সরল তবে দুর্দান্ত—আসন্ন বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান: পরিচালক চাং ই চৌ
শীতকালীন অলিম্পিকের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বেইজিং হবে ইতিহাসের এমন একটি শহর, যেখানে গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের আয়োজন করা হয়। চাং ই মৌও এমন একজন পরিচালক, যিনি গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধন ও সমাপনী অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন।
সিনহুয়া বার্তা সংস্থার কাছে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে চাং বলেন, তিনি অনেক গৌরব বোধ করেন এবং তিনি খুব কৃতজ্ঞ। দেশের শক্তি’র কারণে এত অল্প সময়ের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো অলিম্পিকের কাজ করতে পারবেন। তিনি গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠান পরিচালনা করার সুযোগ পেয়েছেন।
চাং ই মৌ বলেন, ২০২২ সালে শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সময় একশ’ মিনিটেরও কম এবং অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। ২০০৮ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সময় ছিলো ৪ ঘণ্টা এবং এতে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার। ২০০৮ সালের অলিম্পিকের তুলনায় ২০২২ সালের অলিম্পিকের সময় কম এবং অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যাও কম হবে। স্বল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে চমত্কার একটা পরিবেশনা দেওয়া যায়?
চাং ই মৌ বলেন, শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের থিম গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের মতোই। তা হলো ভবিষ্যতমুখী।
তিনি বলেন, তিনি একটি তুষারকণার মাধ্যমে মানবজাতির সাধারণ আবেগ তুলে ধরার আশা পোষণ করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সবাই একত্রিত হয়ে বেইজিংয়ে জড়ো হয়ে মানবজাতির অভিন্ন লক্ষ্যের কমিউনিটি গঠন করার চিন্তাধারা এবং ‘ভবিষ্যতমুখী’ মানবজাতির এই অভিন্ন অনুভূতি গড়ে তোলেন।
২০০৮ সালের চেয়ে ২০২২ সাল নিঃসন্দেহে ভিন্ন রকম। চাং ই মৌ মনে করেন, ২০০৮ সালে চীন প্রথমবার বিশ্বের কাছে নিজেকে তুলে ধরার সুযোগ ও প্লাটফর্ম পেয়েছিল। তাই সেই বছর ব্যাপক আকারে সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মাধ্যমে চীনের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস তুলে ধরা হয়। আমাদের ইতিহাস, আমাদের ঐতিহ্য এবং আমাদের অগ্রযাত্রা তুলে ধরতে ২৯টি ‘চিহ্ন’ ব্যবহার করা হয়।
এবারের শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভবিষ্যত ও মানবজাতির অভিন্ন লক্ষ্যে ওপর ফোকাস করা হবে। এখন নিজের বেশি পরিচয় দেওয়ার দরকার নেই। এখন আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- আমরা কোন কাজের জন্য একত্রিত হয়েছি এবং আমরা কি করতে পারি।
‘আমি’ থেকে ‘আমরা’ পর্যন্ত, ‘চীনের ইতিহাস তুলে ধরা’ থেকে ‘ভবিষ্যত’ পর্যন্ত, চাং ই মৌ বলেন, এর পিছনে অবশ্যই রয়েছে জাতীয় শক্তি ও মর্যাদার উন্নতি এবং চীনা জনগণের আত্মবিশ্বাস।
২০২২ সালে শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের থিম হলো ‘সরল, নিরাপদ ও দুর্দান্ত’। তাই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও এ তিনটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখা হবে।
সহজ ও সরল বিষয় হলো প্রথম লক্ষ্য। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সময় কম। মিতব্যয়ী প্রতিযোগিতা ছাড়াও, শীতকালের ঠান্ডা আবহাওয়া বিবেচনায় রাখা হয়েছে। দর্শকরা এবং অতিথিদের বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকা ঠিক হবে না।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা কম। এবারে মাত্র ৩ হাজার লোক এতে অংশ নিয়েছেন।
শৈল্পিক অভিব্যক্তি প্রসঙ্গে চাং ই মৌ বলেন, সরল তবে দুর্দান্ত আসলেই বিরাট চ্যালেঞ্জ।
সরল মানে সহজ নয়। তিনি বলেন, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সহজ কিন্তু আধুনিক শিল্প বৈশিষ্ট্য দেখা যাবে, স্ফটিক স্বচ্ছ বরফ ও তুষার রোমান্টিক অনুভূতি প্রকাশ করবে, আরেকটি নান্দনিক ধারণা দর্শক পেয়ে যায়। সরল মানে হলো- আমরা যখন মার্শাল আর্ট ফিল্ম শুটিং করি, তখন মাস্টারের তলোয়ার খুব সহজেই ব্যবহার করতে দেখা যায়। কিন্তু তা অনেক কষ্ট ও প্রচেষ্টার ফল- তাই না?
বর্তমান বেশ কয়েকবার রিহার্সাল থেকে তিনি মনে করেন, ছন্দটি এখন খারাপ নয় এবং এটি সিনেমার দৈর্ঘ্যের মতো একযোগে করা হয়।
পরিচালক চাং ই মৌ বলেন, অলিম্পিক টর্চ জ্বালানো ২০২২ সালে শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বৃহত্তম লক্ষণীয় বিষয় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, টর্চ জ্বালানোর পদ্ধতি এবং টর্চের প্ল্যাটফর্ম হল আমাদের সবচে দুর্দান্ত আয়োজন, যা শত বছরের অলিম্পিক গেমসের ইতিহাসে কখনও ঘটেনি।
তিনি বলেন, এই নকশা নিম্ন-কার্বন ও পরিবেশ-বান্ধব চেতনা প্রতিফলন করার জন্য তৈরি হয়েছে। আগে তিনিও উদ্বিগ্ন ছিলেন। তবে, সৌভাগ্যের বিষয় হলো এই চিন্তাধারা শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের সাংগঠনিক কমিটি’র ব্যাপক সমর্থন ও আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির স্বীকৃতি পেয়েছে।
তিনি ধারণা করেন, টর্চ জ্বালানোর পদ্ধতি দেখে দর্শকদের ‘অপ্রত্যাশিত’ প্রতিক্রিয়া হবে। তবে, এই পদ্ধতি ‘এক নজরে বোঝা যাবে’। এটি একইসঙ্গে ‘অপ্রত্যাশিত ও যুক্তিসঙ্গত’। আসলে আমি এই কাজের পর থেকে, টর্চ জ্বালানোর সৃজনশীলতা নিয়ে ভাবতে শুরু করি।
আসলে চাং ই মৌ’র পরিচালিত ২০০৮ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি দারুণ প্রশংসনীয় হয়েছে। এবার কীভাবে একটি ভিন্ন রকমের শীতকালীন অলিম্পিক গেমস আয়োজন করা যাবে? এ প্রসঙ্গে চাং ই মৌ বলেন, আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সব চাপ ছেড়ে দেওয়া। যুগের পরিবর্তন হয়েছে। গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের চেয়ে শীতকালীন অলিম্পিক ভিন্ন রকম।
ছয় মাস আগে টোকিও অলিম্পিক শুরু হওয়ার সময় ইন্টারনেটে ২০০৮ সালে বেইজিং গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনের অতীত পর্যালোচনার ঢেউ সৃষ্টি হয়। চাং ই মৌ বলেন, এটাই হলো ইন্টারনেট যুগের বৈশিষ্ট্য। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ না হওয়ায় ইন্টারনেটে এ প্রসঙ্গে নানা মন্তব্যও প্রকাশিত হয়।
চাং ই মৌ বলেন, উদ্বোধনী বা সমাপনী অনুষ্ঠান বা ‘আরো দ্রুত, উচ্চ ও শক্তিশালী’ অলিম্পিকের চেতনা- যাই হোক, সবসময় মানুষ হলো গুরুত্বপূর্ণ। এতে রয়েছে মানুষের মানসিক অবস্থা ও অনুভূতি।
তাই এবার তিনি সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এবং প্রত্যেকের অংশগ্রহণের বিষয়ে আরও মনোযোগ দেন, কারণ এটি অলিম্পিক গেমস আয়োজনের একটি প্রধান লক্ষ্য।
মহামারীর সময় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে নতুন পরিবর্তন ঘটেছে। জটিল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সামনে চীনা জনগণের আস্থা, বিশ্বের জনগণের প্রতি আমাদের অনুভূতি, ‘আরও ঐক্য’ এই নতুন অলিম্পিক নীতিবাক্যসহ আমাদের মহান ধারণা এবং মূল্যবোধ দেখানোর আশা করি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চীনা জনগণের প্রকৃত হৃদয় দেখানো খুব অর্থপূর্ণ ব্যাপার।
কিছুদিন আগে চাং ই মৌ দশম চাইনিজ ফিল্ম গোল্ডেন রোস্টার অ্যাওয়ার্ড ছিনিয়ে নেন। তবে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত তার মুভি’র চেয়ে অলিম্পিকের ওজন অনেক ভারী।
আমার মতো আরেকজন পরিচালক খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি দুইবার অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। মুভি আমার পেশা, উপস্থাপনা না। মুভি মাঝেমাঝে আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, আমি নিজের অনুভূতি থেকে নিজের মন্তব্য ও অনুভূতি প্রকাশ করতে পারি, নিজের পছন্দ অনুযায়ী বেছে নিতে পারি। তবে অলিম্পিক গেমস একটু অন্য রকম। এই কাজটা করার প্রথম সেকেণ্ড থেকে বুঝতে হয় যে, আমার পিছনে রয়েছে মাতৃভূমি এবং সব চীনা মানুষ। আমার কাঁধে ভারি দায়িত্ব আছে। তাই, আমি শুধু একজনের প্রতিনিধি না। আমার সফলতা একজনের সফলতা না।