"হিউয়ান সাং-এর পশ্চিম যাত্রা" থেকে চীনা সভ্যতার "অমিলকে পাশে রেখে সম্প্রীতি বজায় রাখা"
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়নের জন্য পশ্চিম দিকে প্রাচীন ভারতে পাহাড় ও মরুভূমি পার হয়ে যাওয়া হিউয়ান সাং-এর গল্প সবাই শুনেছেন। তিনি চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় সংযুক্তকারী প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন ছিলেন। বাংলাদেশের অনেক বন্ধু হিউয়ান সাংয়ের নাম শুনেছেন। পরে তিনি যে "পশ্চিমাঞ্চল সম্বন্ধীয় মহা তাং রাজবংশীয় নথিসমূহ" লিখেছিলেন তা বাংলাদেশ-সহ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস জানার জন্য চীনা জনগণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বই।
প্রাচীন চীনে, বিভিন্ন জাতিসত্তার মধ্যে আদান-প্রদান প্রধানত বাণিজ্যিক কার্যক্রম যেমন- উপকরণ বিনিময়ের মাধ্যমে সম্পাদিত হত। পশ্চিম হান রাজবংশের সময়, খৃষ্টপূর্ব ১৩৯ সালে, হান রাজবংশের উ সম্রাট জাং ছিয়ানকে বন্ধুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পরিচালনার জন্য পশ্চিম অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার মাধ্যমে চীন থেকে মধ্য এশিয়া এবং পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক পথ খোলা হয়েছে। তা হল মধ্য-চীন থেকে পশ্চিম অঞ্চলের প্রথম দিকের রাস্তা এবং এর একটি সুন্দর নাম রয়েছে- "সিল্ক রোড"। হিউয়ান সাং সিল্ক রোড ধরে পশ্চিমে ভ্রমণ করেছিলেন, চীন ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ইতিহাসে একটি বিশেষ উজ্জ্বল অধ্যায় লিখেছেন এবং চীন ও বিশ্বের অন্যান্য জাতি ও দেশের মধ্যে বিনিময় ও সাংস্কৃতিক একীকরণে দুর্দান্ত অবদান রেখেছেন।
হিউয়ান সাং (৬০২-৬৬৪), সানজাং নামেও পরিচিত, চীনের ইতিহাসে একজন অসামান্য বৌদ্ধ পণ্ডিত, অনুবাদক এবং ভ্রমণকারী ছিলেন। তার আসল নাম ছিল চেন ওয়েই, হেনান প্রদেশের বাসিন্দা। সুই রাজবংশে যখন বৌদ্ধ ধর্ম প্রচলিত ছিল তখন হিউয়ান সাং জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক পরিবেশের প্রভাবে, শৈশব থেকেই বৌদ্ধধর্মের প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ছিল। পরে তিনি লুওইয়াং-এর চিংথু মন্দিরে একজন নবীন সন্ন্যাসী হন, যার ধর্মীয় নাম হিউয়ান সাং। পরবর্তীতে, তিনি বৌদ্ধ জ্ঞান শিখতে থাকেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন মন্দিরে তত্ত্ব অধ্যয়নের জন্য হুপেই, হেনান, শানতং, হেপেই এবং অন্যান্য স্থানের মন্দিরগুলিতে ভ্রমণ করেন।
হিউয়ান সাং তার বিস্তৃত অধ্যয়নের মাধ্যমে আবিষ্কার করেছিলেন যে, বৌদ্ধধর্ম সেই সময়ে অনেকগুলি সমাজে বিভক্ত ছিল এবং প্রতিটি সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের বিভিন্ন ব্যাখ্যা ছিল এবং কেউ কেউ একে অপরের বিরোধিতাও করত।
এ ছাড়া অনূদিত বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে অনেক ভুল রয়েছে, যা অস্পষ্ট এবং বোঝা কঠিন। তিনি পূর্ব চিন রাজবংশের ফা হিয়ানের কথা ভেবেছিলেন, প্রকৃত বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলি শেখার জন্য, তিনি তাঁর ৬০-এর বয়সেও অধ্যয়নের জন্য প্রাচীন ভারতে ভ্রমণ করেছিলেন। তাই, তিনি ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়নের জন্য প্রাচীন ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
৬২৭ সালে, তিনি ছাংআন ত্যাগ করেন এবং প্রাচীন ভারতে যাত্রা শুরু করেন। তিনি ঝুঁকি নিয়ে মরুভূমির দিকে যাত্রা শুরু করেন। শত কষ্টের পর অবশেষে তিনি তাঁর ইচ্ছা পূরণ করে ভারতে পৌঁছান। হিউয়ান সাং ১৭ বছর ধরে ভারতে ঘুরেছেন, লোক রীতিনীতি পর্যবেক্ষণ করেছেন, বৌদ্ধ ধ্বংসাবশেষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন এবং জ্ঞান অধ্যয়নের জন্য প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধ ধর্মের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান নালন্দা মন্দিরে অধ্যয়ন করেছেন। ৬৪৫ সালে, যখন হিউয়ান সাং ছাংআনে ফিরে আসেন, তখন দেশের মানুষ তাকে স্বাগত জানাতে রাস্তায় সারিবদ্ধ হয় এবং থাং রাজবংশের সম্রাট থাই জুং এমনকি ব্যক্তিগতভাবে তাকে স্বাগত জানান।
চীনে বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তিত হওয়ার পর, চীনা কনফুসিয়ানিজম, তাওবাদ এবং অন্যান্য স্থানীয় সংস্কৃতিতে প্রোথিত হয়েছিল, চীনা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে বৌদ্ধধর্ম গঠন করে এবং একটি অপেক্ষাকৃত স্বাধীন ধারার রূপ নেয়, অন্যান্য দেশের মতাদর্শের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত, একটি অনন্য চীনা ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়। এই কারণেই চীন আজ ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ ও আধিপত্য থেকে স্বাধীনতার উপর জোর দিচ্ছে। কারণ বিদেশি ধর্মীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে চীনের চিন্তাভাবনা হাজার হাজার বছর ধরে এমনই ছিল এবং এটি বিদেশি ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রতি চীনা সভ্যতার আচরণের একটি ঐতিহাসিক ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে।
বাস্তব বিশ্বে আন্তর্জাতিক বিনিময়ে, দেশগুলির মধ্যে পার্থক্য এবং দ্বন্দ্ব কেবল অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক সংঘর্ষের কারণে নয়, মতাদর্শ এবং সভ্যতার ধারণার পার্থক্যের কারণেও ঘটে। এই পার্থক্যকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে, "অমিলকে পাশে রেখে সম্প্রীতি বজায় রাখার" চিন্তার সাথে বিভিন্ন জাতীয় সংস্কৃতির মিলন এবং খোলামেলা ও সহনশীল মনোভাব নিয়ে একে অপরের কাছ থেকে শেখা ও যোগাযোগ করা প্রয়োজন। এটি অন্যান্য জাতির সংস্কৃতির প্রতি চীনা জাতির স্বতন্ত্র মনোভাব।