বাংলা

নান্দনিক শিক্ষার ওপর আরও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে চীন

CMGPublished: 2022-07-25 09:41:16
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনে উচ্চশিক্ষা খাতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতের মৌলিক শিক্ষা আর বাধ্যতামূলক শিক্ষার ওপর অনেক গুরুত্ব দেয় বিভিন্ন পর্যায়ের সরকার। শুধু কেবল সাধারণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষা নয়, বরং নান্দনিক শিক্ষা খাতেও ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে আজকের চীন। আজকের অনুষ্ঠানে চীনের নান্দনিক শিক্ষার উন্নয়ন সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরবো।

নান্দনিক শিক্ষা আসলে নান্দনিক ক্ষমতা চর্চার মাধ্যমে মানুষের সৌন্দর্য অনুভব, বোঝা, ও এ ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা দেখানোর উপায়। সংকীর্ণ অর্থে বললে, নান্দনিক শিক্ষা শিল্পকলার সাথে জড়িত। আবার বিস্তৃত দৃষ্টিকোণ থেকে লেখলে নান্দনিক শিক্ষা জীবনের সবক্ষেত্রের সঙ্গে জড়িত।

পাশ্চাত্য দেশগুলোর নান্দনিক শিক্ষার ধারণা অষ্টাদশ শতাব্দীর পঞ্চম দশকে গড়ে ওঠে। তবে, প্রাচীনকালের নান্দনিক শিক্ষার চেতনার কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। যেমন, সিচৌ আমলে তথা খৃষ্ঠপূর্ব ১০৪৬ থেকে ৭৭১ সালের মধ্যে, নৈতিকতার শৃঙ্খলা, কবিতা, গান ও নৃত্যসহ বিভিন্ন নান্দনিক শিক্ষার প্রচলন ছিল। ছুনছিউ আমলের শেষ দিকে, চীনের আধ্যাত্বিক গুরু কনফুসিয়াস শিক্ষাকে রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে আলাদা করেছিলেন। তখন থেকে শিষ্টাচার, সংগীত, শাস্ত্র, গণিতসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলাদাভাবে শেখানোর ধারার প্রচলন ঘটে। এর মানে প্রাচীনকাল থেকেই চীনা সমাজে নান্দনিক শিক্ষার আলাদা অস্তিত্ব ছিল।

আধুনিক চীনে তথা ১৯০০ সালের পর পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট, চীনের সুবিখ্যাত শিক্ষাবিদ ছাই ইউয়ান পেই, ‘শিক্ষা অভিধান’-এ নান্দনিক শিক্ষাকে সংজ্ঞায়িত করেন। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, যারা নান্দনিক শিক্ষা দেবেন, তাদের উচিত শিক্ষার্থীদের শিল্পকর্মের প্রতি আবেগ ও আগ্রহ বাড়ানোর চেষ্টা করা। আসলে, সাধারণ পড়াশোনার সাথে নান্দনিক শিক্ষার মূল অর্থে কোনো পার্থক্য নেই। দুটোই শিক্ষা। তবে, নান্দনিক শিক্ষায় জীবনের সৌন্দর্য উপলব্ধির ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।

ঐতিহ্যিক সীমাবদ্ধতার কারণে, প্রাচীনকালে নান্দনিক শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষার মধ্যে পার্থক্য করা মুশকিল ছিল। তবে শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের সাথে সাথে এমন সীমাবদ্ধতা এখন আর নাই বললেই চলে। বর্তমানে সবার একটি স্পষ্ট ধারণা হয়ে গেছে যে, নান্দনিক শিক্ষা কেবল নৈতিকতার চর্চা নয়, বরং এ শিক্ষা ব্যক্তির বৌদ্ধিক, শারীরিক, ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়; মানুষদের কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতা বাড়াতে ভুমিকা রাখে। তা ছাড়া, যদি নান্দনিক শিক্ষাকে স্রেফ নৈতিকতার একটি অংশ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, তবে তা ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তাভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। আসলে, নান্দনিক শিক্ষাকে উপলব্ধিমূলক জ্ঞান বলা যায়। চীনের বিভিন্ন পর্যায়ের স্কুলে নান্দনিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা, বৌদ্ধিক ক্ষমতা, ক্রীড়া ক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়ানো। এতে শিক্ষার্থীরা জীবনের প্রতি, জীবনের দায়িত্ব পালনের প্রতি অধিক আগ্রহী হয়ে ওঠে।

১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে চীনা শিক্ষাবিদ ছাই ইউয়ান পেই তাঁর এক লেখায় লিখেছেন, বিশুদ্ধ নান্দনিক শিক্ষা মানুষের অনুভূতি উন্নত করতে পারে, তাদের মধ্যে পবিত্র ও বিশুদ্ধ অভ্যাস তৈরি করতে পারে, এবং স্বার্থপর চিন্তাভাবনাকে নির্মূল করতে পারে।

নান্দনিক শিক্ষা গ্রহণের পর চীনা শিক্ষার্থীদের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। যেমন, তারা সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ, কল্পনা ও সৃজনশীলতার চর্চা করতে পারে, তাদের জীবন আগের তুলনায় আরও মজার হয়, তাদের লেখাপড়ার কার্যকারিতাও বাড়ে। নান্দনিক শিক্ষা বুদ্ধি বাড়ায়, শিক্ষার্থীরা আরও গভীরভাবে বিশ্বকে বুঝতে পারে।

বর্তমানে চীনের মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলে সাহিত্য, সংগীত, চারুকলা, নাটক, চলচ্চিত্র ও নৃত্যসহ বিভিন্ন মেজর আছে। বিভিন্ন নান্দনিক ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও প্রাধান্য উন্নত করা সম্ভব। শিক্ষার্থীদের মেধা ও উপযোগী শৈল্পিক বিশেষত্ব খুঁজে পাওয়াও এতে সম্ভব।

সম্প্রতি চীনের ফুচিয়ান প্রদেশের রাজধানী ফুচৌ শহরের কুলৌ প্রাথমিক স্কুলে একটি বিশেষ সেমিনার আয়োজিত হয়। সেখানে স্থানীয় নান্দনিক শিক্ষার ফলাফল ও প্রভাব নিয়ে আলোচনা হয়। শিক্ষকরা প্রাথমিক স্কুলের নান্দনিক ক্লাসের পরিবর্তন ও সংস্কারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তারা বলেন, যৌথভাবে নৈতিকতাসহ নান্দনিক শিক্ষার মান উন্নত করতে হবে।

এ সম্পর্কে ফুচিয়ান প্রদেশের শিক্ষা বিভাগের পর্যবেক্ষক লি স্যুন বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন পরিকল্পনা অনুসারে, বিভিন্ন স্কুলের নান্দনিক শিক্ষার বহুমুখী ও সমৃদ্ধ উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাই নান্দনিক শিক্ষা কেবল কাগজে সুন্দর ছবি আঁকা বা সংগীতের সূর বাজানো নয়, বরং প্রত্যেকের হৃদয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়া এর মূল লক্ষ্য। কেবল শহরাঞ্চলের শিক্ষকরা বাচ্চাদের নান্দনিক শিক্ষা দেবেন, তা নয়, বরং গ্রামাঞ্চলের বাচ্চাদের জন্যও সমান নান্দনিক শিক্ষার সুযোগ থাকা প্রয়োজন।

পাহাড়াঞ্চলের পুরনো বাড়িঘর মেরামতকারী শিল্পীর গল্প

৬০ বছর বয়সের সিনিয়র চারু ও কারুশিল্পী ইয়ো শৌ ই টানা ৮ মাস ধরে চীনের কুইচৌ প্রদেশের পাহাড়াঞ্চলে পুরনো বাড়িঘর মেরামত করে আসছেন এবং গ্রামাঞ্চলের পুনরুজ্জীবনে নিজের অবদান রাখছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “গ্রামাঞ্চলের মেরামত ও নির্মাণকাজে গ্রামবাসীদের যুক্ত করা প্রয়োজন। কেবল গ্রামবাসীদের সাথে সুপরিচিত হওয়ার মাধ্যমে পুরনো বাড়িঘর মেরামত ও ডিজাইনের কাজ সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করা যায়।” ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে কুইচৌ প্রদেশের মিয়াও ও তুং জাতিঅধ্যুষিত এলাকার রংচিয়াং জেলার আমন্ত্রণে তিনি উত্তরপূর্ব চীনের চিলিন প্রদেশ থেকে রংচিয়াং জেলার লেসিয়াং গ্রামে পৌঁছান এবং গ্রামটিকে একটি স্থানীয় বৈশিষ্ট্যময় গ্রামে পরিণত করার চেষ্টা শুরু করেন।

তাঁর প্রধান কাজ ছিল লেসিয়ান গ্রামের দশটিরও বেশি পুরনো বাড়িঘর নতুন করে ডিজাইন করে পর্যটকদের জন্য হোটেল হিসেবে গড়ে তোলা। এ সম্পর্কে কারুশিল্পী ইয়ো বলেন, পুরনো বাড়িঘরের মেরামত ও নির্মাণকাজের ব্যবসার চাহিদা বিবেচনা করা প্রয়োজন। স্থানীয় সংস্কৃতি ও রীতিনীতি বিবেচনায় রেখে ও পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে, এ কাজ আঞ্জাম দিতে হবে।

প্রাচীনকাল থেকে লেসিয়াং গ্রাম তুং জাতিঅধ্যুষিত এলাকা। এখানে গ্রামীণ পরিবারের সংখ্যা ২৭২টি এবং লোকসংখ্যা ১১ হাজারেরও বেশি। স্থানীয় গ্রামবাসীরা পিপা গান গাওয়া, বাদ্যযন্ত্র বাজানো, এবং মাছ ধরাসহ বিভিন্ন রীতিনীতি অনুসরণ করে থাকে। প্রাচীনকাল থেকে এখানে গম প্রক্রিয়াকরণ, তৌফু তৈরি, কাপড়চোপড় বানানোসহ বিভিন্ন পেশার সঙ্গে জড়িত গ্রামবাসীরা। তাই স্থানীয় রীতিনীতি ও গ্রামীণ জীবনযাপনের পদ্ধতি বিবেচনা করে, পুরনো বাড়িঘরগুলো রূপান্তর করেছেন জনাব ইয়ো।

তা ছাড়া, শহরবাসীদের চাহিদা বিবেচনা করে গ্রামের বাড়িঘরের প্রাঙ্গণে দোলনা, পাব, ও খাবার বিতরণ ক্যাবিনেট স্থাপন করা হয়েছে। এমন ডিজাইনে পুরনো বাড়িঘরের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য বজায় রাখা হয়েছে। সাথে সাথে আধুনিক জীবনযাপন ও বিনোদনের চাহিদাও পূরণ করা হয়েছে।

৪৬ বছর বয়সের গ্রামবাসী উ সুং মিং গত ২০ বছর ধরে কাঠমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করে আসছেন। প্রথমে পুরনো বাড়িঘরের মেরামত ও ডিজাইনের কাজ করতেন তিনি। এখন তিনি কারুশিল্পী ইয়ো’র সহকারী হিসেবে কাজ করেন। তাঁর অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমরা হস্তকর্মশিল্পের কর্মী হিসেবে কেবল একটি নিয়ম অনুসরণ করে থাকি। আর সেটি হলো: প্রবীণ কর্মীরা যেভাবে আমাদের শিখিয়ে দেন, হুবহু সেভাবে কাজ করা। তাই কাঠ খোদাই হোক বা ডিজাইন হোক—আমরা আমরা সবসময় শিক্ষকের দেখানো পদ্ধতিতে কাজ করি।” তবে, কারুশিল্পী ইয়ো’র সাথে কাজ শুরু করার পর, তিনি গবেষণা ও ডিজাইনের মাধ্যমে পুরনো বাড়িঘরকে নতুন আকৃতি দেওয়ার পদ্ধতি শিখেছেন। এখন তার কাজে অনেক সৃজনশীলতার প্রতিফলন দেখা যায়।

এ সম্পর্কে ইয়ো বলেন, গ্রামের নির্মাণকাজ ও ডিজাইনের জন্য অবশ্যই মনোযোগ দিয়ে স্থানীয় রীতিনীতি জানা প্রয়োজন। এভাবে গ্রামবাসীদের সাথে তাদের সুন্দর গ্রাম নির্মাণ করা সম্ভব। ডিজাইনের কাজ শুরু করার আগে টানা তিন চার মাস ধরে বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপ কাজ করেন তিনি এবং গ্রামবাসীদের সাথে খাবার খান, কথাবার্তা বলেন, গ্রামের ইতিহাস জানার চেষ্টা করেন। এরপর তাঁর ডিজাইন ও মেরামতের পরিকল্পনা গ্রামবাসীদের ব্যাপক স্বীকৃতি পায় এবং পর্যটকরাও নতুন গ্রাম বেশ পছন্দ করেন।

জনাব ইয়ো’র কাজিন ভাই ও বোন রাজধানী কুইইয়াং শহরে বসবাস করেন। যদিও এ গ্রাম থেকে বেশ দূরে না, তবে এ পর্যন্ত তাদের বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি ইয়োর। গ্রামাঞ্চলের পুনরুজ্জীবন কাজ তাঁর ব্যক্তিগত কাজের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ কাজেই তিনি অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকেন।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn