বাংলা

চীনা কিশোর-কিশোরীদের ফুটবলের প্রতি আগ্রহ তৈরিতে সামাজিক উদ্যোগ

CMGPublished: 2022-08-01 11:30:15
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

২০১৪ সালের শেষ নাগাদ বেইজিংয়ে ‘আইথিক্য’ নামের একটি ফুটবল ইউথ ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। এর কয়েক মাস পর চীনে ফুটবল খেলার উন্নয়নে সংস্কার প্রস্তাব গৃহীত হয়। টানা কয়েক বছরের উন্নয়ন-কার্যক্রমের ফলে বেইজিংয়ে ক্লাবের ৩০টিরও বেশি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এখানে প্রশিক্ষিত কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা ৭০০০ ছাড়িয়েছে। আর ক্লাবের কোচের সংখ্যাও ৩০০ শতাধিক।

আইথিক্যের প্রতিষ্ঠাতা লি চাও এ ক্লাব গঠন করার গল্প স্মরণ করে বলেন, গত শতাব্দীর ৮০-র দশকে তিনি বেইজিংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তখন বেইজিংয়ে পেশাদার ফুটবল দল মাত্র গঠিত হয়েছে। ছোটবেলায় বেইজিং কুওআন নামের ফুটবল দল লি চাওয়ের জন্য বেশ আগ্রহের ব্যাপার ছিল। তিনিও ফুটবল খেলতে শেখেন, পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে অবসর হওয়ার পর কোচ হিসেবে বাচ্চাদের জন্য প্রশিক্ষণ ক্লাস শুরু করেন। তখন বার্ষিক খরচ ৪০০ ইউয়ানের মতো ছিল। তবে ধীরে ধীরে ফুটবল প্রশিক্ষণ ক্লাসে অংশগ্রহণের জন্য ব্যয় বাড়তে থাকে। প্রতি সেমিস্টার ৩০০০ থেকে ৪০০০ ইউয়ানের মতো এখন। তখন এ টাকা অনেক পরিবারের জন্য অনেক বেশি ছিল। তিনি একসময় বেইজিংয়ের একটি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং লেখাপড়ার সাথে সাথে ফুটবল খেলা চলতে থাকে।

উচ্চবিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে চীনের জাতীয় যুব ফুটবল দলের খেলোয়াড়দের বাছাই পরীক্ষায় অংশ নেন লি চাও। তবে শেষ পর্যন্ত ২০ জনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে ব্যর্থ হন। তখন তিনি খেয়াল করেন যে, পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে কাজ করা সহজ নয়; পেশাদার প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়াও কঠিন ব্যাপার। পরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সিদ্ধান্ত নেন এবং খেলোয়াড়-শিক্ষার্থী হিসেবে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। স্নাতক হওয়ার পর বেইজিংয়ের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন লি।

২০১৩ সালে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করেন তিনি। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে অনেকে নিজ নিজ কোম্পানি চালু করে। তখন তাঁর বাচ্চাও জন্মগ্রহণ করেছে। সেই সময় তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, বাচ্চাদের ফুটবল খেলা শেখাবেন; ফুটবলের প্রতি তাঁর আগ্রহ তিনি বাচ্চাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেবেন।

এ সম্পর্কে লি বলেন, “আমি ফুটবল সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। ফুটবল খেলা কেবল শারীরিক দক্ষতা বাড়ায় না, বরং মানসিক স্বাস্থ্যও উন্নত করে।” নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও চাকরি নেওয়ার পর তিনি সমবয়সীদের তুলনায় দ্রুত প্রশাসনিক কাজ সারতে পারতেন। সেটি ফুটবল খেলার কারণে হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি মনে করেন, শিক্ষাগ্রহণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ‘আইথিক্য’ কোম্পানির মূল কাজ প্রশিক্ষণ দেওয়া। এখানে কোচদেরকে শিক্ষকদের মতো কাজ করতে হয়।

বন্ধুদের সাথে এ ফুটবল প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গঠনের পর টানা ৩ বছর ধরে লি চাও নিজের চাকরিও করে যান। তবে ২০১৮ সালে ‘আইথিক্য’ ক্লাবের শাখা ক্যাম্পাসের সংখ্যা ১০টিরও বেশি হয় এবং নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ৫০০ জন ছাড়িয়ে যায়। তখন তিনি কোম্পানির ব্যবস্থাপনার কাজে অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাকে তখন বাধ্য হয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছেড়ে দিতে হয়।

যখন ‘চীনের ফুটবল উন্নয়ন সংস্কার পরিকল্পনা’ চালু হয়, তখন তিনি ও তাঁর অংশীদাররা নিশ্চিতভাবে জানতেন না যে, চীনের ফুটবল ক্যাম্পাসে নাকি সামাজিক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে ভালো হবে? তাই দ্বৈত পদ্ধতিতে কাজ করতে থাকেন। তারা ২০টিরও বেশি মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক চালু করেন। বিভিন্ন স্কুলের খেলার মাঠে ফুটবল প্রশিক্ষণ সেবা দেওয়া শুরু করেন। তখন সংশ্লিষ্ট স্কুলগুলো থেকে অর্জিত আয় ‘আইথিক্য’ ক্লাবের মোট আয়ের অর্ধেকে দাঁড়ায়। ২০১৮ সালের পর পেশাদার ফুটবল প্রশিক্ষণ থেকে তাদের আয় আরও বাড়ে।

গত কয়েক বছরে বিভিন্ন স্কুলের ফুটবল খেলার জন্য পুঁজি বিনিয়োগ স্পষ্টভাবে হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে তাঁর কোম্পানির সাথে সহযোগিতা করা স্কুলের সংখ্যা ২০১৮ সালের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। তবে মোট আয় প্রায় সমান। কারণ, প্রত্যেক স্কুলে প্রশিক্ষণের জন্য দেওয়া অর্থ অনেক কমে গেছে।

যদিও বেশি আয় হয়নি, তবে স্কুলে ফুটবল খেলা প্রশিক্ষণের সুউজ্জ্বল ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী লি। বিশেষ করে ‘দ্বৈত হ্রাস নীতি’ চালু করার পর স্কুলের ক্লাস শেষ হলেও বাচ্চাদের কোনো কাজ থাকে না। এ সময় তাদের দেখাশোনা ও প্রশিক্ষণ ক্লাসের চাহিদা কম নয়। চীনের ছেংতু, কুইচৌ এবং ফুচিয়ানসহ বিভিন্ন প্রদেশ ও শহরে পিতামাতাদের খরচে সংশ্লিষ্ট সেবা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে সংশ্লিষ্ট খরচ বেশি। তাই স্কুলে ফুটবল খেলার প্রশিক্ষণের ভবিষ্যত উজ্জ্বল বলেই তিনি মনে করেন।

যুব-ফুটবল উন্নয়নে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও ইভেন্ট অতি গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্কে লি চাও মনে করেন, কিশোর-কিশোরীদের ফুটবল খেলায় কাঠামোগত উন্নয়নের ভারসাম্যহীনতা প্রতিফলিত হয়। তাই ক্রীড়া ও শিক্ষা বিভাগের মধ্যে বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজনে সমন্বয়ের ব্যাপার অনেক জরুরি।

লি’র পর্যবেক্ষণে বেইজিংয়ে কিশোরদের ফুটবল খেলার ইভেন্ট কম নয়। এখানে বিভিন্ন ক্লাস, আবাসিক এলাকা বা শহর পর্যায়ের ইভেন্ট দেখা যায়। ‘আইথিক্য’ ক্লাবের কিছু দক্ষ খেলোয়াড় প্রতিবছর ৭০টির বেশি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে থাকে। এটা তাদের শরীরের জন্য বড় চাপ। কেউ কেউ মাত্র ১১ বছর বয়সের। তাদের কেউ কেউ হাঁটুতে আঘাতও পেয়েছে। অন্যদিকে, বেইজিংয়ের অনেক কিশোর-প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা নকআউট ধরনের। প্রায় অর্ধেক বাচ্চার কেবল দুই-তিন প্রতিযোগিতা অংশ নেওয়ার পর আর সুযোগ পায় না। তাই যাদের খেলার মান একটু দুর্বল বা মাঝারি মানেন, তাদের প্রতিযোগিতামূলক অংশগ্রহণের সুযোগও তুলনামূলকভাবে কম।

আসলে লি’র দৃষ্টিতে নিয়মিত ও লীগ ফরম্যাটের খেলা কিশোর খেলোয়াড়দের জন্য আরো ভালো। এভাবে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তাদের সমস্যা খুঁজে বের করা যায় এবং নতুন প্রশিক্ষণ কোর্সে সংশ্লিষ্ট সমস্যা সমাধান করা যায়। তবে কম সময়ের মধ্যে বহু প্রতিযোগিতা সমন্বয়ের সংকট সৃষ্টি করে।

‘আইথিক্য’ বিভিন্ন ক্লাবের মধ্যে নিয়মিত লীগ ফরম্যাটের খেলা আয়োজন করে থাকে। প্রতি সপ্তাহের শনিবার ও রোববার রাতে হাজার বাচ্চা এ খেলায় অংশ নিতে পারে। সবাই সমান খরচ দিয়ে সমান খেলার সুযোগ পায়।

লি চাও মনে করেন, ফুটবল ক্রীড়া ও প্রশিক্ষণের সংমিশ্রণে আরো বেশি ভালো হতে পারে। বেইজিং শহর পর্যায়ের শিক্ষা বিভাগ ও ফুটবল পরিষদের বিভিন্ন খেলার সময় ভালো করে ভাগ করা হয়। তবে বিভিন্ন আঞ্চলিক পর্যায়ের খেলা এবং ফুটবল পরিষদের খেলার সময় অনেক সময় একই হয়। এ সমস্যার এড়াতে বিভিন্ন পক্ষের যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন।

চীনের প্রথম কিশোর ফুটবল লীগ প্রতিযোগিতা

গত ১০শে জুলাই চীনের চেচিয়াং প্রদেশের হাংচৌ শহরে চীনের প্রথম কিশোর ফুটবল লীগ প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়। এবারের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। প্রতিযোগিতার মানও উঁচু। সমাজের ওপর এর ব্যাপক প্রভাবও দেখা গেছে। এ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চীনের কিশোর ফুটবল লীগ প্রতিযোগিতা চীনা বাচ্চাদের ফুটবল খেলার উন্নয়নে ইতিবাচক ভুমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়।

এ সম্পর্কে চীনের কিশোর ফুটবল লীগ কার্যালয়ের নির্বাহী উপপরিচালক, চীনের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান কাও হং পো বলেন, চীনের কিশোর ফুটবল লীগ প্রতিযোগিতার পরিকল্পনা জুন মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়। এতে সামাজিক সাড়া ব্যাপক ছিল। চীনের ৪৫টি এলাকার প্রতিযোগিতায় আয়োজন কাজ সুশৃঙ্খলভাবে চলেছে।

এ বছরের প্রতিযোগিতা প্রাথমিক স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সবক্ষেত্রের কিশোর-কিশোরীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১৩শে জুলাই বিভিন্ন প্রতিযোগিতা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় এবং অগাস্ট মাসের শেষ দিকে ও সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে প্রথম পর্যায়ের ইভেন্ট হবে।

চীনের কিশোর ফুটবল লীগ কার্যালয়ের উপপরিচালক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ক্রীড়া ও শিল্প বিভাগের প্রধান ওয়াং তেং ফেং বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিভিন্ন স্কুলের ফুটবল দল এবং চীনা কিশোরদের ফুটবল লীগ প্রতিযোগিতার আয়োজনে চেষ্টা করছে। এভাবে স্কুলের খেলোয়াড় দল আরো ব্যাপকভাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে।

চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, রাষ্ট্রীয় ক্রীড়া ব্যুরো এবং ফুটবল আসোসিয়েশনের যৌথ উদ্যোগে ইভেন্ট ডিজাইন ও আয়োজন করার মাধ্যমে আরো বেশি ফুটবল দল স্বাধীনভাবে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে। এটি বেশ ভালো ব্যাপার। এমন ফুটবল লীগ প্রতিযোগিতা এবং স্কুলের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিযোগিতার কার্যকর সংযুক্তিতে চীনের কিশোর-কিশোরী ফুটবল খেলোয়াড়দের মধ্যে সেরাদের বেছে নেওয়ার ব্যবস্থাও ধীরে ধীরে গড়ে উঠবে। এতে অনেক বেশি প্রতিভাবান খেলোয়াড় চিহ্নিত করা সম্ভব হবে।

গুণগত মানের প্রতিযোগিতার অভাব চীনের কিশোর-কিশোরীদের ফুটবল শিল্পের উন্নয়নে বড় বাধা। তাই ফুটবল খেলার মূল ব্যাপার প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতার আয়োজনে চীনা কিশোর-কিশোরীরা আরো ব্যাপকভাবে ফুটবল খেলায় অংশ নিতে পারে, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শরীরচর্চার সাথে সাথে খেলাধুলার আনন্দ উপভোগ করতে পারে, এবং সেরা খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।

চীনের ফুটবল আসোসিয়েশ্যান চীনা কিশোর-কিশোরীদের ফূটবল খেলা প্রতিযোগিতায় যথাযথ সমর্থন দেয়। প্রতিযোগিতার আয়োজনে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। তবে প্রতিযোগিতার সুশৃঙ্খল ও নিরাপদ আয়োজনে চেষ্টা করা করা প্রয়োজন। সেটি চীনের ফুটবল খেলার উন্নয়নে স্থির ভিত্তি স্থাপন করবে।

বিভিন্ন স্কুলে ফুটবল খেলার উত্সাহব্যাঞ্জক ব্যবস্থা নেওয়ার পর আরো বেশি কিশোর-কিশোরী ফুটবল খেলার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। আরো বেশি বাচ্চার অংশগ্রহণে চীনের ফুটবলে পেশাদার খেলোয়াড়ের যোগান বাড়ছে। আসলে কেবল ফুটবল খেলা নয়, অন্যান্য খেলাধুলাও প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই উন্নত হতে পারে। চীনের ক্রীড়া শিল্পের উন্নয়ন ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে দেশকে শক্তিশালী করা কেন্দ্রীয় সরকারের লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রশিক্ষণের ও প্রতিযোগিতার বিকল্প নেই।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn