বিখ্যাত চলচ্চিত্র শিল্পী ছিন ই: চলচ্চিত্র আমার সারাজীবনের সাধনা
৯ মে, মা দিবসের পরের ভোরে শত বছর বয়সী ছিন ই মৃত্যুবরণ করেন। তিনি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির একজন অসামান্য সদস্য, চীনা চলচ্চিত্রের একজন সংগ্রামী কর্মী। তিনি সর্বদা বড় যুগের প্রবাহে সক্রিয় ছিলেন। শত বছরব্যাপী আলো ও ছায়ার জীবনে ছিন ই অগণিত ক্লাসিক নারী চিত্র তৈরি করেছেন।
১৯৯২ বিরানব্বই সালের জানুয়ারিতে ছিন ই শাংহাই শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৬ বছর বয়েসে, তিনি একা বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। জাপান-বিরোধী প্রচারে অংশ নিতে প্রথমে উহান শহরে যান এবং তারপর একটি চীনা চলচ্চিত্র স্টুডিওতে অভিনেত্রী হওয়ার জন্য ছোংছিং শহরে চলে যান। ১৯৪১ সালে তিনি চাইনিজ ড্রামা সোসাইটিতে যোগ দেন এবং মঞ্চ নাটকে উজ্জ্বল হতে শুরু করেন।
তরুণ বয়সে তিনি অনেক ক্লাসিকাল মুভিতে অভিনয় করেছেন এবং কয়েক বছর আগে ৯৬ বছর বয়সে তিনি একটি মুভিতে অভিনয় করেন। ৯৭ বছর বয়সে তাকে ‘জনগণের শিল্পী’ হিসেবে এই জাতীয় সম্মানসূচক উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
তবে অনেকে জানেন না, তার পারিবারিক জীবন প্রতিবন্ধকতায় পরিপূর্ণ ছিলো। তার স্বামী, ছেলে ও ছোট বোন তরুণ বয়সে মারা যায়।
আজকের অনুষ্ঠানে সবাই মিলে এই কিংবদন্তীর গোটা জীবনের ওপর নজর দেবো।
ছিন ই’র কথা বললে, প্রথমে বলতে হয় প্রবীণ চলচ্চিত্র ভক্তদের প্রথম ছাপ হলো তার সৌন্দর্য।
তাকে সৌন্দর্যের দেবী বা ‘পূর্বের ভেনাস’ বলা হয়। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ‘চীনের সবচে সুন্দর নারী’ হিসেবে তার প্রশংসা করেন।
চলচ্চিত্রের সঙ্গে ছিন ই’র সম্পর্ক গড়ে তোলা খুব নাটকীয় ছিলো। ১৬ বছর বয়সে যখন তিনি ছোংছিং শহরের থিয়েটারে বন্ধুর সঙ্গে অপেরা উপভোগ করছিলেন, তখন তত্কালীন বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক তাকে আবিষ্কার করেন এবং অভিনয় করার জন্য তাকে রাজি করান। তারপর চলচ্চিত্রের সঙ্গে ছিন ই’র অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক শুরু হয়।
তার ৮০ বছরের ক্যারিয়ার জীবনে তিনি নানা ক্ল্যাসিকাল চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
১৯৮২ সালে ‘Under the roof of Shanghai’ নামে সিরিজ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি প্রথম জনপ্রিয় টিভি গোল্ডেন ঈগলের অসামান্য অভিনেত্রীর পুরস্কার জয় করেন।
ক্যারিয়ারে সফল হওয়ার সাথে সাথে ছিন ই আরো বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। তাঁর অভিনয়ের ফাঁকা সময় প্রায়শই এমন দর্শক থাকে যারা গেট ঘিরে রাখতো এবং অভিনেতা অভিনেত্রীরা দুপুরের খাবারের জন্য বাইরে যেতে পারতেন না।
তা ছাড়া, চীনা জনগণের খুব সুপরিচিত বড়লোক অথবা শীর্ষ নেতৃবৃন্দ তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যুদ্ধের সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে একই টেবিলে খাবার খেতেন। বিখ্যাত হওয়ার পর তিনি চৌ এন লাইয়ের স্ত্রী তেং ইন ছাওয়ের ভালো বন্ধু হন। যখন ছিন ই’র ক্যান্সার ধরা পড়ে, তেং ইন ছাও তাকে সান্ত্বনা দিতে চিঠি লেখেন।
১৯৮৭ সালে ছিন ই চীনা চলচ্চিত্র ব্যক্তিদের প্রতিনিধি হিসেবে শাংহাইয়ে গ্রেগরি পেক নামে বিখ্যাত মার্কিন অভিনেতার সঙ্গে বৈঠক করেন।
বিস্ময়কর সৌন্দর্য, সফল ক্যারিয়ার ও খ্যাতি যা সবাই জানে, ঈশ্বর ছিন ই’র জন্য বিশেষভাবে তা পছন্দ করেছেন বলে মনে হচ্ছে।
যাই হোক, আসলে ছিন ই’র আপাতদৃষ্টিতে মসৃণ জীবন অসংখ্য উত্থান-পতনে পূর্ণ ছিল।
এই ধরনের উত্থান-পতন মূলত তার পরিবার থেকেই আসে। বড় হওয়ার পর থেকেই ছিন ই পরিবারের প্রধানের ভূমিকা পালন করে আসছেন। অভিনেত্রী হিসেবে বিখ্যাত হওয়ার পর তিনি তার বাবা-মা, ভাই-বোন সবাইকে দেখাশোনা করতেন।
মূল পরিবারের বোঝা ছাড়াও, ছিন ই’র দুটি বিবাহিত জীবন এত সুখের ছিল না।
১৯৩৯ সালে বিখ্যাত নাটক তারকা ছেন থিয়েন কুও ছিন ই’র প্রেমে পড়েছিলেন এবং তাকে তীব্রভাবে অনুসরণ করেছিলেন।
দু’জন একে অপরকে প্রায় অর্ধ বছরেরও কম সময় ধরে চিনত, তারপর ছেন থিয়েনকুও আত্মহত্যার চাপ দিয়ে ছিন ইকে বিয়েতে রাজি করান।
তখন মাত্র ১৭ বছর বয়সী ছিন ই আতঙ্ক ও অজ্ঞতা বশত বিয়ে করতে বাধ্য হন।
তবে বিয়ের পর ছেন থিয়েন কুও মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েন, প্রায়ই ঘরের ঝামেলা এবং এমনকি সন্তানকে দত্তক দেওয়ার প্রস্তাব দেন। স্বামীর সব আচরণ সহ্য করতে না পেরে ছিন ই সন্তানকে নিয়ে শাংহাইয়ে ফিরে যান। তিনি এই দুঃস্বপ্নের সম্পর্ক শেষ করেন।
ছিন ই’র দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন তখনকার খুব বিখ্যাত ‘চলচ্চিত্রের রাজা’ চিন ইয়েন। চিন ইয়েন সুদর্শন ও সুদক্ষ। ছোটবেলা থেকেই দরিদ্র জীবন যাপনের কারণে তিনি সব কিছু করতে পারতেন। যেকোন খাবার রান্না করা, যে কোন কাপড় তৈরি করা ইত্যাদি। ছিন ই’র সাথে আরও বেশি যত্ন সহকারে এবং বিবেচনার সাথে আচরণ করেন তিনি। তাদের বিয়ের পরে দুজন বেশ সুন্দর জীবন কাটাচ্ছিল। খুব দ্রুত তাদের একটি পুত্র সন্তান জন্ম নেয়।
তবে, দুর্ভাগ্যবশত ভালো সময় বেশিদিন স্থায়ী হয় না। যে কোনো কারণেই চিন ইয়েনের ক্যারিয়ারে বড় ধাক্কা লাগে। চলচ্চিত্রের চুক্তি কমে যায়। এর বিপরীতে, ছিন ই’র অভিনয় ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ হয়। একটি বিশাল মনস্তাত্ত্বিক ব্যবধানে শিকার হন চিন ইয়েন। তিনি ছিলেন অসুখী এবং ছিন ই’র সাথে তার সম্পর্ক বিরোধে জড়িয়ে পড়ে।
শীঘ্রই এটি অপ্রত্যাশিত খবর প্রকাশিত হয় যে, চিন ইয়েন- ছিন ই’র ছোট বোন ছিন ওয়েনের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করেছে। গভীর দুঃখে ছিন ই তাকে তালাক দিতে চান, কিন্তু চিন ইয়েন কোনোভাবেই তাতে রাজি হননি। যদিও দু’জন তখনও একসাথে ছিলেন, তাদের একে অপরের থেকে আলাদা ছিলেন এবং বিবাহটি কেবল নামেই টিকে ছিল। পরে চিন ইয়েন অতিরিক্ত মদ্যপান ও কাজের কারণে পেটের প্রচণ্ড সমস্যায় পড়েন। তিনি অস্ত্রোপচারের জন্য হাসপাতালে যান। অস্ত্রোপচারের পর তিনি সিক্যুয়েল পান এবং তখন থেকেই বিছানায় থাকতে বাধ্য হন।
কোমল হৃদয়ের ছিন ই তাকে পরিত্যাগ করতে চান নি। ১৯৮৩ সালে চিনন ইয়েন মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি নীরবে স্বামীর যত্ন নেন।
ছিন ইকে কেবল তার স্বামীরই নয়, তাদের ছেলেরও যত্ন নিতে হবে। ছোটবেলায় রোগের কারণে তার ছেলে সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছিল। ছিন ই তাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো সহ্য করতে পারেন নি। বরং তার যত্ন নেওয়ার জন্য নিজের পাশে রাখেন। প্রতিবার ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়লে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না। সে লোকেদের ঘুষি ও লাথি মারত, এমনকি তার মাকেও চিনতে পারত না।
ছিন ই এইভাবে সহ্য করেছিলেন এবং ধীরে ধীরে ছেলের আবেগ প্রশমিত করার একটি উপায় বের করেন, তা হলো চিত্রকলা।
২০০৭ সালে ছিন ই’র ছেলে মারা যায় এবং মা হিসেবে ছিন ই অবশ্যই অনেক কষ্ট পান। চীনের সি ছুয়ান প্রদেশের ওয়েনছুয়ান ভূমিকম্পের সময় ছিন ই তার জমা করা দুই লাখ ইউয়ান দান করেছিলেন। তিনি বলেন যে, অর্থ তার ছেলের জন্য সঞ্চয় করা হয়েছিল, কিন্তু এখন তার ছেলে না ফেরার জগতে চলে গেছে। তাই এসব টাকা যাদের কাছে খুব প্রয়োজন, তাদেরকে দেবেন তিনি।
তার নিজের অভিজ্ঞতা ও পছন্দ সম্পর্কে ছিন ই বলেন যে, ‘আমার বাবার মতো আমার একটি নরম এবং কাপুরুষ মনোভাব রয়েছে, অন্যথায় আমি তাদের যা বলেছিল, তাতে আমি রাজি হতাম। একটি বড় পরিবার, সাবেক স্বামী, দ্বিতীয় স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতা এবং একটি মানসিক অসুস্থ ছেলে-- ছিন ই সর্বদা কোমল হৃদয় দিয়ে সব মোকাবিলা করেছেন।
তবে এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘আমার মায়ের মতো সাহসী ও শক্তিশালী হয়েছি আমি। আমি যে কোনও কিছুর মুখোমুখি হতে পারি।’ হ্যাঁ, তিনি মানুষের প্রতি নরম ও দয়ালু। কিন্তু জীবন এবং কাজের জন্য তার একটি ইস্পাতের মতো ইচ্ছা আছে।
ছোটবেলায় ছিন ই’র অনেক শক্তি ছিল। ১৬ বছর বয়সে জাপান বিরোধী যুদ্ধ শুরু হয়। ছিন ই, যিনি শাংহাইয়ের একটি বড় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি তার পকেটে দশ ইউয়ানের বেশি টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান এবং জাপানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ করেন। তিনি প্রায় জলপথে ডুবে গিয়েছিলেন, এমনকি পাথর নিয়ে হাতে বন্দুক ধরা সেনাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন।
কর্মক্ষেত্রে ছিন ইও খুব মনোযোগী। ‘রেলওয়ে গেরিলা’ মুভির শুটিংর সময় ছিলো গ্রীষ্মকাল। যখন তিনি ভারি কাপড় পরে একটি স্কার্ফ পরে সূর্যের নীচে থাকেন, তখন ত্বক কাঁটা তাপ দেখা দিলো। তিনি পাত্তা দেন নি। কারণ তিনি মনে করেন যে, চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কোনো ঋতু নেই এবং চলচ্চিত্র কর্মীরা যখন মানুষের সেবা করে- তখন তাদের কষ্ট সহ্য করা উচিত।
২০০৯ সালে ৮৮ আটাশি বছর বয়সী ছিন ই গোল্ডেন রুস্টার এবং হানড্রেড ফ্লাওয়ারসের লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন। তিনি ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমার বয়স ৮৮ বছর বা ৯৮ আটানব্বই বছর, যাই হোক না কেন, আমি অবশ্যই আমার সহকর্মীদের সাথে এগিয়ে যাবো। প্রবীণ চলচ্চিত্র ব্যক্তিদের এই অধ্যবসায় দেখে পুরস্কার দান অনুষ্ঠানে উপস্থিত অনেক অভিনেতা অভিনেত্রীর চোখ ভিজে যায়। তিনি শুধু বলেননি, বরং করে দেখিয়েছেন।
২০১৪ সালে, ৯২ বিরানব্বই বছর বয়সী ছিন ই ‘ছিংহাই লেকসাইড’ নামে চলচ্চিত্রটি পরিচালনা ও অভিনয় করেন। ছিংহাই-তিব্বত মালভূমিতে চিত্রগ্রহণের সময় সবাই তার স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত ছিল এবং তাকে নিরুৎসাহিত করেছিল। কিন্তু ছিন ই উত্তরে বলেন, সব ঠিক আছে। এমনকি তিনি জাপান বিরোধী যুদ্ধের সময় অভিনয় করার জন্য সামনের সারিতে ছিলেন। তাই চলচ্চিত্র কর্মীদের কষ্ট সহ্য করা উচিত্।
২০১৭ সালে ছিন ই ‘দ্য লিজেন্ড অফ দ্য ডেমন ক্যাট’ নামে চলচ্চিত্রে অংশ নেন। হুয়াং সুয়েন নামে তরুণ একজন অভিনেতা বলেছিলেন যে, যদিও চিন ই বয়স্ক এবং লাইনগুলো দ্রুত মুখস্থ করতে পারেন না, তবে তার সব ভঙ্গি ও চোখের দৃষ্টি দৃঢ়, যা বিস্ময়কর।
আপনি ছিন ই’র জীবন সম্পর্কে যত বেশি জানবেন, এই বৃদ্ধার প্রতি ততই সম্মান বাড়বে। তিনি চীনা সমাজের সবচে উত্তাল ঐতিহাসিক পর্যায়ের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। তিনি জাপানি সেনাদের শয়তানি দেখেছেন, প্রিয় ছেলের মৃত্যু দেখেছেন, এমনকি স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছেন। কিন্তু তিনি সর্বদা একটি দৃঢ় নৈতিকতা, কাজের প্রতি কঠোর ও মনোযোগী মনোভাব, উন্মুক্ত মানসিকতা ও শক্তি লালন করেছেন। তিনি সর্বদা কষ্টের প্রথম বাহক, সর্বদা যত্নশীল, সহনশীল এবং নিবেদিত প্রাণ। লিলি/তৌহিদ