বাংলা

আনহুই প্রদেশের ছুচৌ শহরের সাকুরা ফুল পর্যটন শিল্প

CMGPublished: 2024-04-15 16:17:39
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

মার্চ মাসের শেষ দিকে চীনের আনহুই প্রদেশের ছুচৌ শহরের ছুয়ানচিয়াও অঞ্চলের মাছাং জেলার লংশান সাকুরা বাগানে বিভিন্ন ধরনের চেরি ফুল ফোটে। গোলাপি, সাদা, হাল্কা গোলাপিসহ বিভিন্ন রঙয়ের ফুল সূর্যালোকে বেশ সুন্দর দেখায়, আর ফুলের সুগন্ধ ধীরে ধীরে দূর থেকে দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

সাকুরা বাগানের মালিক সি চিয়া পেং পর্যটক সামলাতে ব্যস্ত। তিনি পর্যটকদের কাছে চেরি ফুলের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেন। সামাজিক গণমাধ্যমে চেরি ফুল বাগানের ভিডিও পোস্ট করার পর, অনেক পর্যটক বাগানে ভ্রমণের জন্য তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাই প্রতিদিন তিনি অসংখ্য ফোন পান।

সাকুরা বাগানটির আয়তন প্রায় ৮০ হেক্টর, যাতে ১৫০ ধরনেরও বেশি চেরি গাছ রয়েছে। মালিক সি’র বয়স মাত্র ৩৮ বছর। তবে, তিনি টানা ১১ বছর ধরে সাকুরা বাগান করছেন। সি’র পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল। ছোটবেলায় তিনি বাবা-মায়ের সাথে কৃষিকাজ করতেন।

২০১৩ সালে ছিংতাও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন সি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, স্নাতক হওয়ার পর জন্মস্থানে ফিরে যাবেন এবং চাষাবাদে নিজেকে নিয়োজিত করবেন। স্নাতক হওয়ার পর তিনি ওসমানথাস গাছ আর কর্পূর গাছসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যিক গাছ লাগান এবং বাজারে কৃষকদের কাছে কৃষিপণ্য বিক্রি করা শুরু করেন। তবে, এভাবে তিনি বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারেননি।

পরে তিনি সাকুরা গাছ লাগানো শুরু করেন। শুরুর দিকে অল্প জায়গায় পরীক্ষামূলকভাবে সাকুরা গাছ লাগান। তবে, সাকুরা গাছ বড় করা সহজ ব্যাপার নয়। শুধু মাটিতে গাছের চারা লাগানো আর সময়মতো পানি দিলেই হয় না। অনেক ছোট গাছ লাগানোর পর মরে যায়। পরে, তিনি ৪ বছর ধরে, আরও বিস্তারিত গবেষণা করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল সাকুরা গাছ লাগানোর পদ্ধতি ও উপযোগী জায়গা খুঁজে পাওয়া।

সাকুরা ফুল ফোটাতে চাইলে মাটির অবস্থা, জল নিষ্কাশন প্রযুক্তি, চেরি গাছ বাগানের সুশৃঙ্খল পরিকল্পনা, সময়মতো লাগানো, কী ধরনের সার দিতে হয় এবং কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নজর রাখতে হয়।

২০১৫ সালের গ্রীষ্মকালে তিনি ১ হেক্টর জমিতে সাকুরা চাষ করেন। তার পকেটে মাত্র ৩২ ইউয়ান বাকি থাকে। তখন তাঁর সবচেয়ে কষ্টকর অভাবের সময় গেছে। সেই সময় তিনি ভাবেন যে, যদি এবার সফল না হন, তাহলে অস্থায়ী চাকরি করে জীবনযাপনের খরচ নির্বাহ করতে হবে। তবে সেই সময় হুপেই প্রদেশের একজন ব্যবসায়ী তাঁর কাছ থেকে ২০ হাজার ইউয়ানের সাকুরা চারা কেনেন এবং এ টাকা দিয়ে তিনি ২০১৫ সালের জুলাই মাস থেকে সেই বছরের শরতকাল পর্যন্ত সাকুরা বাগানের সব ব্যয় নির্বাহ করতে সক্ষম হন।

পরে, চেচিয়াং প্রদেশের কৃষি ও বন বিশেষজ্ঞরা সি চিয়া পেংয়ের সাকুরা বাগান পরিদর্শন করেন। তারা মনে করেন, তার সাকুরা গাছের মান বেশ ভালো এবং ১ লাখ ৬০ হাজার ইউয়ান দিয়ে সি’র কাছ থেকে সাকুরা চারা কেনেন। টাকা পেয়ে তিনি আরও ৬ হেক্টরে সাকুরার চাষ করেন। টানা ৩ বছরের প্রচেষ্টায় অবশেষে সাফল্যের আলো দেখতে পান সি।

এদিকে তার বড় ভাই জন্মস্থানে ফিরে আসেন এবং দু’জন একসাথে সাকুরা চাষ শুরু করেন। যদিও অন্যদের দৃষ্টিতে সি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, কিন্তু প্রতিদিন শুধু সাকুরা গাছ চাষ করার জন্য ঘাম ঝরান; দিনে কমপক্ষে ১০ ঘন্টার মতো কাজ করে থাকেন তিনি। অনেকের কাছে তা বোকামি। তবে সি বলেন, সাকুরা গাছ চাষাবাদ তার জন্য বেশ আকর্ষণীয় ব্যাপার, প্রতিদিন নতুন সাফল্য তাকে উত্সাহিত করে।

নতুন ধরনের সাকুরা গাছ উদ্ভাবনের চেষ্টাও করেন তারা। তবে সাকুরা গাছের সংকরায়ন কাজ বেশ কঠিন। ১০ হাজার সাকুরা গাছের সংকরায়ন হলে কেবলমাত্র কয়েকটি গাছ উন্নত ধরনের হয়। এটি চাষাবাদের প্রযুক্তির সাথে জড়িত আর ভাগ্যেরও একটা ব্যাপার রয়েছে। প্রত্যেক ধরনের সাকুরার রঙ, আকার, ফুল ফোটার সময় এবং গাছের আকার ভিন্ন। সি’র বাগানে গোলাপী ও হাল্কা গোলাপী সাকুরা বেশি দেখা যায়। চীনারা এ ধরনের সাকুরা বেশি পছন্দ করে এবং এ ধরনের সাকুরা চীনের আবহাওয়া ও মাটির সাথে বেশ খাপ খেয়ে যায়।

এ পর্যন্ত মালিক সি’র প্রচেষ্টায় তাঁর বাগানে নিজের উদ্ভাবিত ৬ ধরনের সাকুরা গাছ রয়েছে এবং তাঁর সাকুরা গাছ চীনের জাতীয় বন ও তৃণভূমি ব্যুরোর স্বীকৃতি পেয়েছে। ‘রুশান’ নামের সাকুরা গাছ ৮ বছর ধরে সংকরায়ন করা হয়। সাধারণত সাকুরা গাছের উচ্চতা ৫ থেকে ৬ মিটার উঁচু, তবে ‘রুশান’ সাকুরা গাছের উচ্চতা ৩০ মিটারেরও বেশি, তাই নাম রাখা হয় ‘রুশান’, চীনা ভাষায় এর অর্থ পাহাড়ের মতো উঁচু।

‘থাংইয়ুন’ নামের সাকুরা গাছ ১০ বছর ধরে সংকরায়ন করা হয়। সাধারণত সাকুরার ফুলের আকার ছোট, তবে ‘থাংইয়ুন’ সাকুরার ফুল গোলাকৃতির এবং বেশ বড়। আর ‘হানফেং’ নামের সাকুরা ফুল প্রতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে ফোটে। অন্য সাকুরা ফুলের চেয়ে প্রায় এক মাস আগে ফোটে এটি।

সাকুরা চাষ করার জন্য মালিক সি অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর মতো স্নাতক হওয়ার পর জন্মস্থানে ফিরে কৃষি কাজ করা যুবকের সংখ্যা খুবই কম। তবে, তিনি নিজের প্রচেষ্টায় জন্মস্থানে সাকুরা বাগান শিল্পের উন্নয়নে অবদান রেখেছেন এবং স্থানীয় সরকারের সহায়তায় এখন তার সাকুরা বাগান ছুচৌ এলাকার সুবিখ্যাত দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।

সি’র সাকুরা বাগান বড় হওয়ার সাথে সাথে স্থানীয় কৃষকদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাঁরা কর্মী হিসেবে সি’র সাথে সাকুরা গাছ লাগান এবং পরিচর্যা করেন। প্রতিবছর বাগানের কর্মীদের বেতন ১০ লাখ ইউয়ানেরও বেশি। তা ছাড়া, সি চিয়া পিং বিশেষজ্ঞ হিসেবে অন্য বাগানের চাষাবাদে প্রযুক্তিগত পরামর্শ দেন।

যদিও সাকুরা বাগানের আয় এখন দিন দিন বাড়ছে এবং সাকুরা চারা বিক্রি থেকেও একটা ভালো আয় হয়, তবে মালিক সির জীবন বেশ সরল। তিনি পুরনো কাপড় পরেই কৃষিকাজ করেন।

প্রতিবছর যখন সাকুরা ফুল ফোটে, তখন সি’র সবচেয়ে ব্যস্ত সময় এবং গর্বেরও সময়। কারণ, তার পরিশ্রম বিভিন্ন এলাকার পর্যটকদের প্রশংসা ও স্বীকৃতি পেয়েছে, এটি তাঁর জন্য আনন্দের।

ভবিষ্যতে নিজের সংকরায়নকৃত সাকুরা গাছ আরও বেশি দেশে চাষ হবে বলে আশা করেন সি চিয়া পেং, এতে আরো বেশি দেশের নাগরিক সাকুরা ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn