বাংলা

মুভি ‘ইউয়ান লোং পি’-China Radio International

criPublished: 2021-05-27 13:49:51
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

গত ২২ মে চীনে ৯১ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন; তাঁর নাম ইউয়ান লোং পিং। তিনি ছিলেন চীনের হাইব্রিড ধানের ব্রিডিং বিশেষজ্ঞ ও সঙ্কর ধান গবেষণা ও উন্নয়নে চীনের অগ্রগামী ব্যক্তি। তাঁকে ‘বিশ্বের সঙ্কর ধানের জনক’ বলা হয়।

আজকের অনুষ্ঠানে ‘ইউয়ান লোং পিংয়ের’ নামে তৈরি একটি চলচ্চিত্রের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সম্মানিত ও গণপ্রজাতন্ত্র পদকপ্রাপ্ত এই বিজ্ঞানীর জীবনকাহিনী তুলে ধরব।

‘ইউয়ান লোং পিং’ চলচ্চিত্রটি কৃষিবিদ ইউয়ান লোং পিংয়ের জীবনকাহিনী। এতে তরুণ বয়স থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত তার জীবনের গল্প তুলে ধরা হয়েছে। ‘সঙ্কর ধানের জনক’ হিসেবে পরিচিত ইউয়ান লোং পিং মানবজাতির খাওয়া-পরার সমস্যার সামধান করতে সঙ্কর ধান নিয়ে জীবনভর গবেষণা করেছেন।

২৬ বছর বয়সে ইউয়ান লোং পিং তার কৃষিকাজ নিয়ে পরীক্ষা শুরু করেন। তারপর তিনি মিষ্টি আলুর প্রজনন থেকে ধানের প্রজনন নিয়ে গবেষণা করা শুরু করেন। তার এই পরিবর্তন তার সারা জীবনকে পরিবর্তনের পাশাপাশি চীন ও বিশ্বের ওপর সুগভীর প্রভাব ফেলে।

বলা যায়, চীনা জাতির ইতিহাস মূলত ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই করার ইতিহাস। অনাহারে কষ্ট ভোগ করা আমাদের সবচে কষ্টকর স্মৃতি।

‘সবার জন্য ক্ষুধা থেকে মুক্তি’ ছিল অসম্ভব একটি স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে ইউয়ান লোং পিং অর্ধ শতাব্দীর গবেষণা করেন।

‘গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর কৃষি-বিষয়ক প্রথম প্রজন্মের স্নাতক ছাত্র হিসেবে আমি খাদ্যশস্যের উত্পাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই। জনগণকে ক্ষুধা থেকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেই আমি।’ ১৯৫৩ সালে দক্ষিণ-পশ্চিম কৃষি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি পাওয়ার পর ইউয়ান লোং পিং এমন শপথ করেন। সেই সময় প্রাণবন্ত নতুন চীন তাকে বিশাল কাজের সুযোগ করে দেয়। ১৯৮৪ সালে হুনান প্রদেশের সঙ্কর ধান গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রের দেওয়া প্রথম দফার বরাদ্দ ছিল ৫০ লাখ ইউয়ান। ফলে কেন্দ্রে দ্রুত গতিতে গ্রিন হাউজ এবং জলবায়ু নিয়ন্ত্রণকারী ঘর গড়ে তোলা হয়। নতুন করে দু’শতাধিক মেশিন কেনা হয়।

খাদ্যশস্যের উত্পাদন স্থিতিশীল হলে সারা দেশ স্থিতিশীল হয়। উন্নত ধান চাষের ভিত্তি হলো বিজ্ঞানের ব্যবহার। বিজ্ঞানী ইউয়ান লোং পিং দেশ ও জনগণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। প্রযুক্তিগত পদ্ধতি পরিবর্তন হলেও সব চাষের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো ভালো ফসল পাওয়া।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সঙ্কর ধানের বার্ষিক উত্পাদনের আয়তন ২৪ কোটি মু ছাড়িয়ে যায় এবং প্রতি বছর ২৫ লাখ টন ধান উত্পাদন বৃদ্ধি পায়। চীন বাস্তবতা দিয়ে বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছে যে, চীনারা নিজের কাজের মাধ্যমে ১৪০ কোটি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম।

ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই শুধু চীনাদেরই সংগ্রাম নয়, বরং বিশ্ববাসীর সংগ্রাম। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক খাদ্য সংকট বিষয়ক রিপোর্ট-২০২১’ থেকে জানা গেছে, ২০২০ সালে ৫৫টি দেশ ও অঞ্চলে কমপক্ষে সাড়ে ১৫ কোটি মানুষ খাদ্যের সংকটে পড়ে বা আরো মারাত্মক আকস্মিক খাদ্যশস্যের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়।

বিদেশিরা বলেন, ইউয়ান লোং পিং যে জিনিস নিয়ে গবেষণা করেন তা হলো- ক্ষুধা নির্মূলকারী ‘পূর্বের যাদুকরী চাল’।

২০১০ সালে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর তত্কালীন মহাসচিব জোসেত্তে শিরান বলেছিলেন, মানুষ আমাকে জিজ্ঞেস করে, কেন আমি এতো বিশ্বাসী যে, আমাদের এই প্রজন্মের হাতে ক্ষুধা নির্মূল হবে? আমার উত্তর হলো ‘চীন’।

আফ্রিকার দ্বীপ দেশ মাদাগাস্কারের নতুন মুদ্রায় সঙ্কর ধানের ছবি ছাপানো হয়েছে।

সঙ্কর ধানের কল্যাণে মাদাগাস্কারের চাল আমদানির ইতিহাস শেষ হয়েছে। আগে ওই দেশের ২০ লাখ লোক দুর্ভিক্ষে পড়েছিল।

সঙ্কর ধান বিশ্বের খাদ্যসংকট সমাধানের ‘চীনা পরিকল্পনা’। সঙ্কর ধান উন্নত করা এবং বিশ্বের জনগণের কল্যাণ সৃষ্টি করা হলো ইউয়ান লোং পিংয়ের সারা জীবনের স্বপ্ন।

ইউয়ান লোং পিংয়ের মৃত্যু বিশ্বের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। জাতিসংঘ তার মাইক্রোব্লগে লিখেছে, ‘অ্যাকাডেমিশিয়ান ইউয়ান লোং পিং খাদ্যশস্যের নিরাপত্তা এগিয়ে নেওয়া, দারিদ্র্য নির্মূল করা এবং জনকল্যাণ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছেন।’

বিদেশি গণমাধ্যম তার মৃত্যুর খবর প্রচারের সময় প্রায়ই ‘সাহায্য’ শব্দটি ব্যবহার করে। ব্রিটেনের ‘দ্য ইন্ডিপেন্টেন্ট’ পত্রিকা তার প্রশংসা করে লিখেছে যে, তার উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত বিশ্বের মানুষকে সাহায্য করেছে। দ্য অ্যাসোসিয়েট প্রেস বা এপি বলেছে, তার গবেষণা সারা বিশ্বকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে।

গত বছর ইউয়ান লোং পিংয়ের ৯০ বছরের জন্মদিনে জার্মান গণমাধ্যম তাকে ‘বিশ্বের কল্যাণ সৃষ্টিকারী বীর বিজ্ঞানী’ হিসেবে উল্লেখ করে।

আসলে ইউয়ান লোং পিংয়ের মৃত্যুর খবর চীনের ইন্টারনেট জগতে শোক ছড়িয়ে পড়ে। বিদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তুমুল সাড়া পড়ে।

পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া ও ব্রাজিলসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের নেট ব্যবহারকারীরা বিশ্বের ধান চাষ ও খাদ্য নিরাপত্তায় ইউয়ান লোং পিংয়ের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ধন্যবাদ জানিয়েছে।

যেসব বিজ্ঞানী কৃষি নিয়ে গবেষণা করেন, তারা ইউয়ান লোং পিংয়ের সঙ্গে গ্রুপ ছবিও পোস্ট করেছেন। বাংলাদেশের একজন নেট ব্যবহারকারী টুইটারে বলেছেন, তিনি ইউয়ান লোং পিংয়ের কাছে অনেক কিছু শিখেছেন। তিনি হু নান প্রদেশে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, তার মৃত্যু হলো ‘বিশাল ক্ষতি’।

আসলে গত শতাব্দীর ৮০’র দশক থেকে ইউয়ান লোং পিং সঙ্কর ধানের প্রযুক্তিবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ ক্লাস চালু করেন। তিনি ৮০টিরও বেশি উন্নয়নশীল দেশের জন্য ১৪ হাজারেরও বেশি সঙ্কর ধানের প্রযুক্তিবিদকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

আগের একটি সাক্ষাত্কারে ইউয়ান লোং পিং বলেন, তার নামের পাশে অনেক উপাধি থাকলেও তিনি জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রধান উপদেষ্টার উপাধি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর দক্ষ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো আমার ইচ্ছা।’

‘একাডেমিশিয়ান ইউয়ান লোং পিংয়ের মৃত্যুর খবরে আমি দারুণ দুঃখ পেয়েছি। এই অনুভূতি যেন আমার আত্মীয়স্বজন হারানোর মতো বেদনা।’ ইউয়ান লোং পিং চলচ্চিত্রে ইউয়ান লোং পিংয়ের চরিত্রে অভিনয় করা বিখ্যাত অভিনেতা কুও চিং লিন এভাবেই বলেন।

তিনি এই চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে ১৩তম চীনের হুয়াবিও ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডের শ্রেষ্ঠ অভিনেতার খেতাব পেয়েছেন।

আসলে ২০০৮ সালে মুভিটি শুটিং করার সময় তিনিই প্রধান অভিনেতার একমাত্র প্রার্থী ছিলেন না। শুটিং দল আগে অন্য এক বিখ্যাত অভিনেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তবে তার দাবি করা সম্মানীর পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। তাই শুটিং দল মুভিতে অভিনয়ের জন্য কুও চিং লিকে আমন্ত্রণ জানায়। কুও জানিয়ে দেন, তিনি এই চরিত্রে অভিনয় করতে চান। কারণ ইউয়ান লোং পিং খুব সম্মানজনক একজন বিজ্ঞানী।

তিনি বলেন, আগে তিনি জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার একটি রিপোর্ট দেখেছিলেন। বিশ্বে প্রতি সাত সেকেন্ডে একজন মানুষ ক্ষুধার কারণে মারা যায়! ১৯৭৪ সালে রোমে বিশ্বের প্রথম খাদ্য সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয়। সেই সময় খুব হাস্যকর একটি ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। বলা হয়- বিপুল লোকসংখ্যা এবং কম ভূমির কারণে চীন ১০০ কোটি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না। তবে ইউয়ান লোং পিং হাস্যকর সেই ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণ করেছেন।

জীবনের শেষ আছে, তবে বিজ্ঞানের শেষ নেই। ইউয়ান লোং পিংয়ের উত্সাহে প্রজন্মের পর প্রজন্মের বিজ্ঞানীরা অব্যাহতভাবে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn