বাংলা

শিশুদের লেখাপড়ায় মনোযোগের অভাবসংশ্লিষ্ট সমস্যা যেভাবে মোকাবিলা করতে হবে

CMGPublished: 2024-06-24 16:59:44
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

আজকাল চীনে একটি সমস্যা অনেক শিশুর মধ্যে দেখা যায়। তাঁরা বিদ্যালয়ের ক্লাসে মনোযোগী নয়; হাতের লেখায় বা গণিতের হিসাবে তাঁরা প্রায়সময়ই ভুল করে; বই পড়ার সময়ও তাদের মনোযোগ থাকে অন্যদিকে। অনেক পিতামাতা মনে করেন, এমন সমস্যা স্বাভাবিক; বড় হলেই ঠিক হয়ে যাবে। তবে, চীনের শিশু হাসপাতালের বিশেষজ্ঞরা একে ‘শেখার ক্ষেত্রে অদক্ষতা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাই, এ সমস্যা মোকাবিলায় অনেক শিশু-হাসপাতালে বিশেষ ক্লিনিক চালু করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের এপয়নমেন্ট পাওয়া এখন খুবই কঠিন কাজ। এর মানে, সমাজে এমন সমস্যাযুক্ত শিশুর সংখ্যা অনেক বেড়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে: শিশুদের এ সমস্যা সমাধানের উপায় কী? বা এই সমস্যা কীভাবে মোকাবিলা করা যায়? আজাকের অনুষ্ঠানে আমরা সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকদের বরাতে এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।

আগেই বলেছি, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পড়াশোনায় মনোযোগের অভাব চীনা বাচ্চাদের মধ্যে দ্রুত বাড়ছে। বিশেষ করে, মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার গেমস বাজারে আসার পর, এমন সমস্যা দ্রুত বাড়ছে। ছেলে সিয়াওখাই-এর কথাই ধরা যাক। সে এখন প্রাথমিক স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। তার শেখার অদক্ষতা সমস্যা আছে। একাধিক হাসপাতালে চিকিত্সা গ্রহণ করার পরও তেমন কোনো ফল হয়নি। অবশেষে তার মা বেইজিং শিশু হাসপাতালের একজন সিনিয়র ডাক্তার ছুই ইয়ং হুয়ার সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেন। তিনি আশা করেন, পেশাদার ডাক্তারের সাহায্যে তাঁর ছেলে তাড়াতাড়ি মনোযোগের অভাব সমস্যা কাটিয়ে উঠবে এবং ভালো করে পড়াশোনা করবে।

ছেলে সিয়াও খাইয়ের মা বলেন, কিন্ডারগার্টেন পর্যায় থেকেই ছেলের মধ্যে মনোযোগের অভাব লক্ষ্য করেন তিনি। তখন ইংরেজিং অক্ষর ‘বি’ আর ‘ডি’র পার্থক্য সে বুঝতে পারত না, সবসময় ভুল করতো; গণিতের হিসাবেও সে ছিল অনেক কাচা। প্রাথমিক স্কুলে ভর্তির পর শিক্ষক পরামর্শ দিলেন সিয়াওখাই-কে হাসপাতালে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে। ২০২০ সালে একটি হাসপাতালে ধারাবাহিক পরীক্ষার পর সিয়াওখাই এডিএইচডি রোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়। তারপর সে সংবেদনশীল সিস্টেম ও মনোযোগ দক্ষতার চিকিত্সা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। কিন্তু তার অবস্থার খুব একটা উন্নতি ঘটেনি।

সিয়াওখাইয়ের মনোযোগের অভাব সমস্যার সমাধানে স্কুলের কাছে বাড়ি স্থানান্তর করেন তার মা, যাতে ছেলের বিশ্রাম ও ঘুমের সময় নিশ্চিত করা যায় এবং প্রতিদিন সকালে তাকে নিয়ে শরীরচর্চা করা সম্ভব হয়। স্কুলের শিক্ষকরাও সিয়াওখাইর অবস্থার ওপর নজর রাখবেন এবং যখনই দেখবেন ছেলের মনোযোগের অভাব, তখন মাকে জানাবেন, পরামর্শ দেবেন। তবে, পঞ্চম শ্রেণীতে সিয়াওখাইয়ের মনোযোগের অভাব সমস্যা আরও গুরুতর আকার ধারণ করে। ৪০ মিনিটির এক পরীক্ষায় তার ২০টি গণিতের হিসাবের সবকয়টি ভুল হয়। এটা দেখে বাবা-মা স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন হন।

একদিন ডাক্তার ছুইয়ের ক্লিনিকে আরও অনেক বাচ্চা দেখা যায়। যদিও তাদের অসুস্থতার ধরন ভিন্ন, তবে সবার পড়াশোনায় মনোযোগের অভাব অভিন্ন। কিছু কিছু বাচ্চা পড়াশোনার কথা শুনলেই কান্নাকাটি শুরু করে। আবার কোনো কোনো বাচ্চা, এডিএইচডি-তে আক্রান্ত হওয়ার কারণে, ক্লাসরুমে শিক্ষকের কথা শোনে না, দৌড়াদৌড়ি বা চিত্কার করে। কেউ কেউ পড়াশোনার চাপ বেশি হলে, নিয়মিত শরীর দোলায়; পিতামাতা শাসন করলে, পড়াশোনার প্রতি তাদের আগ্রহ আরও দ্রুত হ্রাস পায়। কেউ কেউ স্কুলে যেতেও চায় না। শুধু বাসায় একা একা থাকতে চায়। যদিও তাদের আইকিউ কম নয়, তাঁরা স্কুলে সহপাঠীদের সাথে সহাবস্থান করতেও পারে না।

সংবাদদাতারা খোঁজখবর নিয়ে জানতে পেরেছেন যে, পড়াশোনার প্রতি মনোযোগের অভাবের চিকিত্সা জন্য হাসপাতালের নিবন্ধন পেতে দেরি হচ্ছে মূলত চাহিদা বৃদ্ধির কারণে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পড়াশোনায় মনোযোগের অভাবকেও মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে জড়িত বলে ধরা হচ্ছে। এ সম্পর্কে ডাক্তার ছুই বলেন, পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাচ্চা পড়াশোনায় মনোযোগের অভাব সমস্যায় ভুগছে। এখন আরও বেশি পিতামাতা এ ব্যাপারে সচেতন। তবে, এমন সমস্যা মানসিক অসুখ, যা কম সময়ের চিকিত্সায় আরোগ্য করা সম্ভব নয়। তাই হাসপাতালগুলোতে এপয়েনমেন্ট পাওয়া দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে।

কয়েক বছর আগে বেইজিং শিশু হাসপাতালে সর্বপ্রথম বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় সংশ্লিষ্ট ক্লিনিক চালু হয়। এখানে এডিএইচডি আক্রান্ত বাচ্চাদের সহায়তা দেওয়া ও চিকিত্সা করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শাংহাই, চিয়াংসু, চিয়াংসি আর হুপেইসহ বিভিন্ন এলাকার শিশু হাসপাতালে সংশ্লিষ্ট মানসিক স্বাস্থ্য চিকিত্সা বিভাগ চালু হয়েছে। চীনা সমাজে বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় চেষ্টা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। প্রত্যেক অসুস্থ বাচ্চার জন্য নির্দিষ্ট চিকিত্সা প্রস্তাব ও পরামর্শ দেওয়া হয়, যাতে আরও বেশি চীনা পরিবার এ থেকে উপকৃত হতে পারে।

পড়াশোনায় মনোযোগের অভাব সম্পর্কে ডাক্তার ছুই বলেন, অনেক বাবা-মা এ রোগের কারণে উদ্বিগ্ন। এটি বিভিন্ন রোগের সংমিশ্রিত ফেনোমেনন ও ফলাফল; এর পিছনের কারণ জটিল।

কেউ কেউ বলেন, পড়াশোনায় মনোযোগের অভাবের মূল কারণ আইকিউ কম থাকা। ডাক্তার ছুই মনে করেন, এমন উপসংহার টানা ঠিক না। এটি বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগ ও অসুখের বহিঃপ্রকাশ। এতে আক্রান্ত হলে বই পড়া, অক্ষর লেখা, কথা বলা ও গণিতের হিসাবসহ বিভিন্ন কাজে অদক্ষতা দেখা যায়। এডিএইচডি, টিক ডিসঅর্ডার, অটিজম স্পেকট্রাম ব্যাধি, কিশোর বিষন্নতা, ইত্যাদি রোগের সংমিশ্রণে এই সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।

যখন বাচ্চাদের চিকিত্সা করেন, তখন ডাক্তার ছুই সবসময় জানতে চান যে, বাবা-মা কোন সমস্যা সমাধান করতে চান? অনেকে শেখার ফলাফলের ওপর গুরুত্ব দেন। এ সম্পর্কে ছুই বলেন, অনেক সময় বাচ্চারা এডিএইচডি-তে আক্রান্ত হওয়ার কারণে, শেখার ক্ষেত্রে অদক্ষতার পরিচয় দেয়। তবে, বাবা-মা অধিকাংশ সময় তাদের পড়াশোনার ফলাফলের ওপর মনোযোগ দেন। তারা চান বাচ্চার ফলাফল উন্নত হোক। আর অনেক বাবা-মা মানসিক সমস্যার প্রতি নজর দেন। তাঁরা বাচ্চাদের এমন সমস্যার সম্মুখীন দেখতে চান না।

বেইজিং শিশু হাসপাতালের মানসিক বিভাগে অনেকটি সাবমেজর রয়েছে। এসব সাবমেজরে নির্দিষ্টভাবে অসুস্থ বাচ্চাদের চিকিত্সা করা যায়। শিশু হাসপাতালে শেখার অদক্ষতা বিভাগ চালুর মাধ্যমে বাচ্চাদের জন্য আরও ভালো চিকিত্সার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ বিভাগ স্থাপনের পর বিস্তারিত পরীক্ষা ও চেকআপ পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়। এভাবে আরও দ্রুত ও সঠিকভাবে অসুস্থ বাচ্চাদের চিহ্নিত করা সম্ভব এবং তাদের অসুখের অবস্থা বিবেচনা করে সঠিক চিকিত্সা বা পরামর্শ দেওয়া যায়।

এ ক্লিনিক চালুর পর কিছু বাচ্চা চিকিত্সা গ্রহণের পর বেশ উন্নতি করছে। আবার কোনো কোনো বাচ্চার কোনো উন্নতি হয়নি। এ সম্পর্কে ডাক্তার ছুই বলেন, এডিএইচডির সঠিক চিকিত্সা দিলে কিছু বাচ্চা দুই-তিন মাসের মধ্যে মানসিকভাবে অনেক উন্নতি করে। তখন তাদের বই পড়ার দক্ষতা বাড়ে। আবার কোনো কোনো বাচ্চার কোনো উন্নতি হয় না। সাধারণত, এডিএইচডি বা টিক ডিসঅর্ডারের কারণে শেখার অদক্ষতা হয়। আর সেক্ষেত্রে ওষুধ খেলে বা সংশ্লিষ্ট চিকিত্সা গ্রহণ করলে উপকার পাওয়া যায়। আর যদি অটিজম স্পেকট্রাম ব্যাধির কারণে এমন সমস্যা ঘটে, তাহলে সহজে চিকিত্সা করা সম্ভব হয় না।

অনেক পিতামাতা আত্মসমালোচনা করেন। তাঁরা বলেন, তাদের কোনো ভুল পদ্ধতির কারণে বা যত্নের অভাবে বাচ্চাদের এমন সমস্যা হচ্ছে কি না? অথবা, সঠিক প্রতিরোধক ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে বাচ্চাদের মানসিক অসুখ দেখা দিয়েছে কি না? এ সম্পর্কে ডাক্তার ছুই বলেন, বস্তুত শেখার অদক্ষতার মূল কারণ ঠিক জানা যায় না। তাই প্রতিরোধক ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি। তিনি এডিএইচডি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, এটি শেখার অদক্ষতার প্রধান কারণ, তবে এটি মস্তিষ্কের বিকাশের সাথে বা মানসিক সমস্যা বা পিতামাতার যত্ন নেওয়ার পদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত কোনো সমস্যা নয়।

ডাক্তার ছুই আরও বলেন, পিতামাতার আত্মসমালোচনা করার বা নিজেদের দোষ দেওয়া দরকার নেই। তবে, সঠিক পদ্ধতিতে সমস্যা মোকাবিলা করা জরুরি। কারণ, অনেক বাচ্চা ইতোমধ্যে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়েছে। তাদের বাবা-মা এ বাস্তবতা মেনে নিতে চান না। কিন্তু এমনটা ঠিক নয়। বাস্তবতা মেনে সঠিক চিকিত্সার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। অদক্ষতার কারণে বাবা-মার কাছে বেশি বকা খেলে, শিশুর শেখার অদক্ষতা কমবে না বরং বাড়বে।

তিনি আরও বলেন, অনেক বাবা-মা নিখুঁত বাচ্চা চান। তাদের কোনো ভুল সহ্য করতে পারেন না। যদি বাচ্চারা ভুল করে, তাহলে বাবা-মার মেজাজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এ ধরনের আচরণ বাচ্চার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই বাবা-মাদের উচিত মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানা এবং সন্তানের সাথে যথাযথ ব্যবহার করা।

শেষ দিকে ডাক্তার ছুই পরামর্শ দিয়ে বলেন, আরামদায়ক ও সুখী পারিবারিক পরিবেশ গড়ে তোলা, বাচ্চাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সহায়ক। শেখার অদক্ষতার সমস্যা চিকিত্সার মাধ্যমে দূর করতেও সময় লাগে, তা কম সময়ের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে না। যদি ডাক্তার চিকিত্সার ওষুধ বা প্রশিক্ষণ কোর্স দেন, তাহলে বাবা-মার উচিত নয় নিজেদের ইচ্ছামতো তা বন্ধ করে দেওয়া। ডাক্তারদের পরামর্শ অনুসারে চলতে হবে।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn