বাংলা

মার্কিন সমর্থিত তথাকথিত ‘গণতন্ত্রের জন্য সম্মেলন’ শুধু বিভাজন ও সংঘাত উস্কে দেয়

CMGPublished: 2024-03-24 18:25:58
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত তৃতীয় ‘গণতন্ত্রের জন্য সম্মেলন’ বুধবার সিউলে শেষ হয়েছে। ওয়াশিংটন আয়োজিত পূর্ববর্তী দুটি শীর্ষ সম্মেলনের বিপরীতে, এই বছরের সম্মেলনটি দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে আয়োজন করা হয়। তবে সংঘাত উস্কে দেওয়ার জন্য একটি হাতিয়ার হিসাবে এর মৌলিক প্রকৃতি অপরিবর্তিত ছিল।

ওয়াশিংটনের জোরালো প্রচার সত্ত্বেও, পূর্ববর্তী দুটি শীর্ষ সম্মেলনে কোন বাস্তব ফলাফল অর্জিত হয়নি। তৃতীয় সম্মেলনেও ইউক্রেন এবং গাজার বাস্তব সংকটের দিকে নজর দেওয়া হয়নি। পৃষ্ঠপোষক হিসাবে, ওয়াশিংটনের শীর্ষ সম্মেলনের একটি উদ্দেশ্য ছিল: অন্য দেশগুলোকে দমন করা এবং গণতন্ত্রের নামে বিশ্বকে বিভক্ত করা।

নিজেকে ‘গণতন্ত্রের বাতিঘর’ হিসাবে চিত্রিত করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের মশালের দীপ্তি বর্তমানে অনেকটাই ম্লান হয়ে এসেছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র নিজেরই মানবাধিকার ইস্যুসহ বহুবিধ অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত। খোদ মার্কিন নাগরিকরাই আমেরিকান গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস হারাচ্ছে।

পিউ সেন্টারের একটি জরিপ দেখায় যে ৬৫ শতাংশ আমেরিকান বিশ্বাস করেন, মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বড় সংস্কার প্রয়োজন, এবং ৫৭ শতাংশ উত্তরদাতারা মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘আর গণতন্ত্রের মডেল নয়’।

ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং বিস্তৃত সম্পদ বৈষম্য থেকে শুরু করে, ক্রমবর্ধমান সামাজিক বিভাজন এবং গভীর জাতিগত বৈষম্য, মার্কিন সমাজে সমস্যা সৃষ্টিকারী চ্যালেঞ্জের তালিকাও ক্রমবর্ধমান। এ অবস্থা আমেরিকান গণতন্ত্রের সাফাইকে আরও কম বিশ্বাসযোগ্য করে তুলছে।

নিজের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ-বিগ্রহ বাধিয়েছে এবং সাম্প্রতিক দশকগুলোতে অন্যান্য দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, বড় আকারের মানবিক বিপর্যয় ঘটিয়েছে।

২০০১ সাল থেকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস দমনের নামে শুরু করা যুদ্ধ এবং সামরিক অভিযানে ৯ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৩ লাখ ৩৫ হাজার বেসামরিক মানুষ। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া এবং লিবিয়ার মতো সার্বভৌম দেশগুলো মার্কিন আক্রমণ এবং প্রক্সি যুদ্ধের কারণে অবর্ণনীয় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে।

কেনিয়া-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পণ্ডিত ক্যাভিন্স আধেরে বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলি ‘গণতন্ত্র’ এবং ‘মানবাধিকার এর ব্যানারে অনেক দেশ এবং অঞ্চলে হস্তক্ষেপ করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘গণতন্ত্রের’ ধারণাকে অস্ত্রবাজিতে পরিণত করেছে এবং বিশ্বের মানুষ তাদের কথা খুব কমই বিশ্বাস করে বলে মনে করেন তিনি।

বছরের পর বছর ধরে, তথাকথিত ‘গণতন্ত্র জন্য সম্মেলন’গুলোর বিষয়ে মানবাধিকার কর্মীরা সমালোচনামুখর হয়েছেন। তাদের প্রশ্ন এই সম্মেলনগুলোতে অংশগ্রহণকারীরা অর্থপূর্ণ কোনো পদক্ষেপ নিতে সক্ষম কিনা?

গত বছরের সম্মেলনটি ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘর্ষকে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত করেছিল কিন্তু কোনো গঠনমূলক সমাধান নিয়ে আসেনি। বর্তমানে, ইউক্রেন সংকট দুই বছরে গড়িয়েছে এবং গাজা সংঘাতে ফিলিস্তিনি নিহতের সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে।

দুটি চলমান সংঘাত মানবিক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে, অথচ তা উপেক্ষা করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে অর্থায়ন অব্যাহত রেখেছে এবং গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের খসড়া প্রস্তাবগুলোতে একাধিকবার ভোটো দিয়েছে।

সিউল সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা তিন দিনের শীর্ষ সম্মেলনে এই জ্বলন্ত বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সাথে আলোচনা করেনি এবং বৃহস্পতিবার প্রকাশিত শীর্ষ সম্মেলনের চেয়ারের সারসংক্ষেপেও সেগুলো উল্লেখ করা হয়নি।

কোরিয়া-চীন সিটি ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান কওন কি-সিক, শীর্ষ সম্মেলনটিকে একটি শূণ্যগর্ভ জমায়েত বলে সমালোচনা করেছেন, যা সামনে থাকা বৈশ্বিক সংকটকে উপেক্ষা করে। ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন এবং দারিদ্র্যের মতো বিদ্যমান বৈশ্বিক সংকটগুলোর সমাধানের আলোচনার বেশি আগ্রহ দেখা যায় না তাদের মধ্যে। আদপেই সেটি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি সংঘাত উস্কে দেওয়ার প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য, শীর্ষ সম্মেলনটিকে তার আন্তর্জাতিক অবস্থানের একটি রাজনৈতিক প্রদর্শন হিসেবে দেখাতে চেয়েছে। কিন্তু দেশটির সংবাদ মাধ্যমই তার সমালোচনা করেছে। দেশটির সংবাদপত্র কিয়ংহিয়াং শিনমুন সম্প্রতি একটি সম্পাদকীয়তে বলেছে,

দক্ষিণ কোরিয়ার ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতির পশ্চাদপসরণ’ দেখে, ‘আমাদের গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব’ নিয়ে সরকারের গর্ব বেশিরভাগ নাগরিককে হতাশ করেছে।

স্নায়ুযুদ্ধের শেষের পর থেকে, বিশ্ব বহুপাক্ষিকতার প্রতি ক্রমবর্ধমান সমর্থন ও আস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু ওয়াশিংটন, এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বজায় রাখতে একগুঁয়েমি করছে।

হানকুক ইউনিভার্সিটি অফ ফরেন স্টাডিজের আইন স্কুলের ইমেরিটাস অধ্যাপক লি জ্যাং-হি’র অভিমত, পূর্ব এশিয়ায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীন ও রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে একটি জোট গড়তে চাইছে এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ‘গণতন্ত্রের সম্মেলন বসিয়ে একটি ‘নতুন শীতল যুদ্ধ’ তৈরি করতে চাইছে।

তাই এ কথা বলাই যায়, ওয়াশিংটনের স্পন্সর করা এবারের শীর্ষ সম্মেলনটিরও সারমর্ম হ'ল গণতন্ত্রের সামরিকীকরণ, বিভাজনকে উত্সাহিত করা এবং মার্কিন আধিপত্য রক্ষা করা।

মাহমাদ হাশিম

সিএমজি বাংলা, বেইজিং।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn