বাংলা

চীনের শিক্ষক দিবস ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের গল্প

CMGPublished: 2023-09-18 17:00:46
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

গত ১০ সেপ্টেম্বর ছিল চীনের ৩৯তম শিক্ষক দিবস। এ বিশেষ দিনে ২০২৩ সালের জন্য নির্বাচিত চীনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের গল্প প্রকাশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাঁদের মধ্যে চীনের উচ্চশিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, বাধ্যতামূলক শিক্ষা, ও প্রতিবন্ধী শিক্ষার শিক্ষকসহ বিভিন্ন মহলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা রয়েছেন। তাঁদের লক্ষ্য এক: শ্রেষ্ঠ ও দক্ষ নাগরিক গড়ে তোলা।

অবশ্যই এ ১০ জন সেরা শিক্ষক চীনের লক্ষ লক্ষ শিক্ষকের তুলনায় অনেক কম। বস্তুত, দেশের বিভিন্ন এলাকা ও স্কুলে প্রচুর ভালো শিক্ষক রয়েছেন। কিন্তু তাদের মধ্য থেকেই বাছাই করা হয়েছে ১০ জন শিক্ষককে। শিক্ষক একজন মানুষের জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকেন। স্কুলের শিক্ষা, পারিবারিক শিক্ষা, ও সামাজিক শিক্ষার প্রভাবে আজকের শিশু দেশের ভবিষ্যত হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। আজকের আসরে চীনের বিভিন্ন এলাকার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গল্প শেয়ার করবো।

চীনের সিছুয়ান প্রদেশের ছেংতু শহরের সাত নম্বর মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক সিয়া শুয়েই অনেক দিন ধরেই অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। দেশের দূরবর্তী এলাকার হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী শিক্ষক সিয়া’র ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে। দূরবর্তী এলাকার বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকরাও তাঁর সাথে অনলাইনে শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারছে।

২০০৮ সালে শিক্ষক সিয়া শুয়েই চীনের হুয়াচং নর্মোল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। পরে তিনি ছেংতু সাত নম্বর উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। অনেক শিক্ষার্থীর কাছে গণিত কঠিন বিষয়, যা সহজে বোঝা যায় না। শিক্ষক সিয়ার প্রচেষ্টায় গণিতও তাদের কাছে মজাদার হয়ে উঠেছে।

গত ১০ বছরেরও বেশি সময়ের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ শিক্ষক সিয়া গণিত পড়ানোর অনেক সহজ ও কার্যকর পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তিনি সহজ উদাহরণ দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের গণিতের রহস্যময় ব্যাপার বিশ্লেষণ করেন। এভাবে লগারিদমিক ফাংশনের ধারণা শিক্ষার্থীরা সহজে মনে রাখতে পারে। এ ধারণা বিশ্লেষণ করে তিনি বিশেষ একটি বইও রচনা করেছেন। ধীরে ধীরে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা গণিতের প্রতি ভয় কমেছে; গণিত শেখার প্রতি আগ্রহও বেড়েছে।

শিক্ষক সিয়া কর্মজীবনে পঞ্চম বছরের এসে বড় একটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। তখন তাকে, সাত নম্বর উচ্চবিদ্যালয়ের অনলাইন ক্লাসের শিক্ষক হিসেবে, দূরবর্তী এলাকার ছাত্রছাত্রীদের জন্য অনলাইন ক্লাস চালু করতে হয়। তাঁর ক্লাসে অংশ নেয় চীনের ১০টি প্রদেশের ৩০টি এলাকার ৩১৯টি স্কুলের প্রায় এক লাখ ছাত্রছাত্রী। তাঁরা সবসময় একসাথে অনলাইনে শিক্ষক সিয়া’র ক্লাস শোনে। শুরুর দিকে শিক্ষক সিয়া শুধু পাঠ্যপুস্তকের বিষয় সম্পর্কে ভালো প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাসে যোগ দিতেন। তবে, ধীরে ধীরে তিনি খেয়াল করেন যে, কেবল শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়ানোর মাধ্যমে শিক্ষাদানকে কার্যকর করা সম্ভব।

শিক্ষক সিয়ার অনলাইন ক্লাস টানা ৯ বছর ধরে চালু থাকে। তিনি চীনের বিভিন্ন প্রদেশের মোট ৪০ হাজারেরও বেশি ছাত্রছাত্রীর জন্য অনলাইন ক্লাস নিয়েছেন এবং তাদের মধ্যে অনেকে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় ও ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।

শিক্ষক হিসেবে বিগত ১৫ বছরে তিনি অনেক পুরস্কার লাভ করেছেন। এবার ২০২৩ সালের শ্রেষ্ঠ ও সেরা শিক্ষকের নামতালিকায় তাঁর নাম উঠেছে, যা তাঁর জন্য বড় মর্যাদা ও উত্সাহের ব্যাপার। তিনি মনে করেন, এতে তাঁর কাঁধে দায়িত্বের বোঝা আরো একটু বেড়েছে। ভবিষ্যতে ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণে আরও বেশি প্রচেষ্টা চালাবেন বলেও জানালেন।

চীনের আনহুই প্রদেশের লিউআন শহরের হুওছিউ জেলার হুহু উপজেলার মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক তুং ইয়ান টানা ১৮ বছর ধরে গ্রামাঞ্চলে শিক্ষকতার কাজ করেন। তিনি বাচ্চাদের কবিতা রচনায় সহায়তা দেন, তাঁর প্রশিক্ষণে ৩০ জনেরও বেশি ছাত্রছাত্রীর কবিতা ও প্রবন্ধ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে।

২০০৬ সালে তুং ইয়ান গ্রামাঞ্চলের শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। শিক্ষকতার কাজ সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট ধারণা ছিল না। কিভাবে একজন সেরা শিক্ষক হওয়া যায়? এটা ছিল তাঁর মনের প্রশ্ন। এর উত্তর খুঁজতে তিনি অনেক বই পড়েন। ধীরে ধীরে তিনি উত্তর খুঁজে পান এবং শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হওয়ার জন্য তিনি প্রতিদিন হোস্টেলে ক্লাসরুমের অবস্থা সিমুলেশন করেন এবং মাত্র এক বছর পর তিনি জেলা পর্যায়ের প্রাথমিক স্কুলের চীনা ভাষা ক্লাসের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন। এ পুরস্কার বিজয়ীদের মধ্যে তাঁর বয়স সবচেয়ে কম।

ধীরে ধীরে আহুই প্রদেশের লিউআন শহরের সুপরিচিত শিক্ষক হয়েছেন তুং। তিনি নিয়মিত টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন, ম্যাগাজিনে প্রবন্ধ লেখান। ইতোমধ্যেই শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত প্রায় সবধরনের পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন। বড় শহরের স্কুল থেকেও বিশেষ অফার আসে। সেই সময় কোন সিদ্ধান্ত নেবেন, তা ঠিক করা তাঁর জন্য কঠিন ব্যাপার ছিল। গ্রামাঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরা এ তথ্য জেনে অনেকবার কেঁদেকেটে তাকে চলে যেতে বারণ করেছে; তাঁরা শিক্ষক তুংয়ের সাহচর্যে থাকতে চায়।

শেষ পর্যন্ত শিক্ষক তুং আর গ্রাম থেকে শহরে ফিরে যাননি। তাঁর দৃষ্টিতে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষকদের দায়িত্ব আরও ভারী, গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার উন্নয়নে আরো বেশি প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ছোটবেলায় শিক্ষক তুং গ্রামাঞ্চলে বড় হয়েছেন। তিনি এসব এলাকার বাচ্চাদের ভালো পড়াশোনায় নিজের অবদান রাখতে চান।

আত্মউন্নয়নের প্রচেষ্টা থেকে তিনি কখনও বিরত হননি। বই পড়া, লেখা, অনুশীলনসহ বিভিন্ন পদ্ধতিতে শিক্ষকতার দক্ষতা উন্নত করেন তুং। তিনি মনে করেন, বই পড়া হচ্ছে ইনপুট এবং লেখালেখি হচ্ছে আউটপুট। প্রতিমাসে তিনি বাচ্চাদের নিয়ে বই পড়েন; একই বই পড়ার মাধ্যমে পড়ার ধারণা ও অনুভূতি বিনিময় করেন তাঁরা।

২০১৬ সালে শিক্ষক তুং লিউআন শহরে একটি বই পড়ার কেন্দ্র স্থাপনের আবেদন করেন। তিনি স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকদের সাথে অনলাইন ও অফলাইনে বই পড়ার অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা বিনিময় করেন। এ কেন্দ্রের আওতায় আসে আশেপাশের ১০টিরও বেশি জেলার ৬০টিরও বেশি উপজেলার ৮০০০ জনেরও বেশি ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক। বাচ্চাদের পিতামাতারা মনে করেন, শিক্ষক তুংয়ের উদ্যোগ ছাত্রছাত্রীদের জন্য সবচেয়ে কল্যাণকর হয়েছে।

২০১৯ সালে তাঁর উদ্যোগে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষকরা একটি কর্মদল গঠন করে। প্রতি সপ্তাহে একটি প্রবন্ধ লেখা এবং প্রতি মাসে একটি বই পড়া তাদের কাজ। এভাবে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা একসাথে বই পড়ার মাধ্যমে জ্ঞান সমৃদ্ধ করতে পারে।

গত ১৮ বছরে শিক্ষক তুং গ্রামাঞ্চলের বাচ্চাদের পড়াশোনার বিশেষ পদ্ধতি খুঁজে পান। তিনি খেয়াল করেন, কবিতা আবেগের সমৃদ্ধ শিল্প, সুন্দর প্রকৃতিতে বড় হওয়া বাচ্চাদের জন্য রোম্যান্টিক চিন্তাধারার মতো। তিনি নিয়মিত বাচ্চাদের নিয়ে নদী ও পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন। বাচ্চারা নদী, ধানক্ষেত ও পাহাড়ের দৃশ্য থেকে কবিতার অনুপ্রেরণা খুঁজতে চেষ্টা করে।

২০১৩ সালে তিনি শিক্ষার ক্ষেত্রে সংস্কার চালু করেন। হুওছিউ জেলার গ্রামাঞ্চলের বাচ্চাদের কবিতার ক্লাস নেন তিনি। তিনি সবসময় বাচ্চাদের সাথে প্রকৃতি ও কৃষিকাজসম্পর্কিত কবিতা রচনা করেন; বাচ্চারা কবিতা ও উপন্যাস লেখার মাধ্যমে নিজেদের অনুভূতি সবার সাথে শেয়ার করতে পারে।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি নতুন একটি উদ্যোগ নেন। গ্রামাঞ্চলের বাচ্চাদের অনেকে পিতামাতার সাথে থাকে না। তাদের বাবা-মা বড় শহরে চাকরি করেন। তাদের উদ্দেশ্য করে তিনি ‘দূরের কবিতা’ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেন। প্রতি সপ্তাহে বাচ্চারা বাবা-মাকে চিঠি লেখে। তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সেইসব চিঠিতে। ৬০০টিরও বেশি শিশুতোষ কবিতা এবং ৫০০টিরও বেশি বই, গ্রামাঞ্চলের কবিতা কার্যক্রমে বিশেষ ভুমিকা রাখে। সেই থেকে বাচ্চাদের মধ্যে কবিতার প্রতি আকর্ষণ অনেক বেড়েছে।

তাদের লেখা কবিতা আনহুই প্রদেশের প্রাথমিক স্কুলের প্রতিযোগিতায় অনেক পুরস্কারও লাভ করেছে। বাচ্চাদের কেউ কেউ প্রাদেশিক পর্যায়ের সাহিত্য পুরস্কারও পেয়েছে। এ সম্পর্কে শিক্ষক তুং বলেন, “অতীতে আমরা কখনও এমন সাফল্যের কথা ভাবতে পারিনি। কবিতার মাধ্যমে বাচ্চাদের হৃদয় উষ্ণ করা যায় এবং তাঁরা পিতামাতার সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখতে পারে। এটি হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা আর পারিবারিক শিক্ষার সংমিশ্রণ।” শিক্ষক তুং মনে করেন, বড় শহরের শ্রেষ্ঠ স্কুলে না গিয়ে তাঁর গ্রামাঞ্চলে থেকে যাওয়ার তাত্পর্য রয়েছে। তিনি আন্তরিকতার সাথে গ্রামাঞ্চলের বাচ্চাদের শিক্ষা দিতে চান; গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার উন্নয়নে আরও বেশি অবদান রাখতে চান।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn