মহাপ্রাচীরের গাইড চাং সিয়াও ইয়েন
স্নাতক শিক্ষার্থীদের জন্য একটি চাকরি-মেলা সম্প্রতি নানচিং তথ্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত হয়। চীনের আবহাওয়া ব্যুরোসহ বিভিন্ন প্রদেশ ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের আবহাওয়া বিভাগের মোট ২৫৭টি সরকারি প্রতিষ্ঠান এ চাকরি-মেলায় অংশগ্রহণ করে। এসব প্রতিষ্ঠানে ২৪০০টিরও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। চলতি বছর আবহাওয়া-গবেষণার সাথে জড়িত দক্ষ ব্যক্তিদের চাহিদা বেড়েছে এবং এআই প্রযুক্তির সাথে জড়িত দক্ষ ব্যক্তিরা ছিল চাকরি-মেলায় বেশ জনপ্রিয়। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চীনের বিভিন্ন এলাকার আবহাওয়া বিভাগে কর্মসংস্থানের সুযোগ ও চাহিদা নিয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরবো।
২০২৫ সালে বেইজিং আবহাওয়া ব্যুরো দুটি নতুন পদ সৃষ্টি করে। এসব পদে নিয়োগের জন্য, বিগ ডেটা বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, কম্পিউটার প্রয়োগ প্রযুক্তি, এআই, আর সফ্টওয়ার প্রকৌশলসহ বিভিন্ন মেজরের স্নাতক শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন করা হবে। এ সম্পর্কে বেইজিং আবহাওয়া ব্যুরোর উপপ্রধান চিং হাও বলেন, বর্তমানে বিভিন্ন আবহাওয়া বিভাগ বুদ্ধিমান আবহাওয়া পূর্বাভাস ব্যবস্থা ও প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করছে। নির্দিষ্ট ও নির্ভুল আবহাওয়া পূর্বাভাস পরিষেবা দেওয়া তাদের লক্ষ্য। তবে, এ পরিষেবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও বিগ ডেটার ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে বেইজিংয়ের আবহাওয়া বিভাগ প্রতি ঘন্টার আবহাওয়ার পরিবর্তন ও পূর্বাভাস করতে পারে এবং বিস্তারিত ভৌগোলিক অবস্থান অনুসারে প্রতি কিলোমিটার এলাকায় আবহাওয়ার পরিবর্তন সুনির্দিষ্টিভাবে পূর্বাভাস করতে পারে। তবে, আরও বিস্তারিত ও নির্ভুল তথ্য জানতে বা জানাতে চাইলে উন্নত এইআই প্রযুক্তি প্রয়োজন।
চীনের কুয়াংতং প্রদেশের আবহাওয়া বিভাগ ২০২৫ সালে নতুন করে ৭৩টি কর্মসংস্থানের সুযোগ দেবে। তারা এআই প্রযুক্তি, গণিতসহ বিভিন্ন মেজরের স্নাতক শিক্ষার্থীদের নিয়োগ করতে চায়। এ ক্ষেত্রে চাকরিপ্রার্থীদের মাস্টার্স বা ডক্টরেট ডিগ্রি থাকতে হবে।
আবহাওয়ার সাথে জড়িত কয়েকটি মেজরের শিক্ষার্থীরা চাকরি-মেলায় কর্মসংস্থানের সুযোগ পেতে পারেন। আবহাওয়া, গণিত ও পদার্থবিদ্যা, তথ্যপ্রযুক্তি, মিডিয়া প্রচার, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, ফাইন্যান্স অ্যাকাউন্টিং, বহুমুখী প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের স্নাতক শিক্ষার্থীরা চাকরির জন্য আবেদন করতে পারেন।
এ চাকরি-মেলা নানচিং তথ্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজন করেছে। তবে, চীনের ফুতান বিশ্ববিদ্যালয়, নানচিং বিশ্ববিদ্যালয়, চোংশান বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মেলায় অংশ নিতে আসেন।
চোংশান বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ু বিজ্ঞান গবেষণা বিভাগের মাস্টার্স শিক্ষার্থী সিয়াও ক্য সংবাদদাতাকে বলেন, তিনি কুয়াংচৌ থেকে নানচিংয়ে এসেছেন চাকরি-মেলায় যোগ দিতে। কারণ, এ চাকরি-মেলা বেশ বড়, সবাই এখান থেকে উপযুক্ত ও সেরা চাকরি খুঁজতে আগ্রহী।
নানচিং তথ্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট শিক্ষার্থী ইয়াং ইং চাকরি-মেলায় মোট তিনটি সিভি পাঠিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করার পর তিনি খেয়াল করেন যে, এআই প্রযুক্তি, মেরু জলবায়ু গবেষণার সাথে জড়িত দক্ষ ব্যক্তিদের চাহিদা বেশি। শিক্ষার্থী ইয়াং প্রধানত পূর্ব এশিয়ার জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করে থাকেন। তাই, এআই প্রযুক্তি ও মেরু জলবায়ুর সাথে জড়িত চাকরি পাওয়ার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী।
বস্তুত, এবারের চাকরি-মেলায় আবহাওয়ার সাথে জড়িত ২০০টিরও বেশি চাকরির সুযোগ প্রদান করা হয়। এতে সমুদ্র নেভিগেশন, প্রাকৃতিক পরিবেশ, সমুদ্র বিজ্ঞান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ এবং পদার্থবিদ্যাসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
নানচিং তথ্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ছেন হাই শান বলেন, চলতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১ হাজার ১৯২ জন, যাদের মধ্যে ১৬৩২ জন আবহাওয়া বিভাগের এবং আবহাওয়ার সাথে জড়িত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১১১ জন। এসব শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন প্রদেশের ১৫টি আঞ্চলিক সরকারের সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। পাশাপাশি, হুয়াওয়ে, টেসেন্ট, সিয়াওমি-সহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করে মোট ১২০০টিরও বেশি শ্রেষ্ঠ কোম্পানি বেছে নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন ধরনের চাকরি-মেলা আয়োজন করে থাকে। গত ৩ বছরে কর্মসংস্থানের সুযোগ ১ লাখেরও বেশি দাঁড়িয়েছে, যা স্নাতক শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সুবিধা দিয়েছে।
মহাপ্রাচীরের গাইড চাং সিয়াও ইয়েন
চীনের মহাপ্রাচীর বিশ্ববিখ্যাত। এটি বিশ্বের বিস্ময়কর পুরাকীর্তিগুলোর অন্যতম। চীনের অনেক এলাকায় মহাপ্রাচীরের অংশ আছে। এর মধ্যে বেইজিইংয়ের চিয়াইয়ুকুয়ান মহাপ্রাচীর অনেক জনপ্রিয়। এখানে একজন সুবিখ্যাত গাইড টানা ২০ বছর ধরে পর্যটকদের পরিষেবা দিয়েছেন এবং তাঁর মাধ্যমে দেশী-বিদেশী পর্যটকরা চিয়াইয়ুকুয়ান মহাপ্রাচীরের ইতিহাস ও নির্মাণের গল্প জানতে পেরেছেন। এই গাইডের নাম চাং সিয়াও ইয়ান।
বস্তুত, গাইড চাং সিয়াও ইয়ান এখন সাংস্কৃতিক গবেষক হিসেবে কাজ করে থাকেন। তিনি কেবল পর্যটকদের কাছে মহাপ্রাচীরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি তুলে ধরেননি, বরং বিভিন্ন স্কুল, আবাসিক এলাকা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে আরও বেশি লোকদের সামনে মহাপ্রাচীরসম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন।
২০০১ সালের জুলাইয়ে, ১৮ বছর বয়সের মেয়ে চাং সিয়াও ইয়ান, হ্যনান প্রদেশ থেকে প্রথমবারের মতো চিয়াইয়ুকুয়ান মহাপ্রাচীরে আসেন। সেটি ছিল তাঁর প্রথম মহাপ্রাচীর দর্শন। তিনিও তখন অন্যান্য পর্যটকের সাথে গাইডের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। তখন থেকেই তিনি ভাবতে থাকেন, একদিন গাইডের মতো এখানকার ইতিহাস ও মজার গল্প সবার সাথে শেয়ার করবেন। একই বছরের শেষ দিকে তিনি চিয়াইয়ুকুয়ান মহাপ্রাচীরের গাইড হিসেবে কাজ করতে নিবন্ধন করান এবং সফল হন।
যখন তাঁর কাজ শুরু হয়, তখন জানতে পারেন যে, মহাপ্রাচীরে ওঠানামা গাইডের শরীরের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং। শীতকালে মহাপ্রাচীরে প্রচণ্ড বাতাস থাকে এবং গ্রীষ্মকালে সুর্যালোকে এ মহাপ্রাচীরে আরোহণ করা বেশ কষ্টের কাজ। তবে, তিনি বিভিন্ন কষ্ট সহ্য করে, পরিশ্রমের সাথে গাইডের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
নিজের কাজের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে গাইড চাং বলেন, ‘আমি অন্তর্মুখী মানুষ। তাই, অপরিচিত লোকদের সাথে কথা বলা আমার জন্য বড় চ্যালেঞ্জের ব্যাপার।’ তবে, ভালো করে গাইডের কাজ করার জন্য, তিনি সংশ্লিষ্ট তথ্য ও কথা মুখস্ত করতে চেষ্টা করেন। বার বার চর্চার পর তিনি সুন্দরভাবে কাজটি করা শেখেন। তার ম্যান্ডারিন ভাষার চর্চা চলতে থাকে। ছুটির দিনে বিভিন্ন বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে থাকেন। এমন চর্চার মাধ্যমে তাঁর গাইড করার ক্ষমতা দ্রুত উন্নত হয়।
প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত, ৭ থেকে ৮টি পর্যটক দল নিয়ে, তাকে মহাপ্রাচীর ঘুরে দেখতে হয় এবং সারা বছর ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে তার সময় কাটে। নিজের ব্যস্ত কর্মজীবন সম্পর্কে চাং বলেন, ‘এটি আমার জন্য আনন্দের ব্যাপার। প্রতিবার নতুন পর্যটকদের সাথে দেখা হয়। এ অভিজ্ঞতা বেশ মজার।’
বহু বছর ধরে গাইড চাং সিয়াও ইয়ান মনোযোগ দিয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি মনে করেন, যদি শুধু মহাপ্রাচীরকে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়, তবে তা পর্যটকদের সঠিক তথ্য দেবে না। কারণ, মহাপ্রাচীর ইতিহাস, সংস্কৃতি, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত। তাই, ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এর পরিচয় তুলে ধরা জরুরি।
মহাপ্রাচীরের ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার পর চাং খেয়াল করেন যে, চিয়াইয়ুকুয়ান মহাপ্রাচীর জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে ও বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে। যখন তিনি কোনো মজার ইতিহাস বা গল্প সম্পর্কে অবগত হন, সেটি লিখে রাখতেন। সেগুলো তিনি পর্যটকদের সামনে তুলে ধরতেন। ধীরে ধীরে তাঁর নোটবুকে ২ লাখেরও বেশি অক্ষর সংযুক্ত হয়। অন্য গাইডদের তুলনায় তার পরিবেশিত তথ্য-উপাত্ত বরাবরই বেশি সমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয়। তাই, তিনি গাইডের বিশেষজ্ঞের মতো বিশেষ মর্যাদা পেয়েছেন। যখন গুরুত্বপূর্ণ অতিথি এ মহাপ্রাচীর ঘুরে দেখতে আসেন, তখন গাইড চাং সিয়াও ইয়ানের ডাক পড়ে।
গত ২০ বছরে গাইড চাং সিয়াও ইয়ান মোট ৩ লাখেরও বেশি পর্যটককে সেবা দিয়েছেন। ২০১৬ সালের শেষ দিকে চিয়াইয়ুকুয়ান মহাপ্রাচীরের ইতিহাস ভালো করে জানার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট গবেষণা একাডেমিতে যোগ দেন এবং মহাপ্রাচীরের সাথে জড়িত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণ ও গবেষণার কাজে অংশ নেন।
টানা ২০ বছরের গবেষণা ও নিজের নোটবুকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে গাইড চাং নিজের বই রচনা করেছেন। এর সঙ্গে সঙ্গে ৩০টিরও বেশি থিসিস লিখেছেন এবং প্রাদেশিক পর্যায়ের গবেষণা প্রকল্প প্রস্তাব করেছেন। ২০২২ সালের শুরুতে তিনি মহাপ্রাচীরের সাথে জড়িত ৯০টি সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বেছে নিয়ে, বিশেষ প্রদর্শনীতে প্রাচীনকালে বিভিন্ন জাতির লোকদের মধ্যে বিনিময়ের গল্প তুলে ধরেন।
অনেক পর্যটকের জন্য চিয়াইয়ুকুয়ান মহাপ্রাচীর শুধু একটি দর্শনীয় স্থান বা ল্যান্ডমার্ক, তবে ইতিহাসে এ মহাপ্রাচীর রেশমপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল। এটি চীনাদের সাথে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতির বিনিময় ও আদানপ্রদানের স্বাক্ষী।
গাইড চাং সিয়াও ইয়ানের মাধ্যমে বহু লোক মহাপ্রাচীরের ইতিহাস ও গল্প সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। সবাই এ তথ্যের আলোকে মহাপ্রাচীর সংরক্ষণে নিজ নিজ ভুমিকা পালন করবেন বলে আশা করা যায়