চায়ের টেবিলে বসে পড়ুন ‘চায়ের বই’
বাংলাদেশের মানুষের সকালে ঘুম থেকে উঠে এক কাপ গরম চা না-হলে আড়ষ্টতা কাটে না। অতিথি আপ্যায়নেও চায়ের জুড়ি নেই। ছেলে-বুড়ো সকলেই চায়ের ভক্ত। অনেকেই জানেন যে, চায়ের উত্পত্তিস্থল চীন। চা চীনা জনগণের জীবনের সাথে গভীরভাবে মিশে আছে। চীন থেকেই চা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। চীনের চা ও চা-শিল্প সম্পর্কে জানতে পড়তে হবে লু ইউ-এর ‘চা চিং’ তথা ‘চায়ের ক্লাসিক বই’।
চীনের চা-প্রেমীরা প্রতি বসন্তের প্রথম দিকে সেই বছরের নতুন চা খাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। আজকের অনুষ্ঠানে আমি আপনাকে সুগন্ধি চায়ে চুমুক দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। চলুন, আমার সাথে চীনের চা সম্পর্কে প্রাচীনতম সাংস্কৃতিক ক্লাসিক ‘চা চিং’ পড়ুন।
চা প্রসঙ্গ এলে চীনে সবার আগে মনে পড়ে শেননং-এর কথা; তাঁর সব ধরনের হার্বালের স্বাদ গ্রহণের কিংবদন্তির কথা। আসলে চীনের থাং রাজবংশ চা সংস্কৃতির বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। সমৃদ্ধ বস্তুগত ভিত্তি গড়ে তোলা পাশাপাশি, থাং রাজবংশ আমলের লোকেরা উচ্চ স্তরের আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি চর্চায়ও মন দিয়েছিল। ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে থাং রাজবংশ আমলের লু ইউ রচিত "চা চিং" বইটিকে বলা যেতে পারে চীনা চা সংস্কৃতির প্রবর্তক। তারপর থেকে, চীনা কৃষকরা প্রতি বসন্তে তাদের উত্পাদিত সেরা চা সম্রাটকে উত্সর্গ করা শুরু করে। সেসময় পরিবহনের সুবিধার জন্য চা পাতার বোঝা দুটি ইটের মাঝখানে বেঁধে দেওয়া হতো। এই চায়ের টুকরোগুলিকে পরে সুবিধামতো পান করার জন্য গুঁড়ো করে সিদ্ধ করা হয়।
"চা চিং" লবণ ছাড়া অন্য কিছু যোগ না-করে পরিষ্কার চা পানের পক্ষে। এভাবে চা-পান মানুষকে সতেজ ও স্বাস্থ্যবান করে। অতএব, "চা চিং" প্রকাশের পর "চা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে" এবং "গোটা বিশ্ব চা পান করে উপকৃত হয়"।
‘চা চিং’ বইয়ে, লু ইউ চা রোপণ, চা তৈরি এবং চায়ের স্বাদ গ্রহণের বিভিন্ন কৌশলের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন। এটি তাঁর অনেক বছরের গবেষণা ও অনুশীলনের ফল। এতে তিনি চীনের দক্ষিণাঞ্চলে চা-চাষের পদ্ধতি ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর বইয়ের কারণে তত্কালে চা-পানকারীর সংখ্যা ও চায়ের চাহিদা ক্রমশ বাড়তে থাকে। সেই সাথে চায়ের উত্পাদন ও বাণিজ্যও সম্প্রসারিত হয়।
"চা চিং" চায়ের সাংস্কৃতিক চরিত্রকেও সংজ্ঞায়িত করেছে। বইটির ‘চায়ের উত্পত্তি’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে: "চায়ের কার্যকারিতা, তার শীতল প্রকৃতির কারণে, অভ্যন্তরীণ তাপ কমাতে পারে; একটি পানীয় হিসাবে, এটি ভালো আচরণ ও মিতব্যয়ী গুণসম্পন্ন লোকদের পান করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত।"
বইটি প্রথমবারের মতো চায়ের গুণাবলী ও মানুষের আচরণের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে। তারপর থেকে চা আর কেবল একটি সাধারণ শখের জিনিস নয়, বরং "ভালো ও মিতব্যয়ী" লোকদের নিজেদের চরিত্র লালন করার, তাদের আকাঙ্খার চর্চা করার, এবং তাদের অনুভূতি গড়ে তোলার একটি উপায়।
লু ইউ চা-শিল্পের সমস্ত দিকের ব্যাখ্যা দিয়েছেন: ভালো চা, চায়ের জন্য উপযুক্ত পানি, ভালো কাঠকয়লার আগুন, সম্পূর্ণ চা খাওয়ার সেট, সম্পূর্ণ চা তৈরির প্রক্রিয়া, পান করার নীতি, এবং চা সেটের সরলীকরণের নীতি, ইত্যাদি সবকিছুই উঠে এসেছে তাঁর গ্রন্থে। বলা যেতে পারে, "চা চিং" চা-শিল্পের বৈশিষ্ট্যগুলোকে সংজ্ঞায়িত করেছে। আর এর পরবর্তী প্রজন্ম চা-শিল্পের বিকাশ ও পরিবর্তনের ভিত্তি স্থাপন করে।
"চা চিং" মানব ইতিহাসের প্রথম চা-সম্পর্কিত বই, যা চায়ের সাংস্কৃতিক যুগের সূচনা করেছিল। তারপর থেকে চায়ের বিদ্যা ও বৈজ্ঞানিক দিক সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলেছে। কিন্তু, মানবতাবাদী চেতনা, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং চায়ের সবচেয়ে মৌলিক সংজ্ঞাটি কখনই সেকেলে হয়নি। পরবর্তী প্রজন্ম "চা চিং"-এ বর্ণিত "সূক্ষ্ম অনুশীলন ও মিতব্যয়ীতা"-র ধারণা বাইরের দুনিয়া ছড়িয়ে দিয়েছে।