‘বসন্ত কুঁড়ি’ প্রকল্পের উপকৃত মেয়েদের গল্প
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক সংস্কার ও উন্নয়ন ঘটেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে চীনা শিশুরা কমপক্ষে ৯ বছরের বাধ্যতামূলক শিক্ষা পাচ্ছে। এ উদ্যোগের কাঠামোতে অনেক মেয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগও পেয়েছে ও পাচ্ছে। এর মধ্যে একটি পরিকল্পনা বেশ ইতিবাচক ভুমিকা পালন করেছে, সেটি হল ‘বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্প’, যা ১৯৮৯ সাল থেকে চীনের নারী ফেডারেশন ও শিশু তহবিল সংস্থার যৌথ উদ্যোগে চালু আছে।
এ উদ্যোগের মাধ্যমে অনেক দরিদ্র পরিবারের মেয়ে সাময়িকভাবে লেখাপড়াবঞ্চিত থাকার পর আবার স্কুলে ফিরে এসেছে। এ উদ্যোগের আওতায় কেবল ৯ বছরের বাধ্যতামূলক শিক্ষা নয়, বরং সব বয়সের ছাত্রীদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে সহায়তা দেওয়া হয়। বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্পের মাধ্যমে অনেক মেয়ের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্পে উপকৃত মেয়েদের গল্প শেয়ার করবো।
চলতি বছরের গ্রীষ্মকাল ছিল চীনের সিছুয়ান প্রদেশের লিয়াংশান ই জাতিঅধ্যুষিত জেলার সিছাং শহরের আকাকুওকু গ্রামের মেয়ে মা ই ছিংয়ের জন্য বেশ তাত্পর্যপূর্ণ। এ সময় সে চীনের কেন্দ্রীয় জাতি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধনপত্র হাতে পায়। এতে তার নতুন জীবন শুরু হয়। তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল; পিতা গুরুতর রোগে আক্রান্ত। কিন্তু সে পরিশ্রমের সাথে পড়াশোনা চালিয়ে যায়। চলতি বছরের কাওখাও পরীক্ষায় সে লিয়াংচৌ জেলার বিজ্ঞান পরীক্ষায় প্রথম স্থান পেয়েছে। ছোটবেলা থেকে সে ‘বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্প’ থেকে উপকৃত হয়ে আসছে।
সে দূরবর্তী পাহাড় ত্যাগ করে বাইরের দুনিয়া দেখতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু পরিবারের আর্থিক বোঝার কারণে প্রতিমাসে তার জীবনযাপনের খরচ ছিল খুবই সামান্য। উচ্চ বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষ থেকে ‘বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্পের’ ঋণ পেয়ে আসছে সে। যদিও টাকা বেশি নয়, তবে সেটি ব্যবহার করে লেখাপড়ার প্রয়োজনীয় স্টেশনারি কিনতে পারে সে। তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল, কাওখাও পরীক্ষার আগে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধনপত্র পাওয়ার সময় ‘বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্পের’ কর্মীরা তার পাশে ছিল।
কাওখাও পরীক্ষার আগে ‘বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্প’ কার্যালয়ের কর্মীরা কয়েক ডজন ‘বসন্ত কুঁড়ি মেয়ের’ জন্য সূর্যমুখী ফুল, সৌভাগ্যের মিছরিসহ বিভিন্ন উপহার নিয়ে আসেন। মেয়ে মা সে দৃশ্য স্মরণ করে বলে, ‘সেটি আমার জন্য একটি বড় উত্সাহ এবং শ্রেষ্ঠ উপহার ছিল।’
যখন মা ই ছিং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধনপত্র হাতে পায় তখন সে ‘বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্পে’ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছিল। ডাক অফিস থেকে নিবন্ধপত্র পাওয়া ছিল তাঁর জন্য অতি আনন্দদায়ক ব্যাপার। বস্তুত, মা ই ছিংয়ের মতো আরো অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে, যারা ‘বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্পের’ সাহায্যে দূরবর্তী এলাকার পাহাড়াঞ্চল থেকে বের হয়ে বাইরের দুনিয়া দেখার সুযোগ পেয়েছে।
তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের নাছু শহরের চিয়ালি জেলার ছুওতুও উপজেলার প্রাথমিক স্কুলের মেয়ে রাগারামু এবার ‘বসন্ত কুঁড়ি শ্রেষ্ঠ মেয়ে’ পুরস্কার পেয়েছে। ভালো লেখাপড়া করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চেষ্টা করে সে এবং বড় হওয়ার পর একজন শিক্ষিকা হতে চায়।
গত শতাব্দীর ৮০-র দশকে চীনের কুয়াংসি চুয়াং জাতির স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের লিউচৌ শহরের রংশুই মিয়াও জাতিঅধ্যুষিত জেলায় স্থানীয় নারী ফেডারেশন ও শিক্ষা ব্যুরোর যৌথ প্রয়াসে দূরবর্তী পাহাড়াঞ্চলের গ্রামে প্রত্যেক পরিবারের মেয়ের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে। পাইইয়ুন উপজেলায় মেয়েদের জন্য বিশেষ ক্লাস শুরুর পর, স্থানীয় দরিদ্র পরিবারের লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত মেয়েদের শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ আসে। সেটিও ‘বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্পের’ একটি উদ্যোগ।
যুগ পরিবর্তন ও নির্দিষ্ট শিক্ষা-সহায়তানীতির প্রেক্ষাপটে, ‘বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্প’ উচ্চবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের দরিদ্র মেয়েদের সাহায্য করছে। ২০২২ সালের শেষ নাগাদ ‘বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্প’ মোট ২ বিলিয়ন ৯১.১ কোটি ইউয়ান সংগ্রহ করে এবং উপকৃত মেয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০.৯ লাখ।
মেয়ে ফান চিয়ান রু ২০১৬ সালে উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সময় ‘বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্পের’ অর্থ সহায়তা পায়। ২০১৯ সালে সাফল্যের সঙ্গে ছিংতাও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় সে এবং টানা ৪ বছর ধরে ‘বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্পের’ অর্থ সাহায্য পেতে থাকে। এতে অর্থের চিন্তা বাদ দিয়ে সে মনোযোগ দিয়ে অনার্স কোর্স সম্পন্ন করার সুযোগ পায়। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে আবার তালিয়ান পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মাস্টার্স শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হয় সে। ‘বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্প’ সম্পর্কে সে বলে, “আমার পরিবার অনেক দরিদ্র ছিল। তখন আমার মন অনেক অশান্ত ছিল। যখন আমি জন্মস্থানের নারী ফেডারেশনের মাধ্যমে ‘বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্পের’ স্বেচ্ছাসেবকদের কাছ থেকে সাহায্য পাই, তখন আমার মন শান্ত হয়। তাদের আন্তরিক সমবেদনা, উত্সাহ ও সাহায্য এবং বিভিন্ন গঠনমূলক পরামর্শ পেয়ে আমি ধীরে ধীরে বড় হয়েছি।’ ফানের দৃষ্টিতে বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্পের সহায়তায় সে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেয়েছে। স্নাতক হওয়ার পর অবশ্যই আরও পরিশ্রম করে কাজ করবে সে।
মেয়ে মা ই ছিং বলে, বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্পের কর্মীরা স্কুলে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। উচ্চবিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণীর মেয়েদের পরস্পরকে সমর্থন দেওয়ার জন্য কাওখাও পরীক্ষার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া মেয়েরা স্কুলে এসে জুনিয়ার মেয়েদের পরামর্শ ও উত্সাহ দেয়। তাদের পড়াশোনার সফল অভিজ্ঞতা তুলে ধরে।
জানা গেছে, বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্প কেবল দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের পড়াশোনায় অর্থ বা সহায়তা দেয় না, বরং তাদের মানসিক স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন দিকেও খেয়াল রাখে। ২০১৯ সালে চীনের শিশু ও কিশোর-কিশোরী তহবিলের উদ্যোগে ‘বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্প’ হাতে নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে মেয়েদের নিরাপত্তা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, তাদের পড়াশোনা বন্ধ হতে না দেওয়া, এবং পড়াশোনার সাথে সাথে বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়।
২০২২ সালের শেষ নাগাদ বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্পের আওতায় ৫ লাখ ২৭ হাজার মেয়েকে প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, ১ লাখ ৩৩ হাজার মেয়েকে মানসিক পরামর্শ ও সহায়তা দেওয়া হয়, এবং ১৮১১টি ছাত্রী স্কুল নির্মাণ করা হয়।
বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্প থেকে উপকৃত মেয়েরা স্নাতক হওয়ার পর বিভিন্ন চাকরিতে যোগ দেয়। তাঁরা নিজেদের কাজের মাধ্যমে চীনা সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখে এবং বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী হিসেবে নতুন প্রজন্মের মেয়েদের সহায়তা দেয়। তাদের মধ্যে অনেকে স্কুলের শিক্ষকে পরিণত হয়েছে। ২৬ বছর বয়সের নারী ওয়েন সিয়াও মেই বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্পের সুবিধাভোগী একজন ছাত্রী। তিনি মনে করেন, মানুষের মূল্য তার সামাজিক অবদানের সাথে সম্পর্কিত। বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্প থেকে উপকৃত হওয়ার পর তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছেন এবং বড় হওয়ার পর সমাজের উন্নয়নে নিজের অবদান রাখতে চান।
ওয়েন সিয়াও মেই চীনের নিংসিয়া হুই জাতির স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের কুইউয়ান শহরের সিজি জেলার হুয়াংছা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকে তাঁর পরিবারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল দেখে এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধনপত্র হাতে পেয়ে খুশী হবার পাশাপাশি তিনি এই ভেবে কষ্ট পান যে, পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণে তার অন্য ভাই-বোনেরা উচ্চশিক্ষা থেকে হয়তো বঞ্চিত থেকে যাবে। পরিবারের বড় বাচ্চা হিসেবে তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ছোট বোন ও ভাইয়ের পড়াশোনায় সমর্থন দিতে চান। তবে, স্থানীয় নারী ফেডারেশন তার এ অবস্থা জেনে বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্পের মাধ্যমে তাকে সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দেয়। ফলে মেয়ে ওয়েন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। তার মা এ খবর শুনে অনেক খুশী হন।
অর্থ সহায়তা পেয়ে মেয়ে ওয়েন সিয়াও মেই নিংসিয়া নোর্মল একাডেমিতে পড়াশোনা শুরু করেন। স্নাতক হওয়ার পর ইনছুয়ান শহরের একটি প্রাথমিক স্কুলে চাকরি পেয়ে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। কর্মজীবনে তিনি মনোযোগ দিয়ে বিভিন্ন ক্লাসের জন্য প্রস্তুতি নেন এবং শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের কোর্স দেখে নিজের শিক্ষাদানের দক্ষতা ও মান উন্নত করতে চেষ্টা করেন। শিক্ষক ওয়েন মনে করেন, প্রত্যেক বাচ্চার অবস্থা আলাদা, তাই তাদের পড়াশোনার গতিও ভিন্ন। প্রত্যেক বাচ্চার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে উপযোগী পদ্ধতিতে ক্লাসে পড়ানোর চেষ্টা করেন তিনি।
বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্পের কারণে তিনি শিক্ষক হতে পেরেছেন। তাই তার দায়িত্ব আরও বেশি ভালোবাসা ও আন্তরিকতা অন্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং বাচ্চাদের শেখানোর সময় নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়া। এটা তিনি মনে করেন।
চীনের হুপেই প্রদেশের মেয়ে ওয়াং ইয়ুন লিং ছোটবেলা থেকে ভালো করে লেখাপড়া করছিল। বিভিন্ন কোর্সের শিক্ষকদের দৃষ্টিতে সে ছিল শ্রেষ্ঠ ছাত্রী। তবে তাঁর পরিবারের আর্থিক অবস্থা ছিল দুর্বল। উচ্চবিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে সে বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্পের অর্থ সাহায্যের জন্য আবেদন করে। তার আবেদন মঞ্জুর হয় এবং সে টানা ৩ বছর প্রকল্প থেকে সাহায্য পায়। পরে কাওখাও পরীক্ষায় সে চমত্কার স্কোর করে এবং চংনান অর্থনীতি ও আইন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। অনার্স কোর্সে তার মেজর পরিবেশ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনায়ও সে চমত্কার স্কোর করে। চীন সরকারের বৃত্তি ও পেশাদার বৃত্তি লাভ করে। স্নাতক পর্যায় শেষ করে সে পরিবেশ বিষয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হয়। পড়ালেখা শেষ করে তিনি এখন একটি সুবিখ্যাত গাড়ি কোম্পানির প্রকৌশলী। এ সম্পর্কে ওয়াং ইয়ুন লিং বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনায় পরিশ্রম দরকার। কর্মস্থলে আরও পরিশ্রম করে ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব। চীনের সুবিখ্যাত হস্তকর্মশিল্পীদের মতো মনোযোগ দিয়ে কাজ করে নিজের কর্মদক্ষতা উন্নত করতে আগ্রহী তিনি। তিনি বসন্ত কুঁড়ি প্রকল্পের একজন কৃতজ্ঞ সুবিধাভোগ।