটিয়ে উঠতে অধ্যবসায় পূর্ণ ছিল। ফেই ইয়ু স্মরণ করেছেন যে, চিত্রগ্রহণের শুরুতে তিনি প্রযোজনা এবং বিতরণে একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। ‘ফুটবল অন দ্য রুফ’ মুভি একটি ছোট-বাজেটের চলচ্চিত্র। একজন পরিচালক হিসাবে, আমি সবচে বেশি যা বিবেচনা করি তা হল প্রযোজনায় বাজেট। ফেই ইয়ু তিন বছরে ইউননানের ৯০ শতাংশ গ্রাম পরিদর্শন করেন। জীবন এবং ভবিষ্যতের প্রতি ইউননানের গ্রামীণ জনগণের ভালোবাসা এবং প্রত্যাশা অনুভব করেছিলেন তিনি, যা সমস্ত ছবিতে প্রতিফলিত হয়েছে। লুসি জেলার প্রাচীন গ্রামে ছাদে ভুট্টা শুকানোর দৃশ্য দেখে তিনি খুব আপ্লুত হয়েছিলেন, যদিও অনেক গ্রামবাসী নতুন গ্রামে চলে গেছেন, তবুও এটি এখনও সমৃদ্ধ আমেজ দেখায়। তিনি পুরানো গ্রামগুলোর ভাবমূর্তি রেকর্ড করতে আগ্রহী। ফেই ইয়ু বলেন, ‘মুভি শুটিং করার জন্য ইউননান এবং লুসি জেলার প্রাসঙ্গিক বিভাগগুলোর সহায়তায়, আমরা ছেংচি প্রাচীন গ্রামগুলোকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করেছি। ফিল্মটিতে ‘ইউননানের মানুষ, পাহাড় ও নদী এবং প্রাকৃতিক গ্রামগুলোর সুন্দর দৃশ্য প্রাণবন্তভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। ফেই ইয়ু বলেন, এটি সিনেমা হলে মুক্তির আগে ২০২৩ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে। এটি দেখে অতিথিরা অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মুভি’র দৃশ্যগুলো সিজি স্পেশাল ইফেক্ট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কি? তিনি গর্বিতভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘না, এটি চীনের ইউননানের আসল সৌন্দর্য।’ ‘ফুটবল অন দ্য রুফ’ মুভি থেকে শুরু করে ফেই ইয়ু বলেন, তিনি ভবিষ্যতে আরও থিম এবং নতুন বিষয় অন্বেষণ করবেন। তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি ভবিষ্যতে সিনেমা তৈরি করতে ইউননানে আসতে থাকব, এখানে অনেক দুর্দান্ত থিম রয়েছে এবং আমি বিশ্বকে ইউননানের গল্প বলতে চাই।’