বাংলা

চীনা শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা ‘কাওখাও’

CMGPublished: 2022-06-13 15:12:17
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

বন্ধুরা, গত ৭ থেকে ১০ জুন পর্যন্ত সারা চীনের উচ্চবিদ্যালয় পর্যায়ের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীরা তাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা ‘কাওখাও’-এ অংশগ্রহণ করে। কাওখাও চীনা ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ বটে। কারণ ৬ বছর বয়স থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত—টানা ১২ বছর পড়াশোনার ফল এ পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা হয়। এ পরীক্ষার মাধ্যমে ঠিক হয় কোন শিক্ষার্থী কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবে। তাদের ভবিষ্যতের জীবন ও কর্মসংস্থানও অনেকাংশে নির্ভর করে এই পরীক্ষার ফলের ওপর। আজকের আসরে আমরা চীনের কাওখাও সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরবো।

আসলে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদাভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি-পরীক্ষার নিয়ম ছিল। ১৯৫২ সালে প্রথম ‘কাওখাও’ পরীক্ষার সময় প্রতিবছরের ১৫ থেকে ১৭ অগাস্ট পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। তখন পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৫৯ হাজার। তখন একে বলা হতো অভিজাত শ্রেণীর লোকদের পরীক্ষা। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত কাওখাও পরীক্ষা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসে চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদের অনুমোদনে কাওখাও পরীক্ষাব্যবস্থা সংস্কার করা হয়। এর পর থেকে কোটি কোটি চীনা শিক্ষার্থীর ভাগ্য পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে কাওখাও। কাওখাও পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যাও ধীরে ধীরে বেড়েছে এবং ২০২২ সালে এ সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও প্রায় এক কোটি। এক্ষেত্রে দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য সমান সুযোগ রয়েছে।

১৯৫২ সালের কাওখাও পরীক্ষা ১৫ থেকে ১৭ অগাস্ট পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হতো। সেই সময় প্রতি পরীক্ষার সময় ১০০ মিনিট ছিল। চীনা ভাষা, গণিত, রসায়ন, ইতিহাস ও ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, ইংরেজি বা রুশ ভাষাসহ কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হতো। প্রতি শিক্ষার্থীকে ৮টি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হতো। চীনের কাওখাও পরীক্ষাব্যবস্থা জাতীয় শিক্ষামানের উন্নতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও ন্যায্যতা সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক ভুমিকা পালন করেছে।

২০২২ সালের কাওখাও পরীক্ষার সঙ্গে অন্যান্য বছরের পরীক্ষার কিছু পার্থক্য রয়েছে। রাজধানী বেইজিংয়ের অবস্থা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে বেইজিংয়ের কয়েকটি এলাকা এখনও লকডাউন আছে। তবে সেখানে অবস্থানরত ছাত্রছাত্রীদের সময়মতো কাওখাও পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য বিভিন্ন সুবিধাজনক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যারা নিয়ন্ত্রণ এলাকা বা লকডাউন এলাকায় আছে, তাদের জন্য বিশেষ গাড়ি পাঠানো হয়; গাড়ির মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরীক্ষাকক্ষে তারা পৌঁছাতে সক্ষম হয়। কেউ কেউ একাই একটি ক্লাসরুমে পরীক্ষায় অংশ নেয় এবং পরীক্ষাশেষে বিশেষ গাড়িতে নিজের বাসায় ফিরে আসে।

এমন বিশেষ চাহিদা মেটাতে বেইজিংয়ের কিছু কিছু হোটেল বা হোস্টেল অস্থায়ী পরীক্ষাকক্ষে পরিণত হয়। পরীক্ষা চলাকালে খাওয়া-থাকা, যাতায়াত ও পরীক্ষাগ্রহণসহ বিভিন্ন সেবা দেওয়া হয়। বেইজিংয়ের ছাওইয়াং এলাকায় কয়েকটি লকডাউন আবাসিক কমিউনিটি রয়েছে। তাই এখানকার ছাত্রছাত্রীদের হোটেলে থাকতে হয়। হোটেলকে দুটি এলাকায় ভাগ করা হয়। একটি শিক্ষার্থীদের খাওয়া-থাকার চাহিদা মেটাতে পারে এবং আরেকটি এলাকায় কাওখাও পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। এভাবে তাদের পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে চলা নিশ্চিত করা হয়। এ সম্পর্কে বেইজিং ছাওইয়াং এলাকার রিথান মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক ছিন লিয়ান চি বলেন, পরীক্ষা চলাকালে পরিদর্শক শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শরীরের তাপমাত্রা মাপেন এবং বিভিন্ন চেকআপের কাজ করেন। তারপর পরীক্ষাকক্ষে তারা ঢুকতে পারে। হোটেলে শিক্ষার্থীদের জন্য সুপরিচিত স্কুলের পরিবেশ গড়ে তুলতে স্কুলের টেবিল ও চেয়ার হোটেলে হস্তান্তর করা হয়।

বেইজিং ফেংথাই এলাকার একজন পরিদর্শক-শিক্ষক বলেন, প্রতিটি পরীক্ষাকক্ষে সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষক সরঞ্জাম স্থাপন করা হয় এবং প্রতিটি পরীক্ষাকক্ষে দুজন পরিদর্শকশিক্ষক রয়েছেন। হোটেলের রুম বেশ বড় নয়। তাই শিক্ষার্থীদের আরও মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করার জন্য পরিদর্শকশিক্ষক শিক্ষার্থীদের সাথে দূরত্ব ২ মিটার বজায় রাখতে হয়। পরীক্ষা শেষে পরীক্ষাপত্র ও টেবিল চেয়ার জীবাণুমুক্ত করা হয় এবং পরীক্ষাপত্র খামের মধ্যে সীল করা হয়।

ছাওইয়াং এলাকার একটি হোটেলের মিটিং রুমকে ৩০ জন শিক্ষার্থীর জন্য বিশেষ পরীক্ষাকক্ষে রূপান্তর করা হয়। তাদের স্কুল থেকে টেবিল, চেয়ার ও কালো বোর্ডও হোটেলে নিয়ে আসা হয়। পরীক্ষাকক্ষের পর্যাপ্ত আলো নিশ্চিত করতে প্রতিটি টেবিলের পাশে বাতিও স্থাপন করা হয়। তা ছাড়া, হোটেলের প্রতিটি রুমে টুসব্রাস ও তোয়ালেসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য রাখা হয়। সকল শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে পরীক্ষার আগে ১৪ দিন স্বাস্থ্য পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। পরীক্ষা চলাকালেও প্রত্যেককে মাস্ক পরতে হয়েছে।

চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর কাওখাও পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৯ লাখ ৩০ হাজারের বেশি, যা গত বছরের তুলনায় ১১ লাখ ৫০ হাজার বেশি। গোটা চীনে কাওখাও পরীক্ষাকক্ষের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৩০ হাজারটি, পরিদর্শক-শিক্ষকের সংখ্যা ছিল ১০ লাখ ২০ হাজার জনেরও বেশি।

বিভিন্ন প্রদেশে পরীক্ষার সময় ছিল ৭ই জুন থেকে ১০ই জুনের মধ্যে। তবে শাংহাই মহানগর কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে কাওখাও পরীক্ষার সময় এক মাস পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং উচ্চবিদ্যালয়ের স্নাতক পরীক্ষার সময় ১৮ থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আসলে, যদিও চীনের বিভিন্ন প্রদেশের কাওখাও পরীক্ষার সময় প্রায় একই, তবে পরীক্ষাপত্র পুরোপুরি আলাদা। যেমন বেইজিং, শাংহাই, কুয়াংতুং আর হুপেইয়ের বিভিন্ন এলাকার পরীক্ষাপত্রের বিষয় ভিন্ন। গণিত, চীনা ভাষা, ইংরেজি ইত্যাদি বিষয় এক হলেও পরীক্ষাপত্র ভিন্ন। চীনের হুপেই এবং শানতুংসহ কয়েকটি প্রদেশের ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা অন্যান্য প্রদেশের চেয়ে বেশি। তাই এমন স্থানের পরীক্ষাপত্র বেইজিং এবং শাংহাইয়ের চেয়ে আরো কঠিন হয়। ছাত্রছাত্রীদের ভর্তির সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে একটু কম। তাই আমাদের সময় আমরা কাওখাও পরীক্ষার আগে শানতুং ও হুপেইয়ের অতীতকালের বহু পরীক্ষাপত্র সমাধান করেছি। তখন খেয়াল করেছি যে, একই ইউনিটের বেইজিংয়ের পরীক্ষাপত্রের অধিকাংশ প্রশ্নের জবাব দিতে পারি, তবে হুপেই আর শানতুং প্রদেশের পরীক্ষাপত্রের অনেক বিষয় সঠিক উত্তর দিতে পারি না। তাই বলা যায়, অতীতকালে কাওখাও পরীক্ষার প্রতিযোগিতা অনেক কঠিন ছিল আর ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হারও বর্তমানের চেয়ে অনেক কম ছিল।

পরীক্ষা শেষ করার পর বিভিন্ন প্রদেশের শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষাপত্রের বিচার কাজ শুরু করেন। বিভিন্ন প্রদেশের বিজ্ঞপ্তি অনুসারে জুন মাসের শেষ সপ্তাহে পরীক্ষার ফাইনাল ফলাফল প্রকাশিত হবে। ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের পরীক্ষার ফলাফল জেনে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে পারবে। বেইজিংয়ের ছাত্রছাত্রীরা ২৭ই জুন থেকে পয়লা জুলাই পর্যন্ত নিজেদের উচ্চবিদ্যালয়ের মাধ্যমে সবচেয়ে প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের তালিকা জমা দিতে পারবে।

পরীক্ষার স্কোর্স অতি গুরুত্বপূর্ণ, তবে নিজের ভবিষ্যতের কর্মসংস্থানের জন্য একটি উপযোগী মেজর বা বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নেওয়ার আরো বেশি বুদ্ধিমানের পরিচয়। তাই ছাত্রছাত্রীদের উচিত নিজের সবচেয়ে প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের তালিকা করার আগে সতর্ক থাকা। ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১০টি কলেজের নাম বেছে নেওয়া যায়। যদি আবেদনকারী তালিকায় স্থান পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপত্র পায়, তাহলে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার সুযোগ আর থাকবে না। তাই ওই বিশ্ববিদ্যালয় না গেলে পুনরায় নতুন বছরের কাওখাও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। সেটি দুঃখজনক ব্যাপার, এমন সিদ্ধান্ত এড়ানো উচিত।

আসলে কাওখাও পরীক্ষা চালুর আগে উচ্চবিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারে ছাত্রছাত্রীদের প্রতিদিনের কাজ ছিল বিভিন্ন মেজরের ভিন্ন প্রদেশের পরীক্ষাপত্র সমাধান করা। বিভিন্ন পরীক্ষাপত্র থেকে ভুল উত্তর সংশোধন করে কাওখাও পরীক্ষার জন্য যথেষ্ঠ প্রস্তুতি নেওয়াই ছিল তখন বড় কাজ। কাওখাও পরীক্ষা জুন মাসে আয়োজনের আগে মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে দু’বার মক পরীক্ষা চালু হয়। এর মাধ্যমে নিজেদের কাওখাও পরীক্ষার ফাইনালের জন্য প্রস্তুত করে নেওয়া যেতো।

মোদ্দাকথা, কাওখাও চীনা ছাত্রছাত্রীদের জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষা। সেটি তাদের জীবনে তাত্পর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলে। তাই শিক্ষার্থীরা একবার পরীক্ষা পাস করে উপযোগী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য চেষ্টা করে। অভিভাকরাও উপযোগী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেজর বেছে নেওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন নতুন পেশার আবির্ভাব ঘটেছে। অনেক মেজরও নতুন এসেছে। এসব মেজরে পড়াশুনা শেষ করে সহজে চাকরি পাওয়া যায়।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn