সঙ্গীত যাদের জীবনের আলো
সম্প্রতি চারজন অন্ধ মেয়ের গান গাওয়ার একটি ভিডিও ইন্টারনেটে জনপ্রিয় হয়েছে। তারা যে গানটি গেয়েছেন তার শিরোনাম ‘সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত’। অনেক নেটিজেন তাদের সুন্দর এবং মনোমুগ্ধ কণ্ঠের বর্ণনা দিতে গিয়ে একে ‘ফেরেশতাদের কণ্ঠ’ বলে উল্লেখ করেছেন।
এসব অন্ধ শিশু হুনান প্রদেশের হেংইয়াং শহরের স্পেশাল এডুকেশন স্কুল থেকে আসে এবং তারা জুনিয়র হাই স্কুলের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। সঙ্গীত শিক্ষক চাং সুয়ে মেইয়ের সাহায্যে তারা অন্তর্মুখী থেকে আত্মবিশ্বাসী এবং প্রফুল্ল হয়ে উচ্চস্বরে গান গেয়ে থাকেন।
চাং সুয়ে মেই বলেন, “সঙ্গীত ক্লাস শেষ হওয়ার পর আমি তাদের চারজনের সাথে গান গাওয়ার একটি ভিডিও রেকর্ড করে নেটে পোস্ট করেছি। আমিও ভাবিনি যে ভিডিওটি এত জনপ্রিয় হবে।”
ভিডিও’র চারজন মেয়ের সবাই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্রী। তাদের মধ্যে কেউ কেউ জন্ম থেকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এবং কেউ আবার রোগে আক্রান্ত হয়ে অন্ধ হয়ে যায়। ছয় বছর বয়স থেকে তারা বিশেষ শিক্ষার স্কুলে পড়াশোনা এবং বসবাস করছে। প্রতিমাসে একবার তারা বাড়িতে ফিরে যায় এবং বাইরের বিশ্বের সাথে খুব কমই যোগাযোগ করে। এই প্রথমবারের মতো তারা সবার নজর কেড়েছে।
শিক্ষক চাং সুয়েমেই বলেন, “সবার স্বীকৃতি পেয়ে তারা খুব খুশি, আমি এটাকে খুশি হিসেবে বর্ণনা করতে পারবো না, এটা কেবল আমাকে উত্তেজিত করেছে। আমার যে কয়েকজন শিক্ষার্থী সাক্ষাৎকার দিয়েছিলো, তারা বলেছিল যে তারা রাতে ঘুমাতে পারছে না এবং তারা সব সময় উত্তেজিত অবস্থায় ছিল।”
চাং সুয়ে মেই হেংইয়াং নর্মাল ইউনিভার্সিটির সঙ্গীত বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি পান। ছয় বছর আগে তিনি হেংইয়াং শহরের স্পেশাল এডুকেশন স্কুলে পড়াতে এসেছিলেন এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের সঙ্গীত ক্লাসের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সঙ্গীতে প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের আবিষ্কার করার জন্য তিনি একটি বিশেষ মিউজিক গ্রুপ গঠন করেন। সেই সময়ে ১২ বছর বয়সী চেং সিও মেং তার মনে গভীর ছাপ রেখেছিলেন।
চাং সুয়ে মেই মনে করেন, গান গাওয়ার ক্ষেত্রে চেং সিও মেং নিঃসন্দেহে একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি। সেই সময়ে তিনি কোনো আবেগ ছাড়াই গান গেয়েছিলেন। তবে তার কণ্ঠস্বর খুব ভাল এবং ছন্দও ভাল ছিল।
বিশেষ মিউজিক গ্রুপ গঠিত হয় এবং গঠনের শুরুতে এর সদস্যদের কোনো সঙ্গীত ভিত্তি ছিল না। কারণ তারা দেখতে পান না। তাদের জন্য শিক্ষককে বাক্যের পর বাক্য পাঠ করতে হয়। শুরুতে তারা ছন্দ ও স্বরকে ভালোভাবে ধরতে পারত না এবং শিখতে খুব কষ্ট হতো।
হেং ইয়াং স্পেশাল এডুকেশন স্কুলে কাজ করার আগে শিক্ষক চাং সুয়ে মেই সাধারণ স্কুলে পড়াতেন। তিনি কখনোই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ করেননি এবং তিনি ব্রেইল সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলেন। দীর্ঘ সময় পর চাং সুয়ে মেই আবিষ্কার করেন যে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের শেখার অসুবিধা ছাড়াও বৃহত্তর বাধা আসলে তাদের মানসিক জটিলতা। তিনি শিশুদের পরিবর্তন করতে সঙ্গীত ব্যবহার করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা যখন গান গাইতে শেখে, তখন তাদের প্রথমে শোনা গানের কথা ব্রেইলে রূপান্তর করতে হয়, সঠিক উচ্চারণ নিশ্চিত করার পর গানের সুর আয়ত্ত করতে হয়। শুধু গানের কথা মুখস্থ করতে তাদের সাধারণ মানুষের চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি সময় লাগে।
যদিও এটি শেখা সহজ নয়, শিশুরা প্রতিটি সঙ্গীত ক্লাসকে মূল্য দিয়ে থাকে। এটি তাদের জন্য বিশ্রাম নেওয়ার বিরল সুযোগ বলে তারা মনে করে এবং সবাই খুব উৎসাহ দেখিয়েছে।
শিক্ষার্থীদের হীনমন্যতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করার জন্য চাং সুয়ে মেই যেকোনো ছোটখাটো অগ্রগতিতে তাদের উৎসাহিত করেন। তিনি বাইরের বিশ্বের সাথে তাদের যোগাযোগ করতে প্রতিটি সুযোগ গ্রহণ করেছেন।
শিক্ষক চাং সুয়েমেই এবং তার সহকর্মীদের সাহায্যে অনেক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ধীরে ধীরে প্রফুল্ল হয়ে উঠে এবং তাদের রৌদ্রোজ্জ্বল চরিত্র দেখাতে শুরু করে। গান গাওয়ার ভিডিওটি ইন্টারনেটে জনপ্রিয় হওয়ার পরে আরও বেশি শিক্ষার্থী সেই বিশেষ সঙ্গীত গ্রুপে যোগদানের জন্য আবেদন করেছে।
নেটিজেনদের কাছ থেকে ভালবাসা এবং উত্সাহ পাওয়ার পর কিছু শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে একটি মিউজিক মেজর নেওয়ার ধারণা পেয়েছে এবং এর জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে শুরু করেছে।
শিক্ষক চাং সুয়েমেইকে যে বিষয়টি আরও বেশি তৃপ্ত করেছে- তা হল যে শিশুরা সঙ্গীতের কারণে প্রফুল্ল এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে এবং একটি ইতিবাচক ও আশাবাদী মনোভাবের সাথে জীবনের মুখোমুখি হয়েছে।
চলতি বছর ১৮ বছর বয়সী চেং সিওমেং খুব শিগগিরই স্কুল থেকে স্নাতক হবে। দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য অতীতে কেবল ম্যাসেজ করাই ছিল একমাত্র পথ। এখন সঙ্গীত চেং সিওমেং এর জন্য আরও বেশি সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে।
এসব দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়েদের জন্য একবার রিহার্সাল ভিডিওটি সকলের ভালবাসা এবং উত্সাহ পেয়েছে ঠিক তাদের গাওয়া গানের শিরোনামের মতো। এটি ছিল তাদের জীবনের ‘সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত’।
সঙ্গীত শিশুদের আবার আলো দেখাতে পারে না, তবে এটি তাদের অন্ধকারের মুখোমুখি হওয়ার সাহস দিতে সক্ষম। বন্ধ থেকে প্রফুল্ল, হীনতা থেকে বহির্গামী, এটাই শিক্ষার শক্তি। আমরা প্রায়শই বলি, শিক্ষকরা হল মালী আর ছাত্ররা হল ফুল। শিক্ষক চাং সুয়ে মেইয়ের মনোযোগের সাথে লালন পালনে তার ছাত্র-ছাত্রীরা ফুলের মতো ফোটে উঠেছে এবং তাদের স্বপ্নের পানে ছুটতে শুরু করেছে।