বাংলা

প্রাচীনকালে চীনারা কিভাবে কাবাব খেতো? জাদুঘর গেলে জানা যাবে বিস্তারিত

CMGPublished: 2023-05-15 15:00:06
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

সম্প্রতি চীনের শানতুং প্রদেশের জিবো শহর ইন্টারনেটে ব্যাপক সুপরিচিত হয়ে উঠেছে। কারণ, এ শহরের ঐতিহ্যিক মজাদার কাবাব চীনা পর্যটকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছে। অনেকে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবসের ছুটিতে গাড়ি বা ট্রেনে চেপে জিবোতে কাবাব খেতে যান। আসলে, চীনের বিভিন্ন এলাকায় এখন কাবাবের রেস্তোরাঁ দেখা যায়। একেক প্রদেশের কাবাব রান্নার পদ্ধতি ও স্বাদ একটু আলাদা। যেমন, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সিনচিয়াংয়ে লাল উইলো দিয়ে খাঁসির মাংসের কাবাব তৈরি করা হয়; কুয়াংতুং প্রদেশে বিভিন্ন সামুদ্রিক খাবার রসুন সসের সাথে মিশিয়ে কাবাব তৈরি করা হয়; ইয়ুননান প্রদেশের তৌফু কাবাবও বিখ্যাত। তাহলে জিবো শহরের কাবাব কেন এতো জনপ্রিয়? তাদের কাবাবের বৈশিষ্ট্য কী? ইন্টারনেটের ভিডিও থেকে দেখেছি, এখানকার কাবাব কেবল মাংস দিয়ে তৈরি নয়, শাকসবজি, সামুদ্রিক খাবার, রুটিসহ যে-কোনো খাবার জিবোতে কাবাব পদ্ধতিতে রোস্ট করা যেতে পারে। দোকানওয়ালা প্রত্যেক টেবিলের সামনে একটি ছোট সাইজের গরম চুলা দেন, ছোট সাইজের কাবাবগুলো অর্ধেক বেকড করার পর ক্রেতাদের হাতে তুলে দেন দোকানওয়ালা। গরম চুলায় সেগুলো কয়েক মিনিট রোস্ট করার পর তা খাওয়া যায়। বেশ মজাদার। মরিচ ও জিরাসহ বিভিন্ন মশলা ও সসের সাথে মিশিয়ে শানতুং প্রদেশে রুটির সঙ্গে কাবাব খাওয়া অনেক মজাদার।

আসলে দুই হাজার বছর আগে, প্রাচীন হাং রাজবংশ আমলে, চীনারা কাবাব খেতে শুরু করে। আজকের অনুষ্ঠানে জাদুঘরে কাবাবের সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ প্রদর্শনী থেকে চীনাদের কাবাব খাওয়ার ইতিহাস সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরব।

চীনের চিয়াংসু প্রদেশের স্যুচৌ শহরের জাদুঘরে ২২০০ বছর আগের, হান রাজবংশ আমলের, বারবিকিউ সরঞ্জামের ছবি প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। এ ছবিতে প্রাচীনকালে চীনাদের বারবিকিউ রান্নার ইতিহাস প্রতিফলিত হয়। এ সম্পর্কে স্যুচৌ জাদুঘরের চীনা চারুকলা হলের উপপরিচালক ছেন চাও বলেন, স্যুচৌ জাদুঘরের প্রধান প্রদর্শনী হলে একটি বেকওয়্যার দেখা যায়। সেটি খুব সম্ভবত প্রাচীনকালের চীনাদের কাবাব তৈরির সরঞ্জাম। এখানে কয়েকটি খোদাই করা পাথরের ছবি রয়েছে। সে ছবিগুলো থেকে দেখা যায়, লোকেরা মজা করে কাবাব খাচ্ছে।

সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যময় একটি খোদাই পাথরের ছবি পূর্ব হান রাজবংশ আমলে তথা ২২০০ বছর আগে তৈরি। এ ছবির উচ্চতা ৭৮ সেন্টিমিটার, বিস্তার ৭০ সেন্টিমিটার। পাথরের ছবিতে বারবিকিউ রান্নার দৃশ্য তুলে ধরে কয়েক জন ব্যক্তির আকার খোদাই করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজনের হাতে লম্বা ছুরি ও কর্তিত মাংসের টুকরা, একজনের হাতে পাখা, যা দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে কাবাব রোস্ট করার জন্য। পাশে কিছু মাংস ও বেঁধে রাখা ছাগলও দেখা যাচ্ছে। এ ছবি থেকে বোঝা যায়, ২২০০ বছর আগে চীনারা খাঁসির মাংসের রোস্ট পছন্দ করতেন। তত্কালীন চীনাদের মাংস টুকরো করে কেটে কাবাব তৈরি ও তা খাওয়ার পদ্ধতি আধুনিক চীনাদের মতোই।

যদিও রান্নার পদ্ধতিতে অনেক মিল রয়েছে, তবে হান রাজবংশ আমলের কাবাবের স্বাদ আধুনিক যুগের স্বাদের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। এ সম্পর্কে ছেন চাও বলেন, প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য ও শাস্ত্র থেকে জানা গেছে, পূর্ব হাং রাজবংশ আমলের মশলার ধরন ছিল খুবই কম। তখন জিরা ও মরিচসহ বিভিন্ন সুগন্ধী মশলার প্রচলন ছিল না। তাই প্রাচীনকালের লোকেরা মাংস খেতেন শুধু পানিতে সিদ্ধ করে। বারবিকিউর ক্ষেত্রেও কিছু সসের সাথে মিশিয়েই তাদের মাংস খেতে হতো। স্যুচৌতে প্রত্নতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা কিমা সসসহ বিভিন্ন সস‌ও অনুসন্ধান করেছিলেন। বর্তমানে যখন আমরা কাবাব খাই, তখন অবশ্যই জিরাসহ বিভিন্ন মশলা দেই। যদি হান রাজবংশ আমলের কাবাবের স্বাদ সম্পর্কে জানতে চাই, তাহলে বিনা মশলায় খেতে হবে কাবাব।

বস্তুত, স্যুচৌ চীনাদের বারবিকিউ’র উত্সস্থান নয়। তবে এখানকার জাদুঘরে প্রাচীনকালের চীনাদের বারবিকিউ রান্নার পদ্ধতি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আগুন দিয়ে খাবার রোস্ট করা প্রাচীনকালে মানবজাতির খাবার রান্নার একটি পদ্ধতি, যা মানুষ ও পশুর খাবার খাওয়ার পদ্ধতিতে পার্থক্য এনে দিয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা জানিয়েছেন যে, ৬ লাখ বছর আগে প্যালিওলিথিক যুগের পুরাকীর্তিতে অনেক পশুর হাড় আগুনে জ্বালানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর ৭০০০ বছর আগে চীনের চেচিয়াং প্রদেশের চিয়াসিং শহরের একটি সাংস্কৃতিক পুরাকীর্তিতে কাদামাটি দিয়ে তৈরি লম্বা আকারের গ্রিল শেল্ফ আবিষ্কার করা হয়েছে, যেটি আধুনিক যুগের গ্রিলের মতো সরঞ্জাম।

মানবজাতির উত্পাদন-শক্তির উন্নয়ন আর খাদ্যের সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যের কারণে, বারবিকিউ রান্নার পদ্ধতিও উন্নত হয়েছে। যেমন, মাংস আগুনের ওপর রেখে রোস্ট করা। প্রাচীনকালের যুদ্ধরত রাজ্যের সময়কাল তথা খৃষ্টপূর্ব ৪০০ সালের একটি গ্রিল আবিষ্কার করা হয়েছে। এটি একটি অভিজাত পরিবারের সমাধিতে পাওয়া গেছে। এর উপর স্তরে প্লেট আর নিচের স্তরে চুলা। এর নিচে তিনটি পা রয়েছে। চুলায় কয়েক ডজন ছোট কাঠকয়লাও পাওয়া গেছে। এ সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ থেকে বোঝা যায়, সেই সময়ের অভিজাতদের রোস্ট মাংস খাওয়ার অভ্যাস ছিল।

হাং রাজবংশ আমলে তথা খৃষ্টপূর্ব ২০০ সালে রাজা লিউ বাং নিয়মিত রোস্ট কাবাব খেতেন। তিনি গরুর মাংস, হরিণের মাংস, মুরগীর মাংস আর মাছসহ বিভিন্ন খাবার বারবিকিউ করে খেতে পছন্দ করতেন। নিংসিয়া হুই জাতির স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের চোওয়ে জেলার একটি হাং রাজবংশ আমলের সমাধিতে খাঁসির মাংসের কাবাবও আবিষ্কার করা হয়। এর সাথে খাবার বক্সের মধ্যে তিনটি ‘রুটির’ আকারের খাবারও খুঁজে পাওয়া গেছে। খুব সম্ভবত, রুটি ও কাবাব একসাথে খাওয়ার রীতি হান রাজবংশ আমল থেকে শুরু হয়েছে।

তবে, প্রাচীনকালে বিভিন্ন ধরনের বারবিকিউ কেবল অভিজাতরা খেতেন তা নয়, সাধারণ মানুষও এ খাবার খেতেন। তুংহান আমলের একটি খোদাই পাথরের ছবিতে দেখা যায়, দু’জন চাকর চুলার সামনে দাঁড়িয়ে কাবাব রান্না করছে।

জাদুঘরের প্রদর্শনী থেকে বোঝা যায়, হান রাজবংশ আমল থেকে চীনাদের বিরবিকিউ খাবারের ধরণ ব্যাপকভাবে উন্নত হতে শুরু করে। গরুর মাংস আর খাঁসির মাংস ছাড়া মাছ ও খরগোশের মাংসও তখন খাওয়া হতো। এ সম্পর্কে অধ্যাপক ছেন চাও বলেন, হান রাজবংশ আমলে তত্কালীন কৃষি, বনায়ন ও মত্স্যসহ বিভিন্ন শিল্পের উন্নয়ন ঘটে। গম, ধান, সারগমসহ বিভিন্ন খাদ্যশস্যও তখন চাষ করা হতো। তা ছাড়া, মশলার ধরণও অনেক সমৃদ্ধ ছিল। সয়াবিন পেস্ট, চিংড়ি পেস্ট, গোল মরিচ আর তিলের তেলসহ বিভিন্ন আধুনিক মশলা তখন খাওয়া হতো। ধীরে ধীরে বাবিরকিউ ধর্মীয় কারণে উত্সর্গকৃত খাবার থেকে অভিজাত শ্রেণীর খাবারে পরিণত হয়। আর এইভাবে তা আধুনিক চীনাদের খাবারের টেবিল পর্যন্ত পৌঁছেছে।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn