বাংলা

চীনের হাইড্রোঅ্যাকোস্টিক প্রকৌশলবিদ্যার জনক জনাব ইয়াং শি এয়ের গল্প

CMGPublished: 2024-10-07 17:00:45
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

চীন বিশাল একটি দেশ। এ দেশের উপকূলরেখার মোট দৈর্ঘ্য ৩২ সহস্রাধিক কিলোমিটার। দেশে সমুদ্রের সাথে জড়িত হাইড্রোঅ্যাকোসটিক প্রকৌশলের গবেষণাও অতি গুরুত্বপূর্ণ। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চীনের হাইড্রোঅ্যাকোসটিক প্রকৌশল গবেষণার জনক ও অন্যতম একাডেমিশিয়ান ইয়াং শি এ’র গল্প তুলে ধরবো। তিনি আজীবন চীনের হাইড্রোঅ্যাকোসটিক প্রকৌশলের গবেষণায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং তাঁর নেতৃত্বে গবেষকদের যৌথ প্রয়াসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি অর্জন করেছে দেশটি। চীনা বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো বড় ও গভীর সমুদ্রের শাব্দিক ব্যাপক জরিপ ও অনুসন্ধান কাজ সম্পন্ন করেছেন। তবে, চলতি বছরের ১৯ মার্চ ৯৩ বছর বয়সী অধ্যাপক ইয়াং শি এ হারবিন শহরে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু চীনের হাইড্রোঅ্যাকোসটিক প্রকৌশলের গবেষণার জন্য বড় ক্ষতি। আজকে আমরা জনাব ইয়াং শি এ’র গবেষণা ও অবদান নিয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরবো।

১৯৩১ সালে ইয়াং শি এ জন্মগ্রহণ করেন। তখন চীনে যুদ্ধের কারণে সবার জীবন কষ্টের মধ্যে ছিল। ছোটবেলা থেকে তিনি ভালো করে পড়াশোনা করে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেন। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর, তিনি ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগ থেকে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আবেদন করেন এবং পরে চীনের প্রথম নৌবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ করেন।

১৯৫২ সালে চীনা গণমুক্তি ফৌজের সামরিক প্রকৌশল একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতিকাজ শুরু হয়। সেটি ছিল চীনের প্রথম বহুমুখী সামরিক প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় হারবিন শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে এর নাম বদলে রাখা হয় হারবিন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। কাজের কারণে শিক্ষক ইয়াং আবার হারবিনে যান।

১৯৫৭ সালে চীনের হাইড্রোঅ্যাকোসটিক প্রকৌশলের গবেষণার শূন্যতা পূরণে সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশোনা করতে যান তিনি। তখন তিনি খেয়াল করেন যে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির পরীক্ষাগার বিদেশিদের জন্য কখনও খোলা থাকে না। তাই, বিদেশ থেকে কোনো উন্নত প্রযুক্তি কেনা বা তা নিয়ে গবেষণা করা সম্ভব ছিল না। নিজের প্রচেষ্টায় শূন্য থেকে গবেষণার কাজ শুরু করতে হয় তাকে। তখন থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, চীনা ‘কান’ দিয়ে সমুদ্রের শব্দ শুনতে হবে, নিজের প্রচেষ্টায় হাইড্রোঅ্যাকোসটিক প্রকৌশলের গবেষণায় অগ্রগতি অর্জন করতে হবে।

১৯৬০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর, তিনি হারবিন সামরিক প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বহুমুখী হাইড্রোঅ্যাকোসটিক প্রকৌশলের গবেষণা বিভাগ চালু করেন। তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী পাঠ্যপস্তুক রচনা করেন এবং ‘শব্দ নীতি’ ও ‘পানির নিচে শব্দ প্রচারের নীতি’-সহ কয়েকটি পাঠ্যপস্তুক ও বই প্রকাশ করেন।

১৯৮০ সালের ১৮ মে চীনের প্রথম আইসিবিএম ‘তংফেং ৫’ চিউছুয়ান ক্ষেপণাস্ত্র কেন্দ্র থেকে নিক্ষেপ করা হয় এবং পরিকল্পিতভাবে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। অধ্যাপক ইয়াং ও তাঁর গবেষকদল জাহাজবাহী হাইড্রোঅ্যাকোস্টিক ব্যবস্থার মাধ্যমে, সংশ্লিষ্ট তথ্য সনাক্ত করেন এবং সাফল্যের সঙ্গে ‘তংফেং ৫’-এর অবস্থান চিহ্নিত করেন। তখন থেকে চীন নিজের গবেষণা থেকে সৃষ্ট আইসিবিএম অর্জন করে। ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করে বিশ্বের মঞ্চে দাঁড়ায় চীন।

তবে হাইড্রোঅ্যাকোস্টিক ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্দিষ্টভাবে বিশাল সমুদ্রে ‘তংফেং ৫’-এর অবস্থান চিহ্নিত করা অধ্যাপক ইয়াং ও তাঁর গবেষকরা প্রায় ১০ বছর সময় নিয়ে গবেষণা করেন। শুরুর দিকে কেউ জানতেন না, যখন আইসিবিএম সমুদ্রে পড়ে, তখন শব্দ কী ধরনের হবে। তবে, এ কাজ জাতীয় নিরাপত্তার সাথে জড়িত, তাই শূন্য থেকে সংশ্লিষ্ট গবেষণার কাজ শুরু করেন ইয়াং।

৭০ বছর ধরে অধ্যাপক ইয়াংয়ের নেতৃত্বে চীনের হাইড্রোঅ্যাকোসটিক প্রকৌশল গবেষণা শূন্য থেকে বিশ্বের উন্নত মানে দাঁড়ায়। সমুদ্রে খনিজ সম্পদের অনুসন্ধান, জাহাজ নেভিগেশন, সমুদ্রের নিচে সামুদ্রিক সম্পদ উন্নয়ন, এবং সমুদ্রের জলসীমা রক্ষার মতো যে-কোনো ক্ষেত্র হাইড্রোঅ্যাকোসটিক প্রকৌশলের সাথে জড়িত।

দক্ষিণ চীন সাগর চীনের বৃহত্তম সামুদ্রিক এলাকা এবং গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক চ্যানেল। ১৯৯৪ সালের এপ্রিল মাসে চীনে প্রথমবারের মতো হাইড্রোঅ্যাকাস্টিক জরিপ শুরু হয়। এটি চীনের হাইড্রোঅ্যাকাস্টিক বিজ্ঞানের বহুমুখী ফিল্ড জরিপ এবং উপকূলীয় এলাকা থেকে গভীর সমুদ্রের প্রথম যাত্রা। অধ্যাপক ইয়াং দুটি হাইড্রোঅ্যাকাস্টিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা-জাহাজ ও শতাধিক গবেষক নিয়ে এ যাত্রায় অংশ নেন। যখন বিষুবরেখার কাছাকাছি পৌঁছান, জাহাজের ডেকের তাপমাত্রা তখন ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চরম উষ্ণ ও গরম আবহাওয়ায় খাদ্য ও পানির অভাবে ৬০ বছর বয়সের অধ্যাপক ইয়াং জাহাজের ব্যালাস্ট জল সিদ্ধ করে খেয়েছেন। তিনি বলেন, বিজ্ঞান গবেষণার কাজ যেন যুদ্ধের মতো, বিজ্ঞানীদের সৈন্যদের মতো অসাধারণ ইচ্ছাশক্তি ও অধ্যবসায়ের পরিচয় দিতে হয়।

অধ্যাপক ইয়াং এবং তাঁর গবেষকদলের যৌথ প্রয়াসে, হাইড্রোঅ্যাকোস্টিক পজিশনিং পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। এ তত্ত্বের মাধ্যমে, চীনের ‘ড্রাগন’ মানববাহী সাবমেরিন গবেষণা ও ডিজাইন করা হয়। চীনের হাইড্রোঅ্যাকোস্টিক গবেষণার উন্নয়নের পরিকল্পনা, হাইড্রোঅ্যাকোস্টিক গবেষণার দিক, এবং এর সাথে জড়িত বিজ্ঞান-গবেষণা ও প্রকৌশল স্থাপনে অধ্যাপক ইয়াং অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং তাঁর চিন্তাভাবনা সবসময় বাস্তবতার চেয়ে অগ্রসর ছিল।

২০১৬ সালে ৮৫ বছর বয়সের অধ্যাপক ইয়াং চীনের জাতীয় সমুদ্র ব্যুরোর বিশেষ পদক লাভ করেন। তবে, তাঁর গবেষণাকাজ কখনও থামেনি। পরীক্ষার সরঞ্জামের গবেষণা ও তৈরি, সমুদ্রের জলবিদ্যুত অবস্থা পরীক্ষা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের মতো বিভিন্ন কাজে তিনি নিজেকে ব্যস্ত রাখেন।

যুব গবেষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় অধ্যাপক ইয়াং সবসময় বলেন, সমুদ্র দেশের নীল ভূভাগ, প্রত্যেকের উচিত তা ভালো করে রক্ষা করা। ৯০ বছর বয়সেও তিনি নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ক্লাস নিতেন। তিনি কালো বোর্ডে চমত্কার কথা লিখতেন, মনোযোগ দিয়ে মজার কথার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য বৈজ্ঞানিক তথ্য তুলে ধরতেন। ক্লাসশেষে শিক্ষার্থীরা তাঁর সাথে ছবি তুলতো এবং সমুদ্র-বিজ্ঞানের সাথে জড়িত প্রশ্ন করতো। তিনি ধৈর্যের সাথে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন। যখন স্নাতক শিক্ষার্থীদের থিসিস সংশোধন করতেন, তখন তিনি প্রত্যেকটি থিসিস মনোযোগ দিয়ে দেখতেন; প্রয়োজনীয় সংশোধনের পরামর্শ লিখে দিতেন। তিনি কখনও সহপাঠী বা ছাত্রছাত্রীদের সাথে রাগ করতেন না। কিন্তু সবাই তাঁকে বেশ সম্মান করতো এবং সবার ওপর তার একটি প্রভাব ছিল।

২০১৮ সালে ৮৭ বছর বয়সের অধ্যাপক ইয়াং যুব-কর্মীদের মতো সমুদ্রের পরীক্ষায় অংশ নেন। যখন সমুদ্রের পর্যবেক্ষণ কাজে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতেন, যুব গবেষকরা তখন নিশ্চিন্ত থাকতেন এই ভেবে যে, ইয়াংয়ের পরামর্শে সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

চলতি বছরের ১৯ মার্চ ৯৩ বছর বয়সের অধ্যাপক ইয়াং শি এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে স্বর্গবাসী হন। তাঁর ছাত্র চাং হাই কাং এখন হারবিন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইড্রোঅ্যাকোস্টিক প্রকৌশল একাডেমির উপপ্রধান। ডক্টর ইয়াংয়ের কথা স্মরণ করে তাঁর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়। অধ্যাপক ইয়াংয়ের জীবনের শেষ দিকে চাং সবসময় তাঁর পাশে থাকতেন, যত্ন নিতেন। যখন অধ্যাপক ইয়াং অসুস্থ হন, তার কথা বলতে কষ্ট হতো। অথচ, শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানবিষয়ক প্রশ্ন করলে, তিনি জবাব দেওয়ার চেষ্টা করতেন। গবেষকদের জন্য অধ্যাপক ইয়াং যেন বাতিঘরের মতো ছিলেন।

১৮ সেপ্টেম্বর হারবিন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইড্রোঅ্যাকোস্টিক ইঞ্জিনিয়ারিং একাডেমির পরীক্ষাগারে ২০২০ সালের ডক্টরেট গবেষক হান মিং ছিয়ান ব্যস্ততার মধ্যে কাজ করছিলেন। তিনি বলেন, এখনও সমুদ্রের নিচে নতুন অনুসন্ধানের পদ্ধতি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছেন। অতীতকালের প্রযুক্তির তুলনায় নতুন সংকেত প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতিতে আরও বেশি তথ্য পাওয়া যায়।

হান মিং ছিয়ান অধ্যাপক ইয়াংয়ের ছাত্র। ৪ বছর আগে ইয়াংয়ের সহায়তায় তিনি ডক্টরেট থিসিস ও গবেষণার বিষয় ঠিক করেন। যদিও সেই সময় অধ্যাপক ইয়াংয়ের বয়স ৯০ বছর, তবে তিনি ভালো করে সর্বশেষ হাইড্রোঅ্যাকোস্টিক গবেষণার ফলাফল জানতেন। অধ্যাপক ইয়াংয়ের সাহায্যে হান গবেষণায় বিরাট সাফল্য অর্জন করেন।

যখন অধ্যাপক ইয়াং হাসপাতালে ভর্তি হন, তখন তিনি সবসময় তাঁর ছাত্রছাত্রীকে বলতেন, তোমাদের গবেষণার কাজ অবশ্যই দেশের চাহিদা বিবেচনা করে ঠিক করতে হবে। তাঁর ছাত্র চাং হাই কাং স্মরণ করে বলেন, প্রায় ২ বছর আগে ৯১ বছর বয়সের অধ্যাপক ইয়াং শি এ যখন ক্লাস নিতেন, তখনও তিনি একই কথা বলতেন। দেশের চাহিদা মেটাতে হলে আমাদের প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ। অধ্যাপক ইয়াংয়ের নেতৃত্বে হারবিন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় চীনের জাতীয় হাইড্রোঅ্যাকোস্টিক বিদ্যার মেধাবী ও দক্ষ গবেষকদের প্রশিক্ষণকেন্দ্রে পরিণত হয়। চীনের হাইড্রোঅ্যাকোস্টিক বিদ্যার ৬০ শতাংশ পেশাদার কর্মী ও ৭০ শতাংশ বিশেষজ্ঞ এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছেন। ১১০ জনেরও বেশি হাইড্রোঅ্যাকোস্টিক বিদ্যার মাস্টার্স ও ডক্টরেট শিক্ষার্থী স্নাতক হওয়ার পর এ গবেষণার বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ কর্মীতে পরিণত হয়েছেন।

যদিও অধ্যাপক ইয়াং চিরদিনের মতো বিদায় নিয়েছেন, তবে তাঁর গবেষণার চেতনা ও তত্ত্ব এবং হাইড্রোঅ্যাকোস্টিক বিদ্যার প্রতি ভালোবাসা ও আবেগ নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের জন্য দৃষ্টান্তস্বরূপ। তাঁরা দেশের চাহিদা বিবেচনা করে গবেষণার কাজ ও নতুন প্রযুক্তি আয়ত্বের চেষ্টা করেন। এটি অধ্যাপক ইয়াংয়ের জন্য বড় সান্ত্বনা।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn