বাংলা

চীনের তাইওয়ান প্রদেশের স্বেচ্ছাসেবক কর্মীদের সাইকেল-যাত্রা

CMGPublished: 2022-08-08 16:39:42
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

জুলাই মাসে চীনের সিয়ামেন শহরে অনেক গরম পড়ে। এই গরমে একদল সাইক্লিস্ট সিয়ামেন শহরের তাতেং দ্বীপ থেকে লম্বা সাইকেল-যাত্রা শুরু করেন। ২০ জনের দলটির ১৭ জন চীনের তাইওয়ান প্রদেশের। তারা চীনের দুই তীরের সাংস্কৃতিক বিনিময় অনুষ্ঠানের অতিথি হিসেবে সিয়ামেনে সফর করতে আসেন। কেন সাইকেল চালিয়ে চীন ভ্রমণ করেন তাঁরা? আজকের অনুষ্ঠানে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব আমরা।

২০১১ সালে তাইওয়ান প্রবাসী ইয়াং মিন চুং হাংচৌ শহরে একটি পরামর্শক কোম্পানি চালু করেন। তিনি কেবল পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন, তা নয়; বরং সামাজিক দাতব্য কার্যক্রমেও ব্যাপক আগ্রহী তিনি। হাংচৌ থেকে তাইওয়ান প্রদেশে ফিরে যাওয়ার পর তিনি তাইওয়ান প্রদেশের চাংহুয়া জেলার একটি অনাথ আশ্রমে যান। সেখানকার বাচ্চারা সাইকেল চালাতে বেশ পছন্দ করে। এ স্মৃতি স্মরণ করে ইয়াং বলেন, বাচ্চাদের পিতামাতা না-থাকলেও, তারা আত্মনির্ভরশীল। সাধারণত তারা সাইকেল চালিয়ে নানান এলাকায় যায়, বাতাস ও বৃষ্টি থাকলেও বাসে উঠতে চায় না। চীনের মূলভূভাগ সফরের আগ্রহ প্রকাশ করে বাচ্চারা। তাই তাদের মূলভূভাগে সাইকেল চালিয়ে আসার স্বপ্নপূরণে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন ইয়াং।

২০১২ সালের গ্রীষ্মকালে ইয়াং মিন চুং এবং অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবক কর্মীরা ৩৫ জন কিশোর-কিশোরী নিয়ে সাফল্যের সঙ্গে সাইকেল-যাত্রা সম্পন্ন করেন। এই যাত্রার অংশ হিসেবে তারা তাইওয়ান প্রদেশ থেকে মূল ভূভাগে আসে এবং বেইজিং থেকে সিয়ামেন পর্যন্ত যাত্রাও শুরু করে।

এ অভিজ্ঞতা স্মরণ করে ইয়াং বলেন, প্রথম দলে মোট ৭৫ জন ছিল। টানা ৪০ দিন ধরে ৩২০০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ সাইকেল চালিয়েছে তারা। সেটি বেশ চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার ছিল। যাত্রার ব্যয় কমাতে সবাই যার যার সাইকেলের যত্ন নেয়। তবে যাত্রাপথে তাদের থাকা-খাওয়ার বিষয়ে আপষ করতে হয়। তবে বাচ্চারা কেউ অসন্তোষ প্রকাশ করেনি। বরং নানান সমস্যা মোকাবিলা করে তাদের যাত্রা সম্পন্ন করে।

যখন তাইওয়ান প্রদেশের বাচ্চারা বেইজিংয়ের মহাপ্রাচীরে এসে দাঁড়ায়, তখন আনন্দের সাথে চিত্কার করে তারা বলে, ‘আমারাও সাহসী মানুষ হতে পেরেছি!’ বার্ডনেস্ট দেখে ২০০৮ সালের অলিম্পিকের স্মৃতিও তাদের চোখের সামনে ভাসে। যদিও সাইকেলযাত্রা অনেক ক্লান্তিকর ব্যাপার, তবে বাচ্চারা এমন কার্যক্রমের মাধ্যমে নিজেদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নেয়।

স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক ইয়াং মিন চুংও নিজের স্বপ্ন পূরণ করেছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তাইওয়ান প্রদেশের বাচ্চাদের নিয়ে এই সাইকেল-যাত্রা তাদের জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। মূল ভূভাগের স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে গভীর মৈত্রীর সম্পর্কও সৃষ্টি হয়েছে। আমার কাজ বেশ তাত্পর্যপূর্ণ ছিল।”

সমাজের বিভিন্ন মহলের উদ্যোগ ও সাহায্যে চলতি বছর সাইকেল-যাত্রার এই কার্যক্রম দশম বছরে পড়েছে। গত ১০ বছরে তাইওয়ানের ৫৫০ জন কিশোর-কিশোরী এবং ৩৭০ জন দরিদ্র্য পরিবারের বাচ্চা সাইকেল-যাত্রা কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। যাত্রাপথে তারা তাইওয়ান প্রণালীর দুই তীরের ৫৫টি শহর ভ্রমণ করেছে; অতিক্রম করেছে মোট ১২ হাজার কিলোমিটার পথ।

বর্তমানে এ প্রকল্পের সাথে চীনের মূল ভূভাগের ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমিতি ও সাইকেল পরিষদের মাধ্যমে প্রতিবছর নতুন স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়। ছাত্রছাত্রীরা আন্তরিকতা ও আবেগ নিয়ে এ কাজে অংশ নেয়। স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা ৮০০ জনে দাঁড়িয়েছে।

মেয়ে ওয়াং ওয়ান পিন চীনের মূল ভূভাগের একজন স্বেচ্ছাসেবক। তিনি টানা তিন বছর ধরে সাইকেল-যাত্রা প্রকল্পে অংশ নিচ্ছেন। এ কার্যক্রমের আওতায় অনেক তাইওয়ানবাসী বন্ধুর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন তিনি। সেটি তাঁর কাছে অনেক মুগ্ধকর স্মৃতি।

২০১৮ সাল থেকে তাইওয়ানের আরও উপকণ্ঠ এলাকা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য সাইকেল-যাত্রা কমিউনিটি গড়ে তুলতে সহায়তা দেয় ‘সাইকেল যাত্রা’ প্রকল্পের আয়োজকরা। ২০১৯ সালে চীনের সাইকেল যাত্রী পরিষদ তাইওয়ান প্রদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়। জনাব ইয়াংও এ পরিষদের প্রধান হিসেবে কাজ করে থাকেন।

অনেক বাচ্চা যারা স্কুলের পড়াশোনা পছন্দ করে না বা আত্মনিয়ন্ত্রণে দুর্বল, তাদের অনেকে সাইকেল-যাত্রার মাধ্যমে মানসিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটিয়েছে। তাদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ অনেক বেড়েছে।

এ সম্পর্কে শিক্ষক ইয়াং বলেন, “সাইকেল চালিয়ে দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করা আমাদের সাইকেল-যাত্রার মূল উদ্দেশ্য নয়, বরং এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আত্মউন্নয়ন করাই আসল উদ্দেশ্য।” কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে ‘সাইকেল যাত্রা’ প্রকল্পের অনলাইন অনুষ্ঠানও নিয়মিতভাবে আয়োজিত হয়।

চলতি বছর চীনের সিছুয়ান প্রদেশের লিয়াংশান অঙ্গরাজ্য এবং কানজি অঙ্গরাজ্যের অবস্থানরত দুটি প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সাথে দেখা করার পরিকল্পনা করেছেন শিক্ষক ইয়াং। এভাবে দুই তীরের পাহাড়াঞ্চলের বাচ্চারাও সাইকেল-যাত্রার আমেজ উপভোগ করতে সক্ষম।

‘দ্বৈত হ্রাস নীতি’ চালুর এক বছরে বাচ্চাদের গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে নতুন পরিবর্তন

বর্তমানে চীনা ছাত্রছাত্রীদের গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছে। গত বছরের জুলাই মাসে সারা চীনে বাচ্চাদের পড়াশোনা ও স্কুলের বাইরে অতিরিক্ত ক্লাসের চাপ কমিয়ে দিতে ‘দ্বৈত হ্রাস নীতি’ চালু হয়। নতুন নীতি চালুর পর এ বছরের গ্রীষ্মকালীন ছুটি কেমন চলছে? সংবাদদাতারা বিভিন্ন প্রদেশের ছাত্রছাত্রীদের সাথে কথা বলেছেন এ ব্যাপারে। আগের তুলনায় এখন তারা গরমের ছুটিতে বেশি মজা করতে পারছে।

চীনের হুপেই প্রদেশের চুংসিয়াং শহরের একটি প্রাথমিক স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী ওয়াং হাও নুওয়ের ছুটি কাটছে গত বছরের চেয়ে অনেক বেশি আনন্দে। চীনা ভাষা ও গণিতসহ বিভিন্ন ক্লাসের হোমওয়ার্ক অনেক কমে গেছে এবং বিভিন্ন সামাজিক অনুশীলন বা শ্রমের কাজ বেশি হয়েছে। বাবা-মায়ের সাথে ঘরের কাজ করা ও খেলাধুলার ছবি বা ভিডিও তুলে সহপাঠীদের সাথে অনলাইনে শেয়ার করা তার জন্য খুবই মজার ব্যাপার।

উহান শহরের এক প্রাথমিক স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী উ হাও ইয়ু গরমের ছুটিতে বাবা-মায়ের কাছে রান্না শেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গ্রীষ্মকালের লিখিত হোমওয়ার্ক ছুটি শুরুর কয়েকদিনের মধ্যে শেষ করেছে ছেলে উ। এখন ছুটির বাকি দিনগুলোতে আরও বেশি ঘরের কাজ শেখা ও শরীরচর্চা করার পরিকল্পনা করেছে সে।

চুংসিয়াং শহরের বিভিন্ন প্রাথমিক স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের গরমের ছুটিতে চীনা ভাষা, গণিত ও ইংরেজি হোমওয়ার্কের পাশাপাশি নৈতিকতার চর্চা, খেলাধুলা, নান্দনিক প্রশিক্ষণ ও শ্রমের অনুশীলনও দেওয়া হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা স্বেচ্ছাসেবকের কাজে অংশ নিতে পারে, দৌড়াদৌড়ি ও ফুটবল খেলতে পারে, সুবিখ্যাত ও জনপ্রিয় শাস্ত্র ও উপন্যাস পড়তে পারে এবং বিভিন্ন পেশার কাজও চর্চা করতে পারে।

গ্রীষ্মকালীন ছুটির আগে চীনের কুয়াংচৌ শহরের একটি মাধ্যমিক স্কুলে পিতামাতাদের মিটিং আয়োজিত হয়। তাতে ছাত্রছাত্রীদের গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে কয়েকটি কাজ নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়, যেমন: বই পড়া, ক্যালিগ্রাফি চর্চা, পাহাড়ে আরোহন, রান্না শেখা, ইত্যাদি। এভাবে পিতামাতাদের কাছে ছুটির ধারণা পরিবর্তন হয়েছে।

চীনের বিভিন্ন প্রদেশ ও শহর ঘুরে জানা গেছে, এখন আর বাচ্চারা ছুটির দিনে বাসায় বসে হোমওয়ার্ক করে না, বরং বাইরে খেলাধুলা করে ও চারুকলা চর্চা করে।

উহান শহরের মেয়ে মা রুই ইউয়ে সকাল সাড়ে আটটায় মায়ের সাথে প্রশিক্ষণ-মাঠ ত্যাগ করে। তাঁর বয়স মাত্র ৬ বছর। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হবে। তাই আনুষ্ঠানিকভাবে স্কুলে ভর্তির আগে এ গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে সে নৃত্য, ব্যাডমিন্টন, ‘ওয়েছি’সহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। এ সম্পর্কে তার মা বলেন, “এমন প্রশিক্ষণ ক্লাস তার শখের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া হয়েছে। আশা করি, বড় হওয়ার পর তাঁর নিজের শখগুলো অপরিবর্তিত থাকবে।”

উহান শহরের শিশু গ্রন্থাগারে মাধ্যমিক স্কুলের প্রথম শ্রেণীর শিক্ষার্থী লিউ ফেং ক্য ক্যালিগ্রাফি চর্চা করে। তার টেবিলে কয়েকটি বিদেশি লেখকের সুবিখ্যাত উপন্যাসও রয়েছে। এ গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে ভালো করে চীনা অক্ষর লেখা এবং শ্রেষ্ঠ উপন্যাস পড়ার পরিকল্পনা করেছে মেয়ে লিউ।

জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে বিভিন্ন প্রদেশের গ্রীষ্মকালীন ছুটি শুরু হয় এবং সেপ্টেম্বরের শুরু পর্যন্ত ছুটি চলতে থাকবে। এই দেড় মাসে অনেক কিছুই করা সম্ভব। চীনের লিয়াওনিং প্রদেশের ছাওইয়াং শহরের লুংছেং এলাকার ছাংচিয়াংলু প্রাথমিক স্কুলে গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে বাচ্চাদের দেখাশোনার বিশেষ ক্লাস চালু হয়েছে। এভাবে যাদের বাবা-মা অফিস করেন এবং পরিবারে বাচ্চাদের দেখাশোনার লোক নেই, এমন বাচ্চাদের স্কুলে বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়। বাচ্চারা স্কুলে বিভিন্ন নান্দনিক ক্লাসে অংশ নেয়। স্কুলের প্রেসিডেন্ট ফাং চেন বলেন, স্কুলের এ বিশেষ ক্লাসে রোলার স্কেটিং, মাশাল আর্ট, নৃত্যসহ ১০টিরও বিষয় শেখানো হয়। এ ক্লাস চালু হওয়ায় পিতামাতার উদ্বেগ ও চাপ কমেছে। বাচ্চারাও তাদের গরমের ছুটি কাটানোর সুন্দর সুযোগ পেয়েছে।

জানা গেছে, ভালভাবে গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটানোর জন্য বিভিন্ন প্রদেশের শিক্ষা বিভাগও সুবিধাজনক নীতি চালু করেছে এবং বাচ্চাদের সুখী ও নিরাপদ ছুটি নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে।

লিয়াওনিং প্রদেশের ছাওইয়াং শহরের কিশোর-কিশোরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালক কাও আই সিয়া বলেন, ‘দ্বৈত হ্রাস নীতি’ চালুর পর বাচ্চাদের জন্য গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে বিশেষ প্রশিক্ষণ ক্লাস চালু হয়েছে। চীনা মাটি, দুধ চা তৈরি, বেকিং, বাড়িঘর পরিষ্কার ও স্টোরেজসহ ২০টিরও বিষয়ে বাচ্চারা প্রশিক্ষণ নিতে পারে।

সুন্দর ও মজাদার ছুটি কাটানো সম্পর্কে বেইজিং নর্মল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিয়ান জি লিয়াং বলেন, গ্রীষ্মকালীন ছুটির শুরুতে বাবা-মার উচিত বাচ্চার সাথে পরামর্শ করা। ছুটিতে তাদের জন্য পড়াশোনা ও খেলাধুলার পরিকল্পনা একসাথে তৈরি করে ভালো। এভাবে বাচ্চারা ছুটির সময়ে আত্মনিয়ন্ত্রণের শিক্ষা পেতে পারে। পরিকল্পনামাফিক কাজ করার অভ্যাস তাদের মধ্যে গড়ে উঠতে পারে, যা জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ছুটির মধ্যেও সময়মতো ঘুম থেকে ওঠা, খাবার খাওয়া ও শরীরচর্চার অভ্যাস অতি গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চাদের ছুটি যেন সুশৃঙ্খল ও কার্যকর হয়, তা নিশ্চিত করা জরুরি। ছুটিতে খেলাধুলা, বই পড়া ও হোমওয়ার্ক করার জন্য আলাদা সময় থাকা উচিত।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn