বাংলা

চীনের শানসি প্রদেশের সেরা শিক্ষক চাং চিয়ের গল্প

CMGPublished: 2023-09-04 16:11:12
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

একজন শিক্ষার্থী ভালো করে পড়াশোনা করলে, তাঁর পরিবার সুখী হতে পারে; একটি গ্রামের উন্নয়ন স্থানীয় গ্রামবাসীদের জীবনমান উন্নত করতে পারে। চীনের শানসি প্রদেশের ল্যুলিয়াং শহরের লিন জেলার বাইশুকৌ মাধ্যমিক স্কুলের প্রেসিডেন্ট চাং চিয়ে এমন কথা বলেছেন। টানা ১৪ বছর ধরে তিনি পরপর ৫টি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন এবং তাঁর বুদ্ধি, আবেগ ও পরিশ্রমের কারণে পাহাড়াঞ্চলের অনেক ছাত্রছাত্রী উপকৃত হয়েছে। তিনি চীনের মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের সেরা যুবশিক্ষকের সোনার পুরস্কার লাভ করেছেন। চলুন, শিক্ষক চাং চিয়ের গল্প বলি।

শিক্ষক চাং চিয়ে ও তাঁর স্ত্রী ওয়াং সিউ সিউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় পরস্পরের সাথে পরিচিত হন এবং ২০০৯ সালে স্নাতক হওয়ার পর দু’জন একসাথে শানসি প্রদেশের প্রথম দফার বিশেষ শিক্ষকদলের পরীক্ষায় পাস করেন। তাঁরা শানসি প্রদেশের দূরবর্তী এলাকার স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। শিক্ষক চাং চিয়ে তাঁর জন্মস্থান লিন জেলার সর্বপশ্চিমের ছুইয়ু মাধ্যমিক স্কুলে নিয়োগ পান এবং তাঁর স্ত্রী ওয়াং সিউ সিউ লিন জেলার সর্বদক্ষিণের চাওসিয়ান জেলার মাধ্যমিক স্কুলে নিয়োগ পান। দুই স্কুলের মধ্যে দূরত্ব ৮০ কিলোমিটারেরও বেশি। এই পথ আবার পাহাড়াঞ্চলের কঠিন রাস্তা। তখন থেকে নতুন দম্পতি আলাদাভাবে তাঁদের জীবন শুরু করেন।

অতীতের জীবন স্মরণ করে চাং বলেন, “তখন শিক্ষকদের হোস্টেল ছিল পুরনো গুহায়। সেখানকার বসবাসের অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। যাতায়াতব্যবস্থাও ছিল অসুবিধাজনক। তাই, আমি স্ত্রীর সাথে মাসে মাত্র দু’একবার দেখা করতে পারতাম। যদিও আমাদের জন্য জীবন একটু কষ্টের ছিল, তবে গ্রামাঞ্চলের বাচ্চাদের পড়াশোনার আগ্রহ দেখে আমরা পরস্পরকে উত্সাহ দেই এবং টানা ২ বছর নিজ নিজ স্কুলে পড়ানোর কাজ চালিয়ে যাই।”

২০১১ সালে শিক্ষক চাং এবং তাঁর স্ত্রী একসাথে লিন জেলার লিচিয়াপিং উপজেলার মাধ্যমিক স্কুলে কাজ করতে শুরু করেন। তাঁরা একসাথে মাধ্যমিক স্কুলের প্রথম বর্ষের একটি ক্লাসে পড়ান। তাঁরা আগ্রহের সাথে নতুন স্কুলে কাজ শুরু করেন। তবে, নতুন সেমিস্টারের প্রথম দিনে ক্লাসে গিয়ে একটু অবাক হয়ে যান। কারণ, ক্লাসরুমের প্রায় অর্ধেক আসন খালি; ক্লাসের ৫৯ জন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মাত্র ৩৭ জন বসে আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ছাত্রছাত্রীদের অনেকের বাবা-মারা নতুন শিক্ষকদের বিশ্বাস করেন না; তাঁরা বাচ্চাদের বড় শহরের স্কুলে স্থানান্তর করতে চান। কেউ কেউ বাচ্চাদের পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত করে চাকরি করতে উত্সাহ দেন।

এ খবর জেনে শিক্ষক চাং অনেক উদ্বিগ্ন হন। গ্রামাঞ্চলের বাচ্চারা যদি ভালো করে পড়াশোনা না করে, তাহলে তাদের সুন্দর ও সুখী জীবন কিভাবে নিশ্চিত করা যাবে?! এটা ভেবে দু’জন একসাথে ক্লাসের অন্যান্য ২০ জন ছাত্রছাত্রীকে খুঁজতে শুরু করেন। স্থানীয় পাহাড়াঞ্চলের পথ তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ, তাই স্কুলের সিনিয়র শিক্ষকদের কাছ থেকে হাতে আঁকা ম্যাপ এবং খাবার ও পানি নিয়ে দু’জন ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি যেতে থাকেন। প্রথমে বাচ্চাদের পিতামাতাদের সাথে আন্তরিকভাবে ভাব বিনিময় করেন তাঁরা। একটি পরিবারে শিক্ষক চাং টানা পাঁচ বার গিয়েছেন। অবশেষে এ পরিবারের বাবা তাঁর বাচ্চাকে স্কুলে যেতে দিতে রাজি হন।

নতুন সেমিস্টার শুরুর দুই সপ্তাহ পর শিক্ষক চাং ও তাঁর স্ত্রীর প্রয়াসে ক্লাসের সকল ছাত্রছাত্রী ক্লাসে ফিরে আসে। তখন থেকে তাঁরা প্রতিবছর ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের বাসায় নিয়মিত যাতায়ত করা শুরু করেন। গত ১০ বছরে দু’জন স্থানীয় ৪০টিরও বেশি গ্রাম সফর করেন। তাঁদের যাত্রাপথ প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার ছাড়িয়ে গেছে। এভাবে তাঁরা হাজারও ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনার স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করেছেন।

ভালোবাসা ছাড়া শিক্ষা সম্ভব নয়। শিক্ষক চাংয়ের একজন ছাত্রের নাম সিয়াওছি। তাঁর পিতামাতা অন্য শহরে চাকরি করেন। তাই সে চাচির বাসায় থাকে। শিক্ষক চাং সিয়াওছি’র অবস্থা জেনে নিয়মিত তার সাথে দেখা করতে থাকেন এবং সাপ্তাহিক ছুটিতে শিক্ষক ওয়াং তার কাপড় পর্যন্ত ধুয়ে দিতেন। শিক্ষক চাং ও তাঁর স্ত্রীর উত্সাহে সিয়াওছি ভালো করে পরীক্ষায় পাস করে এবং লিন জেলার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হতে সক্ষম হয়। ২০১৮ সালে সে থিয়ানচিন নর্মোল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। এ সম্পর্কে সে বলে, “আমিও শিক্ষক চাংয়ের মতো শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতে চাই।”

শিক্ষক চাংয়ের কম্পিউটারে সিয়াওছি’র চারটি ছবি রয়েছে। তার প্রাথমিক স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের ছবি। সিয়াওছি একজন লাজুক বাচ্চা থেকে ধীরে ধীরে আন্তরিক ও আত্মবিশ্বাসী ছাত্রে পরিণত হয়। এ সম্পর্কে শিক্ষক চাং বলেন, “সিয়াওছি’র পরিবর্তন থেকে আমরা ভালোবাসা ও শিক্ষাদানের মধ্যে সম্পর্কের তাত্পর্য অনুভব করেছি। কেবল ভালোবাসা থাকলে বাচ্চার শিক্ষাপথের যাত্রা সুন্দর হতে পারে।”

বর্তমানে শিক্ষক চাং লিন জেলার ৪ নম্বর মাধ্যমিক স্কুলের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর দৃষ্টিতে ছাত্রছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নজর রাখতে হবে। এভাবে তাদের চরিত্র ও পড়াশোনা উভয়ই উন্নত হতে পারে।

দূরবর্তী এলাকার বাচ্চাদের ভালো ও গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা বিশেষ শিক্ষক কার্যক্রমের উদ্দেশ্য। পাহাড়াঞ্চলের বাচ্চাদের জন্য জ্ঞান অর্জন ও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ জীবন পরিবর্তনের চাবিকাঠি। তাই শিক্ষকদের প্রধান কাজ, পাহাড়াঞ্চলের কোটি কোটি বাচ্চার পড়াশোনার স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করা।

চীনে শিক্ষার্থী-ঋণ টানা দুই বছর ধরে সুদমুক্ত

আগস্ট মাসের শেষ দিকে চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদের নিয়মিত অধিবেশনে ঘোষণা দেওয়া হয় যে, চলতি বছর ও গত বছর স্নাতক শিক্ষার্থীদের ঋণ সুদমুক্ত থাকবে। চীনের অর্থ মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীল কমকর্তারা নতুন শিক্ষার্থী-ঋণব্যবস্থা ও আবেদনকারীদের যোগ্যতা সম্পর্কে সংবাদদাতাদের জানান।

১. কে এবং কিভাবে শিক্ষার্থী-ঋণের জন্য আবেদন করা যায়

২০২২ ও ২০২৩ সালে স্নাতক হওয়া এবং এর আগে শিক্ষার্থী-ঋণের জন্য আবেদনকারী শিক্ষার্থীদের জন্য ২০২৩ সালের ঋণ সুদমুক্ত থাকবে। তবে, যদি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগে ঋণ ও সুদ পরিশোধ করা হয়ে থাকে, তাহলে এমন সুবিধা পাওয়া যাবে না।

চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের প্রধান কুও পেং বলেন, এবারের সুদমুক্ত প্রক্রিয়ার জন্য বিশেষ আবেদনপত্র লাগবে না; সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সরাসরি সংশ্লিষ্ট পদক্ষেপ নেবে। তবে, ২০২২ সালের স্নাতক শিক্ষার্থীদের এমন সুবিধার জন্য আলাদাভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।

২. কত টাকা পাওয়া যাবে?

যাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল ও বয়স ১৬ বছর বয়সের চেয়ে বেশি, এমন ছাত্রছাত্রী নিজেদের স্কুল বা জন্মস্থানের স্থানীয় সরকারের কাছে ঋণের জন্য আবেদন করতে পারবে। তাদের পড়াশোনাকালে ঋণের সুদ সরকার বহন করবে এবং স্নাতক হওয়ার পর ঋণের সুদ ও মূল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধ করবে। কলেজ ও অনার্সের ছাত্রছাত্রীদের বার্ষিক সর্বোচ্চ ঋণের পরিমাণ হবে ৮০০০ ইউয়ান এবং মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা বার্ষিক ঋণের সর্বোচ্চ পরিমাণ হবে ১২ হাজার ইউয়ান। শিক্ষার্থীরা স্নাতক হওয়ার পর এক বা দুই বছরের মধ্যে ঋণের মূল পরিশোধ করতে পারবে এবং ৬ বছরের মধ্যে সব ঋণ পরিশোধ করতে পারবে।

৩. কেন এমন নীতি চালু করা হয়েছে?

২০২২ সালে চীনে শিক্ষার্থী-ঋণ সূদমুক্ত করা আর ঋণের মূল পরিশোধের মেয়াদ স্থগিত করার নীতি চালু করা হয়। এ পর্যন্ত মোট ১ বিলিয়ন ৯৫ কোটি ইউয়ান সুদ বাতিল করা হয়েছে, মোট ৩৭.৯ লাখ ছাত্রছাত্রী এতে উপকৃত হয়েছে। চীনের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সহকারী মন্ত্রী ও ওয়েন হান বলেন, চলতি বছরে চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে স্নাতক শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১.১ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। যাদের পরিবারের আর্থিক সমস্যা রয়েছে, তাদের আর্থিক বোঝা কমাতে এমন ছাত্রছাত্রীদের ঋণের সুদ বাতিল ও ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

চলতি বছর প্রায় ২ বিলিয়ন ৩২.৫ কোটি ইউয়ানের সুদ বাতিল করা হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে এবং আরও ৫.৫ বিলিয়ন ইউয়ান ঋণ পরিশোধের মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হবে। এ সব পদক্ষেপে প্রায় ৪০ লাখ স্নাতক ছাত্রছাত্রী উপকৃত হবে।

জানা গেছে, ছাত্রছাত্রীদের ঋণের সুদ বাতিল হলে এসব খরচ কেন্দ্রীয় সরকার ও আঞ্চলিক সরকার বহন করবে। ২০২০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের উপযোগী ছাত্রছাত্রীদের জন্য মোট ১২২৫ কোটি ইউয়ান ঋণসুদ বাতিল করা হয়, যা ছিল বার্ষিক গড়ে ৪ বিলিয়ন ইউয়ান।

চলতি বছর শিক্ষার্থী-ঋণ পরিশোধে আরও শিথিল নীতি চালু করা হবে। শিক্ষার্থীরা স্নাতক হওয়ার পর ৫ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করার আবেদন করতে পারবে। এ সময়ের মধ্যে কেবল সুদ পরিশোধ করলেই হবে, মূল শোধ করতে হবে না।

চীনে শিক্ষার্থী-ঋণবিষয়ক সুবিধাজনক নীতিসহ ধারাবাহিক সুবিধাজনক নীতিমালার কারণে কোটি কোটি গরীব পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ বেড়েছে। তাঁরা স্নাতক হওয়ার পর ধারাবাহিকভাবে ঋণ পরিশোধের সুবিধা পেয়েছে। এভাবে কোনো চিন্তা না-করে ছাত্রজীবন কাটাতে পারবে তাঁরা এবং লেখাপড়া শেষ করে দেশের উন্নয়নে আরো বেশি অবদান রাখতে পারবে। যারা শিক্ষার্থী-ঋণের জন্য আবেদন করেছে, তাঁরা স্নাতক হওয়ার পর যদি চীনের মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলের অনুন্নত এলাকা বা দূরবর্তী এলাকায় চাকরি নিতে আগ্রহী হয়, তাহলে এমন ছাত্রছাত্রীদের ঋণ পরিশোধে আরো বেশি সুবিধা দেওয়া হবে। যারা স্নাতক হওয়ার পর সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে, তাদের ঋণ সরকার পরিশোধ করবে।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn