সু হুয়া ওয়েট’র গল্প-China Radio International
বেইজিং সময় পহেলা অগাস্ট টোকিও অলিম্পিক গেমসে পুরুষদের একশ’ মিটার সেমিফাইনালে সু বিং থিয়েন নামে চীনা ক্রীড়াবিদ ৯.৮৩ সেকেন্ডে তাঁর ট্র্যাক সম্পন্ন করেন এবং এশিয়ার রেকর্ড ভঙ্গ করেন। ফাইনালে তিনি ৯.৯৮ সেকেন্ডে ষষ্ঠ স্থান অর্জন করেন এবং চীনের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তাই তাকে ‘নতুন রেকর্ড সৃষ্টিকারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি নিজের মাইক্রোব্লগে লিখেছেন যে, সু হুয়াওয়ে প্রতিবন্ধী ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড ক্রীড়াবিদ তার মনের ‘রেকর্ড সৃষ্টিকারী’ ক্রীড়াবিদ।
সু হুয়া ওয়ে কে? ‘Zero to Hero’ নামের এ চলচ্চিত্র তার অভিজ্ঞতা অবলম্বনে তৈরি করা হয়েছে। তিনি ১৯৮১ সালে খুব সাধারণ একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা একজন পেইন্টার ও মা গৃহিণী। জন্মের পর পরই তিনি জন্ডিস রোগে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হন। চিকিত্সক ও মায়ের অক্লান্ত চেষ্টায় তার জীবন বাঁচলেও তার মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে, সু হুয়াওয়ে তীব্র খিঁচুনি হতো এবং তার শ্রবণশক্তি কমে যায়।
শারীরিক অক্ষমতার কারণে সু হুয়াওয়ে ছোটবেলা থেকেই দাঁড়াতে পারতেন না। মা বরাবরই তাকে সাহায্য করতেন। মায়ের নিরলস প্রচেষ্টায় চার বছর বয়সে সু হুয়াওয়ে জীবনের প্রথম ধাপ ফেলেন।
স্বাস্থ্য গঠনের জন্য মা তাকে বিশেষ স্কুলের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড টিমে অংশগ্রহণে অনুপ্রেরণা দেন। টিমের কোচ তার সম্ভাব্য শক্তি আবিষ্কার করেন। ১৯৯৬ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সী সু হুয়াওয়ে আটলান্টা প্যারালিম্পিক্সে অংশগ্রহণ করেন। হংকং প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে তিনি ও তার সতীর্থরা ৪০০ মিটার রিলে দৌড়ে সোনা জয় করেন।
আগে ‘দৌড়নো’কে নিজের শখ হিসেবে বিবেচনা করতেন সু হুয়াওয়ে। তার জীবন এই স্বর্ণপদকের কারণে বদলে যায়। তখন থেকে তিনি পূর্ণকালীন ক্রীড়াবিদ হয়ে ওঠেন। মা সু হুয়াওয়েকে বলেন, অন্যদের চেয়ে তুমি ধীর গতিতে হাঁটো, কিন্তু অন্যদের চেয়ে দ্রুত দৌড়াও- কী আশ্চর্য!
পরের চারটি প্যারালিম্পিক্সে সু হুয়াওয়ে পদক নিয়ে ফিরে আসেন এবং বহুবার প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদদের একশ’ ও দুইশ’ মিটার দৌড়ে নতুন বিশ্বরেকর্ড তৈরি করেন।
দুর্বল শ্রবণশক্তির কারণে তিনি স্পষ্টভাবে বন্দুকের শব্দ শুনতে পারেন না। তাই তিনি সবসময়ই সবার শেষে দৌড়ানো শুরু করেন। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো তিনি একের পর এক প্রতিযোগীকে ছাড়িয়ে প্রথমে পৌঁছে যান।
শুরুর লাইনে হেরে গিয়ে এবং শেষ লাইনে জিতে যাওয়া-এটাই সু হুয়া ওয়ে’র গল্প। তাকে হংকংবাসীরা তাদের ‘ফরেস্ট গাম্প’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
সমানভাব হংকংয়ের জন্য মর্যাদা অর্জন করলেও প্রতিবন্ধী খেলোয়াড় হিসেবে সু হুয়াওয়ে’র পারিশ্রমিক অন্যান্য স্বাস্থ্যবান ক্রীড়াবিদদের তুলনায় অনেক কম। ‘Zero to Hero’ নামে একটি চলচ্চিত্রে এমন একটি কথোপকথন আছে। আমি এখন ক্রীড়াবিদ নই, আমি একজন ডেলিভারিম্যান। আমি এখন দৌড়ানো শুরু করলে প্রতি মাসে সরকারের ভাতা তিন হাজার হংকং ডলার হতো। হংকংয়ে একজন সাধারণ পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মাসিক বেতন ৭০০০ হংকং ডলার।
২০০০ সালের সিডনি প্যারালিম্পিক গেমসে সু হুয়াওয়ে ৩টি স্বর্ণপদক এবং একটি রৌপ্য পদক অর্জন করেন। তবে সব বোনাসের মোট আর্থিক পরিমাণ ২ লাখ হংকং ডলারেরও কম। সেই সময় তিনি নিজের খরচে প্রশিক্ষণের পোশাক কিনেছিলেন এবং প্রতিযোগিতা না থাকলে তার কোনো আয় হতো না।
সৌভাগ্যবশত, সু হুয়াওয়ে একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি হচ্ছেন অ্যান্ডি লাউ, হংকংয়ের বিখ্যাত অভিনেতা ও মহান তারকা।
অর্থাভাবে সু হুয়াওয়ের ক্রীড়া জীবন যাতে শেষ না হয়, সেজন্য অ্যান্ডি লাউ তাকে বিশেষভাবে নিজের ভক্তদের ক্লাবে নিয়োগ দেন। যখন কোনও বড় প্রতিযোগিতার জন্য সু হুয়াওয়ে’র প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হবে, তিনি যে কোনও সময় চলে যেতে পারবেন এবং এজন্য তার বেতনও কাটা হবে না।
জীবনের মৌলিক প্রয়োজনের নিশ্চয়তা পাবার পর সু হুয়াওয়ে প্রশিক্ষণে মনোযোগ দিতে পারেন।
২০০৮ সালে সু হুয়াওয়ে ২৪.৬৫ সেকেন্ডে বেইজিং অলিম্পিক গেমসের দুশ’ মিটারের টি-৩৬ শ্রেণীর স্বর্ণপদক এবং একশ’ মিটার প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জপদক অর্জন করেন। সেখানে অ্যান্ডি লাউ দাঁড়িয়ে সু হুয়াওয়েকে আলিঙ্গন করেন।
আসলে ৩০ বছর আগে থেকেই অ্যান্ডি লাউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্যারালিম্পিক গেমসকে সমর্থন করে আসছেন। ১৯৯২ সালের জুলাই মাসে স্পেনের বার্সেলোনা অলিম্পিক গেমসের জন্য অ্যান্ডি লাউ টেলিভিশন ব্রডকাস্টস লিমিটেডের আমন্ত্রণে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে অংশ নেন। তখন তিনি জানতে পারেন যে, অলিম্পিক গেমসের মূল প্রতিযোগিতার পর প্যারালিম্পিক গেমসও অনুষ্ঠিত হয়।
তখন তিনি ভাবেন যে, তারা সবাই স্বর্ণপদক জিতেছেন এবং দেশের জন্য গৌরব ও মর্যাদা জিতেছেন। কেন সবাই শুধু অলিম্পিকের ওপরই দৃষ্টি রাখেন। এদিকে খুব কম মানুষই প্যারালিম্পিকের ওপর দৃষ্টি দেন।
তাই তিনি নিজের খরচে প্যারালিম্পিকের প্রতিযোগিতা দেখতে যান। ১৯৯৬ সালের আটলান্টা অলিম্পিক গেমসের পুরুষদের ৪০০ মিটার রিলে দৌড়ে হংকংয়ের প্রতিবন্ধী প্রতিনিধি দল ব্যর্থ হয়। হংকংয়ে ফিরে আসার পর অ্যান্ডি লাউ প্রত্যেক হংকং খেলোয়াড়কে একটি স্বর্ণপদক দেন। এটাই প্যারালিম্পিক ক্রীড়াবিদ এবং অ্যান্ডি লাউ’র মধ্যে একটি যোগাযোগের সূত্র হয়ে ওঠে। ১৯৯৬ সালে আটলান্টা অলিম্পিকের পর থেকে, প্রতিবার প্যারালিম্পিক দল হংকংয়ে ফিরে আসার পর, তিনি প্রত্যেককে একটি কাস্টমাইজড ‘অলিম্পিক স্বর্ণপদক’ দেন, যাতে সবাই মনে করেন যে তিনি তার পরিশ্রমের প্রতিদান পেয়েছেন। অ্যান্ডি লাউ বলেন, ‘স্বর্ণপদকটি অবশ্যই প্রকৃত স্বর্ণ, তবে স্বর্ণ একটু পাতলা।
শুধু তাই নয়, প্রতি বছর অ্যান্ডি লাউ এক লাখেরও বেশি হংকং ডলার হংকংয়ের প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদদের অনুদান দেন এবং মাঝেমাঝে তাদেরকে মানসিক উত্সাহ দিয়ে থাকেন।
১৯৯৫ সালে টেলিভিশন ব্রডকাস্টস লিমিটেডের তৈরি জনকল্যাণমূলক ভিডিওতে অ্যান্ডি লাউ প্রথমবারের মতো প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদের চরিত্রে অভিনয় করেন। এ ভূমিকার প্রোটোটাইপ চাং ওয়েলিয়াং, যিনি একজন প্রতিবন্ধী তলোয়ার যোদ্ধা।
২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিক গেমসে সবচেয়ে মহান তারকারা যৌথভাবে ‘বেইজিং আপনাকে স্বাগত জানায়’ নামে একটি গান পরিবেশন করেন। তবে অ্যান্ডি লাউ ১৫ লাখ হংকং ডলার খরচ করে প্রতিবন্ধী অলিম্পিক গেমসের জন্য ‘Everyone is no.1’ নামের গানটি তৈরি করেন। তিনি প্যারালিম্পিকের জন্য শুভেচ্ছাদূত হিসেবেও কাজ করেন।
‘Everyone is no.1’ নামে এই মিউজিক ভিডিওতে অ্যান্ডি লাউ একজন রানারের চরিত্রে অভিনয় করেন। দৌড়ের কারণে তিনি অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করতেন। একটি সড়ক দুর্ঘটনার কারণে তিনি একটি পা হারান। তারপর কৃত্রিম পা দিয়ে তিনি আবারও উঠে দাঁড়ান এবং পুনরায় ক্রীড়াবিদের জীবন শুরু করেন।
বেইজিং প্রতিবন্ধী অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি ও হানহোং নামে একজন গায়িকার সঙ্গে ‘ফ্লাইং উইথ ড্রিমস’ গানটি পরিবেশন করেন।
২০১০ সালে অ্যান্ডি লাউ চীনের প্রতিবন্ধী কল্যাণ ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। যখন তার নির্বাচনের প্রস্তাব পাস হয়, তখন নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়। অনেকে মনে করতেন যে, চেয়ারম্যান একটি আলঙ্কারিক পদ; তাই ভাইস চেয়ারম্যানকে নানা কাজ করত হয়। তাই এত বড় তারকা হিসেবে ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের সময় তাঁর হবে না।
তবে এ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অ্যান্ডি লাউকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, প্রতিবার তাকে আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি দ্বিধা না করেই রাজি হয়ে যান এবং সময়মতো উপস্থিত থাকেন।
আসলে অ্যান্ডি লাউ ছাড়া, বিনোদন অঙ্গনে আরও অনেক তারকা আছেন, যারা প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদদের গুরুত্ব দেন।
আসলে দীর্ঘদিন ধরে অনেক সিনেমা ও টিভি শো প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছে। তাদের গল্প অনেক উত্সাহব্যঞ্জক ও চমত্কার।
এসব চলচ্চিত্রের প্রতি আমরা সত্যিই কৃতজ্ঞ। কারণ, সেসব চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমরা প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদদের মানসিক জগতের আরও কাছাকাছি চলে যেতে পারি।
সুস্থ মানুষ হিসাবে আমরা তাদের জন্য যা করতে পারি, তা হলো- তাদের প্রতি বেশি মনোযোগ দেওয়া, কারণ তাদের যা প্রয়োজন তা পূরণের ব্যবস্থা করা এবং আধ্যাত্মিক উৎসাহ ও সমর্থন দেওয়া। শুধুমাত্র বস্তুগত সহায়তা কার্যকর হয় না।