শিশু-শিক্ষার্থীদের দাঁতের সমস্যা ও সমাধান
আজকের অনুষ্ঠানে চীনা পিতামাতাদের একটি কমন উদ্বেগের বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো। আর সেটি হচ্ছে শিশু-শিক্ষার্থীদের দাঁতের সমস্যা ও এর সমাধান। ছুটির দিনগুলোতে, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন ছুটিতে, চীনের বিভিন্ন এলাকার হাসপাতালে অনেক শিশু-শিক্ষার্থীকে দেখা যায়। সাধারণত, ছুটির দিনগুলোতে সংশ্লিষ্ট পিতামাতারা বাচ্চাদের নিয়ে চোখ ও দাঁতের ডাক্তারের কাছে যান। বর্তমানে চোখ ও দাঁতের সমস্যায় ভুগছে—এমন চীনা শিশু-শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক।
চীনা পিতামাতারা আজকাল বাচ্চাদের দাঁতের ওপর অনেক গুরুত্ব দিচ্ছেন। ছুটির দিনে, হাসপাতালের ডেন্টাল ক্লিনিকগুলোতে, অনেক বাচ্চা দেখা যায়। সংশ্লিষ্ট পিতামাতা আশা করেন, দ্রুত তাদের বাচ্চার দাঁতের সমস্যার সমাধান হবে।
রাজধানী বেইজিংয়ের হাইতিয়ান এলাকার মা চেং লি মেয়ের দাঁতের সমস্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাঁর মেয়ে প্রাথমিক স্কুলে পড়াশোনা করছে। তার দাঁতগুলো খানিকটা আঁকাবাকা, বিশৃঙ্খল। অনেকে ডাক্তারের কাছে গিয়ে এ সমস্যা সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন। তবে পরিবারের প্রবীণদের বক্তব্য ভিন্ন। তাঁরা মনে করেন, এখন বাচ্চার বয়স কম, বড় হলে দাঁতগুলোর আঁকাবাকা অবস্থাটা থাকবে না। আবার কেউ কেউ বলেন, খানিকটা আঁকাবাকা দাঁত দেখতে সুন্দর।
ম্যাডাম চেং শুধু অনেক চীনা পিতামাতার মধ্যে একজন। আরও অনেকে একই সমস্যা নিয়ে আছেন। এ সম্পর্কে বেইজিং মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টোমাটোলজিক্যাল হাসপাতালের অর্থোডন্টিক্স বিভাগের পরিচালক, ডাক্তার সিয়ে সিয়ান চ্যু বলেন, এ ধরনের সমস্যায় পিতামাতার উদ্বিগ্ন হওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কারণ, পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, চীনে বাচ্চাদের মধ্যে দাঁতের ম্যালোক্লুশনে আক্রান্তের সংখ্যা ৭০ শতাংশ। খাবার দিন দিন উন্নত হচ্ছে, খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে, চোয়ালের ব্যবহার বেড়েছে, ফলে সংশ্লিষ্ট চোয়ালের চুইং ফাংশনের ক্ষমতাও কমছে।
প্রশ্ন হচ্ছে: ম্যালোক্লুশন বাচ্চাদের দাঁতের ওপর কোন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে? প্রথমত, দাঁতের অক্লুসাল ফাংশনের দুর্বলতা দেখা দেয়। দাঁতের মূল ভুমিকা বিভিন্ন ধরনের খাবার অক্লুসাল করা বা চিবানো, যা মানুষের পাচনতন্ত্রের প্রথম কাজ। যদি দাঁতের কারণে ভালো করে খাবার অক্লুসাল করা না যায়, তাহলে সংশ্লিষ্ট পাচনতন্ত্রের প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং স্বাস্থ্যের জন্যও তা ক্ষতিকর। তা ছাড়া, দাঁতের দুর্বলতার কারণে স্পষ্টভাবে শব্দ উচ্চারণ করাও অনেক সময় সম্ভব না হতে পারে। আর, দাঁতের বিশৃঙ্খলার কারণে যখন ব্রাশ করা হয়, তখন পুরোপুরি তা পরিষ্কার করা যায় না। এতে দাঁতের ক্যারিজসহ অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
অবশ্যই বিশৃঙ্খল দাঁত চেহারার সৌন্দর্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নিচের দাঁত বা উপরের দাঁত, বিশেষ করে সবচেয়ে মাঝখানের দাঁতের বিশৃঙ্খলা, বাচ্চাদের মুখের সৌন্দর্য কমায়। কেউ কেউ জেনেটিক কারণেও এ ধরনের সমস্যায় ভোগে। বাবা-মায়ের এ সমস্যা ছিল, এখন বাচ্চাদেরও একই সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।
প্রশ্ন হচ্ছে: বিশৃঙ্খল দাঁত ঠিক করতে কোন বয়সে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত? এ সম্পর্কে ডাক্তার সিয়ে বলেন, দাঁতের চিকিত্সার জন্য সঠিক সময় বেছে নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণভাবে, ৪, ৮, ১২ ও ১৮ বছর বয়সে পেশাদার ডেন্টিস্টের শরণাপন্ন হওয়া দরকার। দাঁতের ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখবেন, কী ধরনের চিকিত্সা প্রয়োজন বা আদৌ চিকিত্সার প্রয়োজন আছে কি না।
ডাক্তার সিয়ে উদাহরণ দিয়ে বলেন, একজন ৭/৮ বছর বয়সের বাচ্চার যখন কয়েকটি স্থায়ী গজায়, তখন মাঝখানের দাঁতগুলো বিশৃঙ্খল হতে পারে, যা স্বাভাবিক ব্যাপার। যদি খেতে সমস্যা না হয়, তাহলে চিকিত্সার দরকার নেই। কারণ, ছোট বয়সে মুখের আকার ছোট থাকে এবং নতুন করে গজানো স্থায়ী দাঁতগুলো দেখতে বড় লাগে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেগুলোকে আর দেখতে বড় লাগবে না। তাই, সবগুলো স্থায়ী দাঁত গজানোর পরও যদি দাঁতের অবস্থান এলোমেলো থাকে, তখন যথাযথ চিকিত্সা নেওয়া উচিত।
তবে, যদি মাথার হাঁড়ের কারণে ম্যালোক্লুশন দেখা দেয়, তাহলে এটি যত আগে সংশোধন করা যাবে তত ভালো। কারণ, এটি কেবল দাঁতের বিশৃঙ্খলার সমস্যা নয়, এটি মুখের চোয়ালের অবস্থান ঠিক রাখার সাথে সম্পর্কিত সমস্যা। এ সম্পর্কে ডাক্তার সিয়ে বলেন, মানুষের মুখ যেন মেশিনের মতো; এতে উপর ও নিচের চোয়াল, দাঁত ও জিহ্বা রয়েছে। ম্যালোক্লুশন সমন্বয়ের মূল উদ্দেশ্য এসব মেশিনের কাঠামো ঠিক অবস্থানে রাখা এবং তাদের সুষমভাবে নিজ নিজ ভুমিকা পালন নিশ্চিত করা। তিনি উদাহরণ দিয়ে ম্যালোক্লুশনের চিকিত্সার পদ্ধতি তুলে ধরেন। যেমন, মুখের চোয়ালের কারণে নিচের দাঁত উপরের দাঁতের সামনে অবস্থান করলে, বাচ্চার ছোটবেলায় চিকিত্সা ও সমন্বয়কাজ শুরু করা ভালো। কারণ, যখন মুখের চোয়াল বড় হয়, তখন সংশোধনমূলক কাজ কঠিন হয়ে যাবে।
এর সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার সিয়ে জানিয়েছেন যে, হাড়ের কারণে মুখের বিকৃতির সমস্যার চিকিত্সা দীর্ঘকাল ধরে করতে হয়। কখনও কখনও এ প্রক্রিয়া ৭/৮ বছর বয়স থেকে শুরু করলেও, ১২/১৩ বছর বয়সের পরও অব্যাহত রাখতে হতে পারে। এ চিকিত্সা ১৪/ ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত চলতে পারে।
যদি বাচ্চার বিশৃঙ্খল দাঁতের কারণে মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় বা খাদ্য চিবাতে সমস্যা হয়, তাহলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিত্সা গ্রহণ করা ভালো।
দাঁতের বিশৃঙ্খল অবস্থা সংশোধনে আত্মনিয়ন্ত্রণ বেশ জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্কে ডাক্তার সিয়ে বলেন, যখন দাঁতের বিশৃঙ্খল অবস্থা সংশোধনের কাজ শুরু হয়, তখন দীর্ঘকাল ধরে উপযুক্ত ধনুর্বন্ধনী পরতে হতে পারে। সেসময় প্রতিবার খাবার খাওয়ার পর দাঁত পরিষ্কার করতে হয় এবং সময়মতো হাসপাতালে যেতে হয়। মিষ্টি ও শক্ত খাবার পরিহার করাও জরুরি।
তিনি আরও বলেন, দাঁত সংশোধনের স্বল্পকালীন লক্ষ্যমাত্রা সম্পন্ন করার পর, দীর্ঘকাল ধরে ভালো অভ্যাস বজায় রাখতে হবে। বাচ্চাদের জন্য চিকিত্সাগ্রহণের পর আরও দুই/এক বছর নিয়মিত হাসপাতালে যাওয়া ও চেকআপ করানো দরকার। তারপর, প্রায় দুই বছর ধরে দাঁত-ধারক পরতে হবে। ধীরে ধীরে তা পরার সময় কমিয়ে আনতে হবে। এভাবে দাঁতের বিশৃঙ্খল অবস্থা সংশোধন করা যায়।
বেইজিং শিশু হাসপাতালের স্টোমাটোলজির ডাক্তার ওয়াং মেং সিং বলেন, বর্তমানে অনেক পিতামাতা শুধু বাচ্চার দাঁতের বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখতে সুন্দর না—এমন কারণে বাচ্চাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসছেন। কিন্তু অনেক বাচ্চা চিকিত্সা নিতে চায় না। অথচ, এ ধরনের চিকিত্সায় বাচ্চাদের সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এ সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে বলেন, দাঁত সংশোধনের আগে এ ব্যাপারটি নিয়ে বাচ্চার সাথে আলাপ করতে হবে পিতামাতাকে। বাচ্চাদের মুখের উন্নয়ন ও বিকাশ একটি দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া। যদি শুধু দাঁতের বিশৃঙ্খলা সমস্যা দেখা দেয়, তা কয়েক বছর পর সব স্থায়ী দাঁত গজিয়ে গেলে সমাধান হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের সমস্যা সমাধানে কিছু চর্চার পরামর্শ দেন ডাক্তাররা। যেমন, ভুট্টার মতো কিছু শক্ত খাবার চিবানো।
তা ছাড়া, বাচ্চাদের ভালো স্বাস্থ্যবিধি অভ্যাস করাও জরুরি। যেমন, কেউ কেউ শুধু এক পাশের দাঁত ব্যবহার করে খাবার খায়, ফলে মুখের দু’পাশের পেশীর ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। কোনো কোনো বাচ্চা আঙুল ও পেন্সিল মুখে দিতে পছন্দ করে বা ঘুমের সময় মুখ দিয়ে শ্বাস নেয়। এমন অভ্যাসের কারণে মুখের কাঠামো পরিবর্তন হতে পারে এবং ম্যালোক্লুশনের সৃষ্টি হতে পারে। তাই বাবা-মাকে নিয়মিত বাচ্চার অভ্যাস পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং ভুল অভ্যাস যত দ্রুত সম্ভব সংশোধন করতে হবে।
তা ছাড়া, ৬ বছর বয়সের আগে তথা দুধদাঁত গজানোর সময় বেশ নরম খাবার খেতে দেওয়া ভালো। তা না হলে, চোয়ালের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমন সমস্যা থাকলে স্থায়ী দাঁত গজানোর পর দাঁতগুলো আঁকাবাকা হতে পারে। নরম খাবার খেলে দাঁত সহজে পরিষ্কার করা যায় এবং ক্যারিজ হবার আশঙ্কা কম থাকে।
মোদ্দাকথা, দাঁত মানুষের সৌন্দর্য ও স্বাস্থ্যের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাই দাঁতের স্বাস্থ্যের ওপর নজর রাখা দরকার। কিন্তু অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হবার কোনো কারণ নেই। ছোটবেলা থেকে দাঁত পরিষ্কার রাখার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং নিয়মিত ডাক্তারের কাছে চেকআপের জন্য যাওয়া ভালো।