বাংলা

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বন্যা এবং বন্যা মোকাবিলা ও নদী শাসনে করণীয়

CMGPublished: 2024-09-06 10:43:37
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। এ অঞ্চলে ভৌগোলিক কারণে বন্যা প্রায়শই আঘাত হানে। বর্ষাকালে অতিবৃষ্টি, নদী ভাঙন এবং পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আসা পানি প্রবাহের কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়। সম্প্রতি ভারত বিভিন্ন বাঁধ খুলে দিলে দেশে প্রকট বন্যাও দেখা দেয়। এ ছাড়া, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যার তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের মানুষ এবং অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতি

বাংলাদেশের ফেনী, কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষ এমন ভয়াবহ বন্যা আগে দেখেনি। পানিবন্দি কয়েক লাখ মানুষ। ডুবে গেছে একতলা সমান সব কাঁচা-পাকা বাড়ি। বন্যার পানি বৃদ্ধি এত আকস্মিক ছিল যে ঘরের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরানোর সুযোগও পায়নি অধিকাংশ পরিবার। ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোও হয়ে উঠেছে দুরূহ।

দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে এবারের বন্যার কারণ নিয়ে দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বিশ্লেষকরা বলছেন, ত্রিপুরায় ভারী বৃষ্টি বন্যার একমাত্র কারণ নয়। ভারত বাঁধ খুলে দেওয়ায় উজান থেকে নেমে আসা পানি বাংলাদেশের ফেনী, কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলকে ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের যৌথ নদী কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা, অসতর্কতা ও সার্বিক অব্যবস্থাপনাও দায়ী।

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মো. এজাজ সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘ফেনী, নোয়াখালীর এবারের বন্যায় ত্রিপুরার জলবিদ্যুতের বাঁধ দায়ী। মুহুরির উজানের অববাহিকায় অবস্থিত মহারানি ড্যাম খুলে দেওয়া আরও একটি কারণ। অন্যদিকে ত্রিপুরাও ডুবছে, ফ্ল্যাশ ফ্লাড হয়েছে। উজানের নদীতে বাঁধ দেওয়া আন্তর্জাতিক আইনপরিপন্থি। গত চার দশকে ভারত সরকার প্রায় প্রতিটি নদীতেই বাঁধ, ব্যারেজ ও ড্যাম বানিয়েছে।’

বন্যা মোকাবিলার পদ্ধতি

বন্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রশাসন এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু দেশের ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে বন্যা মোকাবিলায় বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। যেমন:

১. ফ্লাড ওয়ার্নিং সিস্টেম: বাংলাদেশে বন্যার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য একটি বিশেষ সিস্টেম চালু রয়েছে। বন্যার আশঙ্কা থাকলে আগাম সতর্কবার্তা প্রদান করা হয়, যা জনগণকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে সহায়তা করে।

২. বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ: দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নদী ও বাঁধ নির্মাণ করে বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বাঁধগুলো নির্মাণ করে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়, তবে অনেক ক্ষেত্রেই বাঁধের উচ্চতা বা মান পর্যাপ্ত না হওয়ার কারণে এই পদ্ধতি সবসময় কার্যকর হয় না।

৩. পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়ন: পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা উন্নয়ন করে বন্যার পানি দ্রুত সরানোর চেষ্টা করা হয়। শহরাঞ্চলে ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও গ্রামাঞ্চলে খাল কেটে পানি নিষ্কাশনের পদক্ষেপ আরও কার্যকর করা দরকার।

৪. ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম: বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন ও ত্রাণ কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে পরিচালিত করতে হয়। ত্রাণ হিসেবে শুকনো খাবার, ওষুধ, এবং বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।

নদী শাসনে করণীয়

বাংলাদেশে নদী শাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ দেশের বেশিরভাগ বন্যা সমস্যার মূলে রয়েছে নদীর অতিরিক্ত পানি প্রবাহ ও অপ্রতুল শাসন। নদী শাসনের কিছু পদক্ষেপ তুলে ধরছি।

১. নদী খনন ও ড্রেজিং: বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। নিয়মিতভাবে নদী খনন বা ড্রেজিং করে নদীর পানির ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে, যাতে অতিরিক্ত পানি সহজে প্রবাহিত হতে পারে।

২. নদী তীর সংরক্ষণ: নদী ভাঙন রোধে নদীর তীর সংরক্ষণ করতে হবে। বিশেষ করে যেখানে নদী ভাঙনের ঝুঁকি বেশি, সেসব এলাকায় শক্তিশালী বাঁধ নির্মাণ এবং গাছপালা রোপণ করে ভাঙন প্রতিরোধ করতে হবে।

৩. বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ: দেশে অনেক বাঁধ থাকলেও অনেকগুলো জরাজীর্ণ হয়ে গেছে এবং প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কার্যকারিতা হারিয়েছে। এসব বাঁধের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন এবং নতুন বাঁধ নির্মাণের সময় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

৪. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: বাংলাদেশে বন্যা অনেকাংশেই পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর নদী থেকে আগত পানির কারণে হয়। এ জন্য পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং চুক্তি করে নদীর পানি বণ্টন ও প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।

৫. নদীজল সংরক্ষণ: বন্যার সময় অতিরিক্ত পানি সংরক্ষণ করা বা ব্যারেজ নির্মাণ একটি কার্যকর পদ্ধতি। পর্যাপ্ত পরিমাণে জলাধার, বাঁধ এবং খাল খননের মাধ্যমে বন্যার পানি সংরক্ষণ করা সম্ভব, যা পরবর্তী সময়ে সেচের কাজে ব্যবহার করা যায়।

শেষ কথা:

বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি উন্নয়নে সুষ্ঠু নদী শাসন অপরিহার্য। নিয়মিত নদী খনন, বাঁধ নির্মাণ, এবং পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের মতো কার্যকরী পদক্ষেপের মাধ্যমে বন্যার প্রভাব হ্রাস করা সম্ভব। সরকারের পাশাপাশি জনগণের অংশগ্রহণ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতির উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।

মোহাম্মদ তৌহিদ, সিএমজি বাংলা।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn