বাংলা

চীনের খ্যাতিমান অভিনেতা ও মার্শাল আর্টিস্ট ইউ হাই

CMGPublished: 2023-02-09 09:49:41
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

ইউ হাই এই নাম চীনাদের কাছে খুব সুপরিচিত নয়। তবে তার অভিনীত চরিত্রের কথা উল্লেখ করলে অনেকের চোখের সামনে মার্শাল আর্টে দক্ষ একজন মাস্টারের ইমেজ ভেসে উঠবে। আসলে পর্দার বাইরে তিনি একজন কুংফু মাস্টার এবং ‘ম্যান্টিস বক্সিং কিং’ নামে পরিচিত। চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি ইউ হাই মৃত্যুবরণ করেন এবং মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।

ইউ হাই চলচ্চিত্রাঙ্গনে প্রবেশ করেন একটু দেরিতে। ১৯৮২ সালে ‘শাওলিন টেম্পল’ নামের মুভি দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন লি লিয়েন চিয়ে। তিনি দ্রুত বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। মুভিতে তার মাস্টারের চরিত্রে অভিনয় করেন ইউ হাই। তখন তাঁর বয়স ছিলো ৪০ বছর। সেটি ছিল তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র।

মুভিতে লি লিয়েন চিয়ে একজন সন্ন্যাসীর চরিত্রে অভিনয় করেন। সন্ন্যাসী অনেক পরিশ্রম করেন ও মার্শাল আর্ট চর্চা করেন। তিনি মন্দের বিরুদ্ধে ও ভালোর পক্ষে ছিলেন। ইউ হাই, যেমনটি আগেই বলেছি, চলচ্চিত্রে তাঁর মাস্টারের চরিত্রে অভিনয় করেন। ছাত্রের জন্য মাস্টার যেমন কঠোর ছিলেন, তেমনি কোমলও ছিলেন পিতার মতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি একটি তীরের আঘাতে নিহত হন। মৃত্যুর আগে তিনি ‘ন্যায়বিচার সমর্থন করুন’ কথাটি লিখে রেখে গিয়েছিলেন।

‘মার্শাল আর্ট অনুশীলন করতে চাইলে, কষ্ট বা ভয় পাওয়া উচিত নয়।’ মুভিতে মাস্টার সামান্য ভ্রুকুটি করে তরুণ সন্ন্যাসী-ছাত্রকে এ উপদেশ দেন। এ দৃশ্যটি এখনও অনেক দর্শকের মনে আছে।

১৯৮২ সালে চলচ্চিত্রের টিকিটের দাম মাত্র এক চিয়াও ছিলো। সেই সময় ‘শাওলিন টেম্পল’ সিনেমা ১৬ কোটি ইউয়ান মূল্যের বক্স অফিস আয় করে বিস্ময় সৃষ্টি করে।

‘শাওলিন টেম্পল’ নামের মুভি’র পর ইউ হাই অনেক মার্শাল আর্ট চলচ্চিত্রে ‘মাস্টারের’ চরিত্রে অভিনয় করেন। এক সাক্ষাত্কারে ইউ হাই বলেন, চলচ্চিত্রে অভিনয় করা শুধুমাত্র তাঁর শখ, তিনি একজন মার্শাল আর্ট শিক্ষক ও কর্মী।

১৯৪২ সালে তিনি শানতোং প্রদেশের ইয়েন থাই শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তিনি সবসময়ই অসুস্থ থাকতেন। তাই বাবা তার শরীর শক্তপোক্ত করতে তাকে মার্শাল আর্ট শেখানোর সিদ্ধান্ত নেন। বাবা তার বন্ধু লিন চিংশান তথা ‘সেভেন স্টার ম্যান্টিস ফিস্টের প্রধানের’ কাছে ১২ বছর বয়সী ইউ হাইকে পাঠান। লিন চিংশান খ্যাতিনাম মার্শাল আর্ট মাস্টার ছিলেন।

মাস্টারকে অনুসরণ করে ইউ হাই ছাংছুয়েনসহ অনেক কংফু শেখেন। ১৬ বছর বয়সে তিনি জাতীয়, প্রাদেশিক এবং পৌরসভার তিন-স্তরের মার্শাল আর্ট প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন এবং তিন বার পুরস্কার জিতে নেন। চমৎকার ফলাফল নিয়ে তিনি শানতোং স্পোর্টস টেকনিক্যাল কলেজে ভর্তি হন এবং একজন আনুষ্ঠানিক জাতীয় মার্শাল আর্ট অ্যাথলিট হন। তখন থেকে তিনি উশু’র সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হয়ে পড়েন।

তিনি একাধিকবার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন এবং চীনের অন্যতম বিখ্যাত মার্শাল আর্ট ক্রীড়াবিদ হয়ে ওঠেন। যে-যুগে চায়নিজ কুংফু সারা বিশ্বে খুবই জনপ্রিয় ছিল, সে-যুগে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং তুরস্কসহ ৩০টিরও বেশি দেশ সফর করেন। ১৯৬০ সালের শেষ দিকে তিনি তত্কালীন চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছেন ই’র সঙ্গে মিয়ানমার সফর করেন।

১৯৬৬ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি শানতোং প্রাদেশিক উশু দলের অধিনায়ক এবং প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বে শানতোং প্রাদেশিক উশু দল সারা চীনে সাফল্য অর্জন করে। চলচ্চিত্র ও টিভি অঙ্গনে প্রবেশের পর তিনি উশুকে অবহেলা করেননি। তিনি ছেলেকে ভালো করে উশু শেখান।

ইউ হাইয়ের ছেলে ইউ থাও ৯ বছর বয়সে বাবা’র কাছে উশু শিখতে শুরু করেন। তিনি বহুবার দেশের গুরুত্বপূর্ণ উশু প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন। ২০০১ সালে তিনি শানতোং প্রদেশের উই হাই শহরে উশু’র সংস্কৃতি বিনিময়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং এটিই চীনের একমাত্র ‘প্রেয়িং ম্যান্টিস ফিস্ট’ প্রশিক্ষণকেন্দ্র।

ইউ হাই সবসময় বলতেন, ‘শিক্ষার্থীদেরকে মৌলিক কলাকৌশল শেখানোর পাশাপাশি কীভাবে একজন মানুষ হওয়া যায় তা-ও শেখানো জরুরি।’ ইউ হাই নৈতিকতার ওপর সবক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতেন।

ভক্তরা তাঁর সঙ্গে ছবি তুলতে চাইলে, তিনি কখনও না করতেন না। খুব ক্লান্ত থাকলেও হাসিমুখে ভক্তদের আবদার রাখতেন। তিনি বলেন, “আমি একথা কখনও ভুলি না যে, ভক্ত না থাকলে চলচ্চিত্রের তারকা হওয়া যায় না।”

২. চেচিয়াং প্রদেশের হেংতিয়েন জেলার লণ্ঠন শো প্রসঙ্গ

হেংতিয়েন জেলায় জাতীয় ফাইভ-এ পর্যায়ের দর্শনীয় স্থান ‘হেংতিয়েন ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন সিটি’ রয়েছে। এখানে ১৪টি বড় আকারের নৈসর্গিক স্পট এবং ফিল্ম ও টেলিভিশন শুটিং বেস আছে। এ জেলাকে ‘চীনের হলিউড’ বলা হয়। চীনের অনেক চলচ্চিত্র ও টিভি নাটকের শুটিং এখানে হয়েছে।

চলতি বছরের বসন্ত উত্সবের ছুটির সময় হেংতিয়েন জেলায় পর্যটকদের ভীড় দেখা গেছে। চীনের চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন পর্যটনের একটি আইকনিক গন্তব্য হিসেবে হেংতিয়েন ফিল্ম ও টেলিভিশন সিটি বসন্ত উৎসবের ছুটিতে ৯ লাখ ২০ হাজার পর্যটককে আকর্ষণ করেছে।

চলতি বছরের বসন্ত উত্সবের ছুটিতে হেংতিয়েন ফিল্ম ও টেলিভিশন সিটি গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অনুষ্ঠিত ‘বসন্ত উত্সব মন্দির মেলা’র আয়োজন অব্যাহত রাখে এবং চীনের সোং রাজবংশের শৈলীসম্পন্ন লণ্ঠন শো তৈরি করে। লণ্ঠন শো-তে সোং রাজবংশের কবিতায় বর্ণিত লণ্ঠন উত্সবের দুর্দান্ত দৃশ্যকে তুলে ধরা হয় এবং ফিল্ম ও টেলিভিশন ল্যান্ডস্কেপিং কৌশল ব্যবহার করে মন্দিরমেলার দৃশ্যের সাথে সোং রাজবংশের সংস্কৃতিকে একত্রিত করা হয়।

খরগোশ বর্ষে প্রাচীন শৈলীর লণ্ঠন ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। লণ্ঠন শো-তে সোং রাজবংশ আমলের বিবাহের রীতিনীতি, চায়ের অর্ডার ও ফুল সাজানোসহ বিভিন্ন বিনোদনমূলক চিত্র তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি, ডজন খানেক সোং রাজবংশ আমলের নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। এর মাধ্যমে পর্যটকরা সোং রাজবংশ আমলের সংস্কৃতি উপভোগ করতে পারেন।

হেংতিয়েনের লণ্ঠন উত্সবে পর্যটকরা কেবল লণ্ঠন উপভোগ করেননি, কেউ কেউ অভিনেতাও হয়েছেন; ফিল্ম ও টেলিভিশনে অভিনয় করার অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছেন। অনেক পর্যটক প্রাচীন চীনের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র বা টিভি নাটকের শুটিংয়ের জায়গায় ছবি তুলেছেন।

চীনের আনহুই প্রদেশ থেকে আসা ম্যাডাম চাং এবং তার মা হানফু পোশাক পরে এখানে আসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি, যেন সত্যিকারভাবে সোং রাজবংশে ফিরে গিয়েছি। মাঝেমাঝে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে সোং রাজবংশের বিখ্যাত মানুষ। কী আশ্চর্য।’ লণ্ঠন শো-তে পর্যটকরা সরাসরি শুটিং করার জায়গায় প্রবেশ করতে পারেন। নিজেই পরিচালক বা অভিনেতার মজা পেতে পারেন।

বসন্ত উত্সবের সময় থিম-যুক্ত পরিবেশনা ছাড়াও, হেংতিয়েনের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে নানা বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা রাস্তায় উঠে পর্যটকদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

চীনের চেচিয়াং প্রদেশের উয়েনচৌ শহর থেকে লি ইউন চিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এখানে আসেন। তিনি বলেন, ‘বসন্ত উত্সবের সময় হেংতিয়েন দর্শনীয় স্থানগুলোর বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে অনেক বৈচিত্র্যময়। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই নিজ নিজ পছন্দের অনুষ্ঠান ও পরিবেশনা উপভোগ করতে পারেন। বিশেষ করে, চলচ্চিত্র ও টিভি নাটকের সুপরিচিত দৃশ্য দেখার সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি অনুভব করতে পারেন। আমরা খুব খুশি হয়েছি এখানে এসে।’

৩. কবিতাপ্রেমী একজন সাধারণ গ্রামীণ শ্রমিকের বিখ্যাত হয়ে ওঠার গল্প

সম্প্রতি ‘চীনের কবিতা প্রতিযোগিতা -২০২৩’ নামের এক টিভি অনুষ্ঠান শেষ হয়। চীনের কানসু প্রদেশের পিংলিয়াং থেকে আসা একজন গ্রামীণ শ্রমিক বহু প্রতিযোগীকে পরাজিত করে এতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তার নাম চু ইয়েন চুন। ৫০ বছর বয়সী চু ইয়েন চুন বিগত ৩০ বছর ধরে কবিতা পড়ে আসছেন।

চু ইয়েন চুন পিং লিয়াং শহরের চিংনিং জেলার একজন প্লাম্বার।

বাবার প্রভাবে ছোটবেলা থেকে তিনি কবিতা পছন্দ করতেন। মাধ্যমিক স্কুল পাস করার পর দারিদ্র্যের কারণে তাকে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে বাইরে কাজের সন্ধানে যেতে হয়। টাকা উপার্জনের মন দিলেও, তিনি নিজের পছন্দের কাজ ও স্বপ্ন ছেড়ে দেননি। গভীর রাতে যখন অন্যরা ঘুমিয়ে পড়তো, তখন তিনি কবিতা পড়ছেন এবং শিখতেন। এই অভ্যাস তিনি ৩০ বছর ধরে ধরে রেখেছেন। তার ধারণা, যতবার কবিতা পড়েন ততবারই সময় ও স্থান অতিক্রম করে তিনি সেই প্রাচীন কবি’র সঙ্গে কথোপকথন করেন।

চু ইয়েন চুনের টেবিলে একটি নোটবুক আছে। নোটবুকের পাশে একটি অভিধান। কবিতা পড়তে গিয়ে কোথাও বুঝতে অসুবিধা হলে তিনি অভিধানে শব্দের অর্থ খুঁজে বের করেন।

তিনি চীনের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, একজন সাধারণ গ্রামীণ শ্রমিক, অন্যদের আইডল হতে পারে না, তবে নিজ সন্তানের জন্য আদর্শ হতে পারে। কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে তিনি বই বা কবিতা পড়েন। কাজের চাপ বেশি হলেও, কবিতা পড়ে সব ক্লান্তি দূর করা যায় বলে তিনি মনে করেন। বাবার প্রভাবে চু ইয়েন চুনের একটি মেয়ে এবং একটি ছেলে চীনের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

২০১৯ সালে টিভি সেটের সামনে চু ইয়েন চুন ‘চীনের কবিতা-প্রতিযোগিতা’ শীর্ষক অনুষ্ঠান দেখেন। মঞ্চে প্রতিযোগীদের চমত্কার পারফরমেন্স দেখে তিনি দারুণ প্রশংসা করেন এবং তিনিও সেই মঞ্চে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে খুবই আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

নানা কারণে চার বছর পর তিনি এ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান। চার বছরের মধ্যে চু ইয়েন চুনের পরিবারের সকল সদস্য অনুষ্ঠানের অনুগত ভক্ত হয়ে ওঠেন। অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার প্রক্রিয়ায় তিনি অনেক নতুন বন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হন।

‘চীনের কবিতা প্রতিযোগিতা -২০২৩’-এর ফাইনালে চু ইয়েন চুন তার কবিতার ভাণ্ডার উজার করে দেন এবং দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। চু ইয়েন চুন যেন সবাইকে জানিয়ে দিলেন যে, পরিশ্রমের পর অবশ্যই পাওয়া যাবে।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn