বাংলা

পিতামাতার সাথে সন্তানের সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উপায় প্রসঙ্গে

CMGPublished: 2023-04-03 15:30:35
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

পরিবার প্রতিজন মানুষের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর পরিবারে পিতামাতার সাথে সন্তানের সুসম্পর্ক থাকাটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত, বিশ্বে নিখুঁত বাবা-মা খুঁজে পাওয়া মুশকিল; নিখুঁত সন্তানও বিরল। আমাদের সবারই নানান দুর্বলতা আছে। আমরা এসব দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে পারি। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা লেখিকা কাও লিনের একটি প্রবন্ধের বক্তব্য শেয়ার করবো। তিনি পিতামাতার সাথে সন্তানের সুসম্পর্ক গড়ে তোলার প্রশ্নে কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি প্রবন্ধে পিতামাতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক এবং এ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সমস্যা নিয়েও আলোচনা করেছেন।

সম্প্রতি মালিয়েশিয়ার প্রবাসী চীনা অভিনেত্রী মিশেল ইয়োহ ‘Everything Everywhere All at Once’ নামের একটি চলচ্চিত্রে চমত্কার অভিনয় করার জন্য অস্কার পেয়েছেন। এ চলচ্চিত্রে প্রবাসী চীনা নারীর মধ্যজীবনের উদ্বেগ এবং পিতামাতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক ও সন্তানের বড় হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা হয়েছে।

লেখিকা মা লিন মনে করেন, সাধারণ মানুষের জীবন যেন অনেকটা এ চলচ্চিত্রের মতো। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে তিনি বলেন, ২০২৩ সালের বসন্ত উত্সবের আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে ১৮ বছর বয়সী ছেলেকে দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। তবে, ঠিক সেই সময় তাঁর বয়স্ক পিতামাতা কোভিডে আক্রান্ত হন। ফলে, কয়েকবার যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার বিমানটিকিটের তারিখ বদলাতে হয়। এ প্রক্রিয়ায় একসময় তিনি শিশুর মতো কেঁদেছেনও। আসলে, মধ্যবয়সীদের কাঁধে সাধারণত একাধারে নিজেদের পিতামাতা ও সন্তানের দেখভালের দায়িত্ব থাকে। তিনি এই দুই দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়েছিলেন মহামারীর সময়।

যাই হোক, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি পিতামাতার সাথে সন্তানের সুসম্পর্ক গড়ে তোলা ও তা বজায় রাখার জন্য কয়েকটি টিপস দিয়েছেন। আসুন সেগুলো নিয়ে আলোচনা করি।

চীনের প্রাচীনকাল থেকে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে: ‘সন্তানের জন্য পিতামাতার ভালোবাসা গরুর চুলের চেয়ে বেশি এবং পিতামাতার জন্য সন্তানের ভালোবাসা গরুর চুলের মতো ছোট।’ আসলে, সন্তানের জন্য পিতামাতার ভালোবাসা কখনও কমে না। তবে, সন্তানের কাছে পিতামাতা অনেককিছু আশা করেন। তাঁরা চান, সন্তান স্মার্ট হবে, পড়াশোনায় ভালো করবে, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে, ইত্যাদি। অন্যদিকে, যদিও পিতামাতার জন্য সন্তানের ভালোবাসা ততটা গভীর নয়, তবে যেটুকু ভালোবাসা আছে, সেটুকু বিশুদ্ধ বলা যায়।

কোনো সন্তানই তাঁর মা-কে বলে না: ‘মা, তুমি আরও সুন্দর হলে আমি তোমাকে আরও বেশি ভালোবাসতাম’, বা ‘আমি আরও ধনী পরিবারে জন্ম নিলে ভালো হতো’। বস্তুত, প্রত্যেক সন্তানের কাছে তাঁর আপন মা সবচেয়ে সুন্দর নারী এবং পিতা সবচেয়ে ভালো পুরুষ।

শিশুরা সাধারণত বড়দের, বিশেষ করে পিতামাতাকে অপছন্দ করে না। কিন্তু যদি পিতামাতা সবসময় শিশু-সন্তানের সমালোচনা করেন, তখন তার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। পিতামাতা অবশ্যই সন্তানের কল্যাণের জন্যই মাঝেমাঝে তার কাজের সমালোচনা করবেন, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সবসময় সন্তানের সমালোচনা করা ঠিক না। ছোট একটি শিশু ভুল করবে এবং ভুল করে করে শিখবে। পিতামাতাকে এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে। শিশুকে তার ভুল ধরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি, তার অন্যান্য ভালো কাজের প্রশংসাও করতে হবে। সমালোচনা ও প্রশংসা হতে হবে ভারসাম্যপূর্ণ। শিশুদের জন্য সৃষ্টি করতে হবে এমন একটি পরিবেশ, যেখানে তারা নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারবে।

আরেকটি বিষয় মনে রাখা দরকার। সন্তান পিতামাতাকে ভালোবাসলেও, সাধারণত বড় হওয়ার পর তাদের সাথে থাকতে চায় না। কারণ, ভালোবাসার সাথে দায়িত্বও থাকে। পিতামাতা বৃদ্ধ হলে তাদের দেখভালের বিষয়টিও একটি বাস্তবতা। কোনো কোনো সন্তান এই দায়িত্ব পালন করে খুশিমনে; আবার কোনো কোনো সন্তান এ দায়িত্ব পালন করতে চায় না। এই বাস্তবতা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।

যদি, কোনো কারণে পিতামাতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক স্রেফ দায়িত্বের হয়, সেখানে ভালোবাসার উপস্থিতি কম থাকে, তবে সহাবস্থান আনন্দদায়ক হয় না। লেখিকার ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করছে। এখন তার বয়স ১৮ বছর। ছুটির দিনে ছেলে বাবাকে ফোন করতে পছন্দ করে। তবে, মা-র সাথে তার ফোনে কথা হয় কম। কারণ, ফোন করলেই মা জানতে চান: ‘তুমি মা-র চরিত্রের কোন দিকটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করো?’ এ ধরনের প্রশ্নে ছেলে বিব্রত হয়। কখনও কখনও মন ভালো থাকলে বলে, মা-র সবকিছুই তার পছন্দ।

এ বিষয়টি নিয়ে লেখিকা সবসময় চিন্তা করেন। সন্তান বড় হয়ে মন থেকে বাবা-মাকে পছন্দ করবে বা তাদের সাথে থাকতে চাইবে—এমনটা প্রত্যেক বাবা-মা চান। এটা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

লেখিকার বাবা-মা কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার কারণে তিনি ছেলেকে দেখতে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারেননি। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি কেবল বাবা-মায়ের যত্ন নেওয়ার জন্য চীনে থাকি না, বরং তাদের সাথে আমি সবসময় থাকতে চাই বলেই থাকি। আমি মা-কে অনেক ভালোবাসি। আমি তাঁর সাথে সময় পেলে আড্ডা দিতে পছন্দ করি।’

লেখিকার মাতা বেশ প্রাণচঞ্চল ও আশাবাদী মানুষ। তবে কোভিড সনাক্ত হওয়ার পর তিনি অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েন। তখন লেখিকা নিয়মিত মা-র সাথে উইচ্যাটে কথা বলতেন এবং তাঁর যত দ্রুত সম্ভব তাকে সুস্থ হয়ে উঠতে উত্সাহ দিতেন।

তাঁর দৃষ্টিতে, পিতামাতার দায়িত্ব নেওয়া সন্তানের কাজ। তবে, সর্বপ্রথমে আলাদা মানুষ হিসেবে জীবন কাটানোর জন্য সন্তানকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। স্বাধীন ও স্বতন্ত্র চরিত্র গঠন সন্তানের জন্য ভালো।

পিতামাতাদের একটি সাধারণ সমস্যা হলো সন্তানকে বকাঝকা করা, সবসময় সন্তানকে নিয়ে তাদের উদ্বেগ ও চিন্তা সমালোচনা ও বকাঝকার মাধ্যমে প্রকাশ করা। এ সমালোচনা কোনো সন্তান শুনতে চায় না, যদিও তা করা হচ্ছে তাদের কল্যাণের জন্যই। তখন বকাঝকা উল্টো ফল বয়ে আনে। তাই সন্তানের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইলে বকাঝকার বদলে, তাদের জন্য বেশি বেশি সুস্বাদু খাবার রান্না করা বেশি কার্যকর। তার মানে এই নয় যে, বকাঝকা করা যাবে না। সেটার জন্য উপযুক্ত সময় বেছে নিতে হবে এবং বন্ধুর মতো সন্তানের সাথে আচরণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে সন্তান বকাঝকার মর্ম বুঝতে পারবে বলে আশা করা যায়।

নিজের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে লেখিকা বলেন, তাঁর ছেলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়াশোনার সময় তিনি ছেলের স্নাতক হওয়ার পর চাকরি ও ভবিষ্যতের লেখাপড়া নিয়ে অনেক উদ্বিগ্ন ছিলেন। তখন স্বামী তাকে বলেন, এখন মাত্র প্রথম বর্ষে আছে ছেলে; এ নিয়ে পরে চিন্তা করো। একদিন ছেলে তাঁদের বলে, ‘আমি স্নাতক হওয়ার পর মাস্টার্সে ভর্তির জন্য আবেদন করবো।’ ছেলের কথা শুনে মা শান্ত হয়ে যান। কারণ, সেটি ছেলের নিজের সিদ্ধান্ত, পিতামাতার পরামর্শ শোনার চেয়ে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়া আরও খুশির ব্যাপার।

যখন পিতামাতা কোনো ভুল করেন, তখন সময়মতো দুঃখ প্রকাশ করা জরুরি। এ থেকে হয়তো বাচ্চারা শিখবে যে, ভুল করলে দুঃখ প্রকাশ করতে হয়। বাচ্চারা সাধারণত ভুল করে দুঃখ প্রকাশ করে না। এটা স্বাভাবিক। তারা ভুল করতে করতেই শিখবে। পিতামাতার উচিত নয় তাদের মুখ থেকে ‘সরি’ শব্দটি শোনার জন্য অপেক্ষা করা। কিন্তু নিজেরা যদি মাঝেমাঝে ‘সরি’ বলেন, তবে হয়তো সন্তানও ‘সরি’ বলা শিখবে।

নিখুঁত পিতামাতা বলে কিছু নেই; পিতামাতার দুর্বলতাকে মেনে নিতে হবে। অনেক সন্তান ছোটবেলায় মনে করে বড় হয়ে বাবা বা মায়ের মতো হবে। কিন্তু বড় হয়ে হয়তো সে বুঝতে পারে যে, পিতামাতা নিখুঁত ছিলেন না; তাকে আরও ভালো হতে হবে। এটা চমত্কার একটি ব্যাপার। সন্তানের এই বোধ পিতামাতার জন্য আনন্দদায়ক। তবে, সন্তানের উচিত পিতামাতার দুর্বলতাকে মেনে নেওয়া এবং তাদের প্রতি নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা।

আমরা নিজেদের পিতামাতাকে বেছে নিতে পারি না। কোনো মানুষই তা পারে না। তবে, আমরা নিজেদের চরিত্র গঠন করে সুখী পরিবার গঠন করতে পারি বা অন্তত তার জন্য চেষ্টা করতে পারি। আমরা আমাদের বাচ্চাদের জন্য সুখী পরিবার গড়ে তুলতে সচেষ্ট হতে পারি এবং পিতামাতার প্রতি দায়িত্বও পালন করতে পারি। সুস্থ পরিবেশের একটি পরিবার শিশু ও বৃদ্ধ—সবার জন্যই কল্যাণকর।

অনেক পিতামাতা সন্তান লালনপালন নিয়ে সর্বদা উদ্বিগ্ন থাকেন। তবে, বিশেষজ্ঞরা বলেন, পিতামাতা যদি সন্তানকে যথেষ্ট ভালোবাসা দেন ও তার যত্ন নেন, তবে সন্তানের মানসিক অবস্থা সুসংহত হবে। তাই প্রত্যেক বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের সঠিক মূল্যবোধ ও অভ্যাস সৃষ্টিতে পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা। শিশু-সন্তানের জন্য এই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ খুব জরুরি একটা বিষয়।

চীনের শিক্ষাবিদ অধ্যাপক চেং শি ছিয়াং বলেন, বিশ্বে মানুষের ওপর সবেচেয়ে বেশি প্রভার ফেলে নিজের পরিবার ও স্কুল। বিভিন্ন পরিবারের চরিত্র ও জীবনযাপনে পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু প্রতিটি পরিবারে বাচ্চাদের জন্য ভালোবাসার কমতি থাকা উচিত নয়। বাচ্চাদের জন্য একটা সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করা পিতামাতার দায়িত্ব। আমরা আশা করি, প্রতিটি শিশু ভালোবাসাময় পরিবেশে বড় হবার সুযোগ পাবে।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn