বাংলা

গোবি মরুভূমিতে একজন মানুষ ও একটি কুকুরের অবিচ্ছেদ্য ভাগ্য

CMGPublished: 2023-12-14 16:54:55
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

আপনি কল্পনা করতে পারেন, কীভাবে খুব সাধারণ একটি বেওয়ারিশ কুকুর একদিন বিশ্ববাসীদের ‘আধ্যাত্মিক আইডল’ হয়ে উঠলো। বিষয়টি একটি বইয়ে তুলে ধরা হয়েছে, যেটি ২০টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে এবং সারা বিশ্বে বিক্রি হচ্ছে। হলিউড কুকুরটিকে নিয়ে চলচ্চিত্র ও টিভি নাটক তৈরির কপিরাইট কিনেছে।

অগণিত ধনী ব্যবসায়ী এবং সেলিব্রেটি এ কুকুরের সঙ্গে ছবি তোলেন এবং ইংল্যান্ডের রানি কুকুরটিকে নিজের বাহুতে ধারণ করেছেন। আজকের অনুষ্ঠানে একসঙ্গে ‘গোবি’ নামের বেওয়ারিশ সেই কুকুর এবং ডিওন লিওনার্দ নামের একজন ম্যারাথন অনুরাগীর গল্প শুনবো।

ব্রিটেনের ম্যারাথন অনুরাগী ডিওন লিওনার্দ ২০১৬ সালে ৬ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চীনের সিনচিয়াংয়ে আসেন। এটি ছিল তার প্রথম চীন সফর। তিন বছর অন্তর অনুষ্ঠিত আল্ট্রা ম্যারাথনে অংশগ্রহণ করতে তিনি তিন বছরব্যাপী প্রস্তুতি নেন। এই ম্যারাথন ‘গোবি লং মার্চ’ বলে পরিচিত এবং প্রতিযোগিতার ট্র্যাককে ‘মৃত্যুর ট্র্যাক’ বলে অভিহিত করা হয়। এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিলে মরুভূমি ও তৃণভূমিসহ জনবসতিহীন এলাকা অতিক্রম করতে হয়। এতে দৌড়াদৌড়ি বা হাঁটার মাধ্যমে আড়াই শ’ কিলোমিটার যাত্রা সম্পূর্ণ করতে হবে। এর জন্য প্রায় এক সপ্তাহ প্রয়োজন হয়। ‘গোবি লং মার্চ’ ম্যারাথন অংশগ্রহণকারীদের মনস্তাত্ত্বিক আত্মনিয়ন্ত্রণ, দ্রুত শারীরিক পুনরুদ্ধার এবং প্রকৃতির চরম পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতার বিশাল পরীক্ষা।

আমরা সবাই জানি, আল্ট্রা ম্যারাথনে অংশগ্রহণকারীরা পুরো প্রতিযোগিতার সময় তাদের নিজস্ব খাবার প্রস্তুত করেন। পানি ও তাঁবু ছাড়াও অংশগ্রহণকারীদেরকে তাদের এক সপ্তাহের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু আনতে হয়। যেমন খাবার, ঘুমের ব্যাগ, পোশাক, প্রাথমিক চিকিত্সার কিট ইত্যাদি। প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিততে তিনি ৭ দিনের দৌড় সম্পূর্ণ করার জন্য প্রয়োজনীয় পানি ও খাবার সঠিকভাবে হিসাবে করে নেন।

প্রথম দিনের প্রতিযোগিতা শেষ করার পর শিবিরে ডিওন দেখতে পান, নোংরা একটি কুকুর তার লেজ নেড়ে নেড়ে আশেপাশের মানুষদের কাছে খাবার চাইছে। নিজের খাবার সীমিত এটা ভেবে ডিওন তাকে কোনও খাবার দেন না; কেবল কুকুরটির মাথায় স্পর্শ করে চলে যান।

পরদিন ডিওন তাঁবুর দরজা থেকে বের হওয়ার পর অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, সেই কুকুরটি তার জন্য অপেক্ষা করছে। তারপর ৫০ ডিগ্রি উচ্চ তাপমাত্রায় কুকুরটি ডিওনের পিছনে সঙ্গী হিসেবে দৌঁড়াতে শুরু করে। অনেক ক্লান্তি ও শ্বাসকষ্ট হলেও কুকুরটি থেমে যায় না। ডিওনের হৃদয়ে উষ্ণতার প্রবাহ বয়ে যায়। তিনি মুগ্ধ হয়ে যান। তিনি সেই কুকুরটির নাম দেন ‘গোবি’ এবং নিজের তার সীমিত পরিমাণ খাবার ও পানি তার সঙ্গে শেয়ার করেন।

একবার নদী পার হওয়ার সময় ডিওন ‘গোবি’কে দেখতে পান না। সেই বিশাল ও গভীর নদী পার হওয়ার ক্ষমতা ছোট ‘গোবি’র নেই। ডিওন ইতোমধ্যেই নদীর এক-চতুর্থাংশ পার হয়ে এসেছেন। এখান থেকে ফিরে ‘গোবি’কে আনতে গেলে তিনি নিঃসন্দেহে স্বর্ণপদক হারাবেন। নদীর তীরে কুকুরটিকে দেখে ডিওনের মনে হয়, তাকে নদী পার করানোর চেয়ে স্বর্ণপদক গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি ফিরে গিয়ে ‘গোবি’কে নিয়ে নদী পার হন।

প্রতিযোগিতার পরের অংশে তারা একসঙ্গে দৌঁড়ায়, একসঙ্গে খায়, একসঙ্গে ঘুমায়। পাশে ‘গোবি’ থাকার কারণে ডিওন আস্তে আস্তে প্রতিযোগিতার কষ্ট ভুলে যান।

তবে দেড় শ’ কিলোমিটারের মতো দৌঁড়ানোর পর ‘গোবি’র পায়ের পাতা রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। ডিওন তাকে চিকিত্সা-গাড়িতে নিয়ে আসেন। তিন দিন পর ডিওন যখন গন্তব্যস্থানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, ‘গোবি’ তখন তার কষ্ট ও ব্যথা উপেক্ষা করে ছুটতে থাকে এবং ডিওনের সঙ্গে ফিনিশিং লাইন অতিক্রম করে।

প্রতিযোগিতায় রৌপ্যপদক জিতলেও ডিওন বলেন, “আমার জন্য গোবি এবারের প্রতিযোগিতার সবচেয়ে ভালো পুরস্কার।”

ডিওন গোবিকে দত্তক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে ব্রিটেনের আইন অনুযায়ী এ সংক্রান্ত কাজ সম্পন্ন করতে কমপক্ষে চার মাসের মতো সময় লাগে। তাই সাময়িকভাবে ‘গোবি’কে উলুমুছিতে রেখে যেতে হবে ডিওনকে।

তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগে কুকুরের দত্তক পর্যালোচনা শেষ হওয়ার আগেই ডিওন একটি ফোন কল পান। গোবি হারিয়ে গেছে। খবর পেয়ে কোনও দ্বিধা না করে ডিওন বিমানযোগে আবার উলুমুছি শহরে পৌঁছান।

তিনি ১০ হাজার ফ্লায়ার প্রিন্ট করে শহরের ছোট-বড় সড়কে গোবিকে খুঁজতে শুরু করেন। গোবি’র সঙ্গে তার অভিজ্ঞতা জেনে অনেকে মুগ্ধ হন এবং নিজ নিজ উদ্যোগে গোবিকে খুঁজে বের করার কাজে অংশ নেন। ত্রিশ লাখ লোকসংখ্যার উলুমুছি শহরে একটি ছোট কুকুরকে খুঁজে বের করা ভীষণ কঠিন এক ব্যাপার।

অর্ধেক মাস পার হয়ে যায় কিন্তু গোবি’র কোনো খবর পান না ডিওন। বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজনরা তাকে ছেড়ে যেতে রাজি করাতে চেষ্টা করেন; তারা বলেন, কুকুর পছন্দ করলে আরেকটি কিনে নিতে পারেন তিনি। তবে ডিওনের মনে ‘গোবি’ যে জায়গা করে নিয়েছে সেটা অন্য কেউ নিতে পারবে না। তিনি হাল ছাড়তে চান না। অবশেষে ১৭তম দিনে সুখবর আসে। গোবি ও ডিওনের পুনর্মিলন ঘটে। ডিওন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না এবং তার চোখ থেকে আনন্দাশ্রু ঝরতে শুরু করে।

ব্রিটেনে যাওয়ার পর গোবি’র নতুন জীবন শুরু হয়। সে ডিওনের সঙ্গে ক্রিসমাস ও বসন্ত উত্সবসহ নানা ফেস্টিভাল উদযাপন করে এবং ডিওনের সঙ্গে বিশ্বের নানা জায়গায় ভ্রমণ করে।

উলুমুছি শহরে ‘গোবি’কে খুঁজে পাওয়ার সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে ডিওন ‘ফাইন্ডিং গোবি’ নামে বইটি লিখেছেন।

ডিওন বলেন,চীনের এই অভিজ্ঞতা চীন সম্পর্কে তার প্রাথমিক ধারণা পরিবর্তন করেছে এবং তিনি আশা করেন, এই বইটি আরও বেশি লোককে চীন এবং এর জনগণকে বুঝতে সাহায্য করবে। তিনি আশা করেন যে, এই গল্পটি চীন সম্পর্কে পশ্চিমাদের পূর্বধারণা পরিবর্তন করবে এবং আরও বেশি লোককে চীনা জনগণের উত্সাহ ও বন্ধুত্ব সম্পর্কে জানাবে।

লিলি/রহমান

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn