বাংলা

আরশান গ্রামাঞ্চলের শিল্পকলা ও পর্যটনশিল্প

CMGPublished: 2023-11-20 15:35:43
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, চীনের গ্রামীণ পুনরুজ্জীন উদ্যোগের কাঠামোতে, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলা বিভাগের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী গ্রামাঞ্চলকে সুন্দর করায় বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেন। এসব প্রকল্পের আওতায় চীনের বিভিন্ন গ্রামে, পর্যটন ও সংস্কৃতি উন্নয়নে, নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুসারে, উপযুক্ত শিল্পকলা সৃষ্টি করা হয়। আজকের আসরে আমরা চীনের ইনার মঙ্গোলিয়ার আরশান গ্রামের পরিবর্তন ও শিল্পকলা নিয়ে কথা বলব।

সম্প্রতি চীনের সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়ন বিভাগ এবং ইনার মঙ্গোলিয়ার স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সংস্কৃতি ও পর্যটন বিভাগের যৌথ উদ্যোগে, আরশান অঞ্চলের সিখৌ গ্রামে শিল্প উত্সব আয়োজিত হয়। আরশান গ্রামাঞ্চলের শিল্প উত্সব স্থানীয় অঞ্চলের প্রথম গ্রামীণ পর্যটনশিল্প উন্নয়ন কার্যক্রম। এতে চীনের ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলা একাডেমিসহ ১০টি শিল্প কলেজ ও ডিজাইন সংস্থা, ২৫টি শিল্পী কর্মদল, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, এবং স্থানীয় হস্তকর্মশিল্পীরা অংশ নেন। ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলা একাডেমির ভাষ্কর্য বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী খোং ফান তি তাদের মধ্যে একজন। সংবাদদাতাদের তিনি বলেন, “দীর্ঘকাল সিখৌ গ্রামে বসবাস করছি। এখন গ্রামের একজন সদস্যে পরিণত হয়েছি আমি।”

২০১৯ সালের শুরুতে সিখৌ গ্রাম দারিদ্র্যমুক্ত হয়। তখন থেকে গ্রামীণ পুনরুজ্জীবনের নতুন পথে যাত্রা শুরু করে গ্রামটি। ২০২২ সাল থেকে ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলা একাডেমি এবং সিখৌ গ্রামের সহযোগিতা শুরু হয়। আরশান গ্রামাঞ্চলের শিল্পকলা উত্সবের নির্বাহী ডিজাইনার ওয়েন পো মনে করেন, সিখৌ গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও পর্যটনসম্পদ চমত্কার, তবে স্থানীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য আরও উন্নত করে স্থানীয় সাংস্কৃতিক শিল্পকে আরও জনপ্রিয় করা সম্ভব।

শুরুর দিকে শিল্পকর্ম নিয়ে গ্রামবাসীদের মনে সন্দেহ ছিল। তাদের সন্দেহ দূর করতে ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলা দল সর্বপ্রথমে ‘মাটি শিল্পের’ বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। ‘মাটি শিল্প’ মানে শিল্পীরা স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশের অবস্থা বিবেচনা করে বহু ধরনের শিল্প ডিজাইন করেন। এভাবে গ্রামের মানুষ সহজে প্রকৃতি ও মানবজাতির সম্পর্ক বুঝতে পারেন। ডিজাইনার ওয়েন পো আরও বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য হল শিল্পকলা ডিজাইনের মাধ্যমে স্থানীয় সংস্কৃতি ও পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন এগিয়ে নেওয়া, যাতে আরও বেশি পর্যটক আকর্ষণ করে স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়নে ইতিবাচক ভুমিকা রাখা যায়।”

ছিংহুয়া শিল্পকলা একাডেমির বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক গ্রামবাসীদের ওপর টানা ৬ বার জরিপকাজ চালান এবং তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তথ্য আদান-প্রদান করেন। শুরুর দিকে গ্রামবাসীরা কেবল অর্থনৈতিক স্বার্থের ওপর গুরুত্ব দিত। শিল্পকলা উত্সব গ্রামের জন্য কী কী সুবিধা বয়ে আনতে পারে—সেই বিষয় নিয়ে তাদের মনে ব্যাপক সন্দেহ ছিল। তবে, কয়েকবারের আলাপ-আলোচনার পর গ্রামবাসীদের চিন্তা-চেতনায় ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসে; তাদের সন্দেহ পরিবর্তিত হয় সমর্থনে।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত আরশান গ্রামাঞ্চলের শিল্পকলা উত্সবের বিভিন্ন প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পন্ন হয়। এক বছরে ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলা একাডেমির প্রায় ২০০ জন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সিখৌ গ্রামে এসে শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেন।

প্রথমবার সিখৌ গ্রামে আসা ছাত্রছাত্রীরা অনেক অজানা সমস্যার সম্মুখীন হন। শিল্পকর্ম তৈরিতে কাঠসহ বিভিন্ন কাঁচামাল লাগে। সেগুলো বহন করে আনতে হয়। অনেক ছাত্রছাত্রী ট্রাইসাইকেল চালাতে পারে না। তবে, ধীরে ধীরে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে ট্রাইসাইকেল চালানো শিখে ফেলে তাঁরা।

পর্যটকদের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি শিল্পীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর শিক্ষার্থীরা গ্রামবাসীদের সাথে যৌথভাবে উপযুক্ত জায়গা ঠিক করেন। তাঁরা বুঝতে পারেন যে, শিল্পকর্মের স্থান হিসেবে কৃষিক্ষেত ও বনভূমি এড়াতে হবে। কয়েকটি শিল্পীদল এবং স্থানীয় বন বিভাগ ও গ্রামবাসীদের সাহায্যে অবশেষে উপযুক্ত স্থান খুঁজে পাওয়া যায়।

ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলা একাডেমির ভাষ্কর্য বিভাগের অধ্যাপক তুং শু পিং উপযুক্ত স্থান খুঁজে পাওয়ার পর সেটা মার্ক করেন। এর পর তিনি ও তার শিক্ষার্থীরা মনোযোগ দিয়ে শিল্পকর্ম ডিজাইন করা শুরু করেন।

প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানো এবং গ্রামবাসীদের সাথে যৌথভাবে ডিজাইন করা আরশান শিল্পকলা উত্সবের গুরুত্বপূর্ণ নীতি। এখানে সিখৌ গ্রামের বৈশিষ্ট্য ও জীবনযাপনের আমেজকে শিল্পকর্মের মাধ্যমে পর্যটকদের সামনে তুলে ধরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্কে ডিজাইনার ওয়েন পো বলেন, “আমরা গ্রামবাসীদের কাছ থেকে স্থানীয় সংস্কৃতি ও রীতিনীতি সম্পর্কে জানতে পেরেছি এবং তা আমাদের শিল্পকর্মে প্রভাব ফেলেছে।” মাস্টার্সের শিক্ষার্থী খোং ফান তি ৯ জন গ্রামবাসীকে নিয়ে পাহাড়ের উঁচু স্থানের বনাঞ্চলের তৃণভূমিতে বিভিন্ন রংয়ের কাঠ দিয়ে ‘সমুদ্রের আকৃতি’ ডিজাইন করেন। যখন বাতাস প্রবাহিত হয়, তখন গাছগুলোর পাতার ফাঁক দিয়ে আঁকাবাঁকা কাঠগুলোকে প্রাণবন্ত মনে হয়। এ সম্পর্কে শিক্ষার্থী খোং বলেন, “এই বহুবর্ণ সমুদ্রের ঢেউ যেন সিখৌ গ্রামবাসীদের সুন্দর জীবনের প্রতীক।”

বস্তুত এ শিল্পকর্মের অনুপ্রেরণা শিক্ষার্থী খোং পেয়েছেন সিখৌ গ্রাম পর্যবেক্ষণ করে। একবার তিনি খেয়াল করেন যে, গ্রামের প্রতিটি ঘরের সামনে ৪০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার লম্বা কাঠের স্তুপ রয়েছে। স্থানীয় গ্রামবাসীরা এসব কাঠ জ্বালিয়ে খাবার রান্না করেন। শিক্ষার্থী খোং ভাবেন, পাহাড়নির্ভর জীবন কাটায় গ্রামবাসীরা। তিনি এসব কাঠ দিয়ে একটি শিল্পকর্ম তৈরির সিদ্ধান্ত নেন।

যদিও পরিবেশ শিল্পকর্মের ডিজাইনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে, তবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ডিজাইন কাজ যেন পরিবেশের ক্ষতি করতে না পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখা হয়েছে। তাই এ শিল্পকর্মে ব্যবহৃত কাঠগুলো ছোট ট্রলি দিয়ে পাহাড়ের উপরে পরিবহন করা হয়েছে। গ্রামবাসীরা এ পরিবহন কাজে অনেক সাহায্য করেছেন। আরেকটি কঠিন সমস্যার সমাধান করতে হয় শিক্ষার্থী খোং-কে। কিভাবে কাঠগুলোকে সমুদ্রের ঢেউয়ের আকৃতিতে কাটা যাবে? তিনি বিভিন্ন কাঠের টুকরোকে ৪০ সেন্টিমিটার, ৬০ সেন্টিমিটার ও ৯০ সেন্টিমিটার আকারে কেটে নেন এবং ধীরে ধীরে সমুদ্রের ঢেউের আকৃতি ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হন।

ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লি লে ছেং ‘আগের বছরের চেয়ে টাকা বেশি’ শীর্ষক শিল্পকর্ম গ্রামবাসীদের সাথে ডিজাইন করেন। চীনা ভাষায় ‘অতিরিক্ত টাকা’ টার্মটির উচ্চারণ আর ‘মাছ’ শব্দের উচ্চারণ একই। তখন গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জানতে পারেন যে, সিখৌ গ্রামের কাছে নদীতে চেলুও নামের এক ধরনের মাছ পাওয়া যায়। প্রতি বছর যখন মাছ ডিম থেকে বাচ্চা ফোটায়, তখন শীতকালে সেগুলো রাশিয়ায় সাঁতরে চলে যায় এবং বসন্তকালে আবার চীনের পানিতে ফিরে আসে। এ তথ্য জেনে শিল্পীরা মনে করেন, এ মাছের যাত্রা স্থানীয় পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতিফলন। তাই এ শিল্পকর্ম ডিজাইনের মাধ্যমে সিখৌ গ্রামের গ্রামবাসীদের জন্য শুভকামনা জানান তিনি। এ শিল্পকর্মে মোট ৬২৮টি মাছের আকৃতি রয়েছে, যা গ্রামের ৬২৮টি পরিবারের সুখী জীবনের প্রতীক।

চলতি বছর সিখৌ গ্রাম, ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় গ্রামের পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করতে চায়। বর্তমানে সিখৌ গ্রামের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ৮০০০ ইউয়ানে দাঁড়িয়েছে। গ্রামবাসীরা সয়াবিন ও ভুট্টাসহ বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্য চাষাবাদ করে; গরু, ছাগল ও মুরগী লালনপালন করে। তা ছাড়া, আরও অনেকে পর্যটনশিল্পে কাজ করেন।

অতীতে সিখৌ গ্রামে কোনো পর্যটক আসতো না। পর্যটনের সাথে জড়িত কোনো আয়ও ছিল না। চলতি বছর এখন পর্যন্ত পর্যটকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজারে। তৃতীয় প্রান্তিকে সিখৌ গ্রামের আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়েছে।

সিখৌ গ্রামের গ্রামবাসী, স্থানীয় উইলো বয়ন শিল্পী তুং লি মেই বাড়িতে একটি বিশেষ ঘর আলাদা করে তাঁর শিল্পকর্ম প্রদর্শন করেন। এ ঘরে উইলো দিয়ে তৈরি প্লেট, বাস্কেট ও টুপিসহ বিভিন্ন শিল্পকর্ম দেখা যায়। তিনিও ‘আগের বছরের চেয়ে টাকা বেশি’ শিল্পকর্মের ডিজাইন-কাজে অংশ নিয়েছেন। কখনো ভাবেননি যে, তাঁর হস্তশিল্পকর্ম একদিন সত্যিকারের শিল্পকর্মে পরিণত হবে। চীনের বিভিন্ন এলাকার পর্যটকরা সিখৌ গ্রামে এসে উইলো হস্তশিল্পকর্ম দেখেন, যা তাঁর জন্য বেশ গর্বের ব্যাপার।

আরশান গ্রামাঞ্চলের শিল্পকলা উত্সব কেবল গ্রামে শিল্পের আমেজ গড়ে তুলেছে তা নয়, বরং গ্রামবাসীদের আয় বাড়িয়েছে। গ্রামবাসী তুং লি মেই’র উইলো শিল্পকর্ম জনপ্রিয় হওয়ার পর তিনি অনলাইন আর অফলাইনে শিল্পকর্ম বিক্রি করছেন। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে তাঁর আয় ১০ হাজার ইউয়ান ছাঁড়িয়ে গেছে।

সি খৌ গ্রামের পরিবর্তন গ্রামের সিপিসি’র সম্পাদক ইয়াং চি ছেংয়ের জন্য বেশ উত্সাহব্যাঞ্জক ব্যাপার। তাঁর পরিকল্পনা স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের ভিত্তিতে যথাযথভাবে পর্যটন শিল্প উন্নয়ন করা, যাতে গ্রামবাসীদের সুখী জীবনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা যায়।

এ গ্রামের শিল্পকলা উত্সব আরেকটি সুখবর বয়ে এনেছে। অতীতে সিখৌ গ্রামে কেবল বয়স্ক গ্রামবাসীরা বসবাস করতেন। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের ফলে এখন অনেক যুবক গ্রামে ফিরে এসে গ্রামীণ হোটেল চালু করছেন। বছরের চার ঋতুতে আরশানের সুন্দর দৃশ্যে বৈচিত্র্য দেখা যায়। শীতকাল আসছে, সিখৌ গ্রামের ‘বরফ উত্সব’ অল্প সময়ের মধ্যে শুরু হবে। স্থানীয়ভাবে স্কেটিংয়ের স্থান নির্মাণ করা হবে।

বস্তুত, আরশান গ্রামাঞ্চলের শিল্পকলা উত্সবের মাধ্যমে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ সম্পদ প্রয়োগ করে গ্রামের উন্নয়ন কাজে ইতিবাচক ভুমিকা রাখা হচ্ছে। সুন্দর প্রাকৃতিক দশর্নীয় স্থান নির্মাণ, গ্রামে হোটেল ও রেস্তোরাঁসহ পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ পুনরুজ্জীবনের সুন্দর দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। এ সম্পর্কে ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থান ছুয়ান বলেন, শিক্ষার্থীরা নিজেদের শিল্পকর্ম তৈরির মাধ্যমে যেন মাতৃভূমিতে নিজেদের স্নাতক থিসিস লিখেছে, যা শিক্ষার্থী ও গ্রামবাসী উভয়ের জন্যই তাত্পর্যপূর্ণ। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও গ্রামবাসীরা একসাথে সুন্দর জীবন ও স্বপ্ন তৈরির সুযোগ পেয়েছে, যা সবার জন্য কল্যাণকর।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn