বাংলা

‘ক্লিফ গ্রামের’ ব্যাপক পরিবর্তন ও স্থানীয় শিক্ষার উন্নয়ন-China Radio International

criPublished: 2021-01-11 16:31:05
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

বন্ধুরা, চীনের দারিদ্র্যবিমোচন কার্যক্রম ২০২০ সালের শেষ দিকে শেষ হয়েছে। মানে, ২০২০ সাল শেষ হবার আগেই চীন সম্পূর্ণভাবে দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। গত বছর আমাদের অনুষ্ঠানে দারিদ্র্যবিমোচন কার্যক্রমের আওতায় থাকা চরম দরিদ্র এলাকাগুলোর কিছু তথ্য তুলে ধরেছিলাম। এর মধ্যে সিছুয়ান প্রদেশের ‘ক্লিফ গ্রাম’-ও ছিল। দুর্বল অবকাঠামো ও বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে এ গ্রামের বাসিন্দাদের জীবন ছিল কঠিন। তারা পাহাড়ের শৃঙ্গে বসবাস করতেন। বাইরে যেতে হলে তাদেরকে লতা দিয়ে তৈরি বড় সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হতো। আজকের অনুষ্ঠানে এ ‘ক্লিফ গ্রামের’ ব্যাপক পরিবর্তন ও স্থানীয় শিক্ষার উন্নয়ন সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরবো।

অতীতে ক্লিফ গ্রামের বাচ্চাদের মধ্যে খুব কমই শিক্ষার আলো পেতো, আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পেতো। কারণ, গ্রামবাসীর কাছে পশপালনের চেয়ে লেখাপড়ার গুরুত্ব কম ছিল। তা ছাড়া, স্কুলে যাওয়ার পথ অনেক জটিল ও বিপজ্জনক ছিল। গ্রামের যেসব বাচ্চা প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সুযোগ পেতো, তাদের বেশিরভাগই আবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারতো না। কিন্তু এখন অবস্থা বদলেছে। গ্রামের পিতামাতারা সবাই এখন বুঝতে পেরেছেন যে, পড়াশোনা হবে দারিদ্র্যবিমোচনের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি।

২০২০ সালের জুন মাসে ক্লিফ গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলোকে নতুন জায়গায়, নতুন বাড়িঘরে স্থানান্তর করা হয়। নতুন জায়গায় নতুন প্রাথমিক স্কুলভবন নির্মিত হয়েছে। স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৫২০ জনেরও বেশি। ক্লিফ গ্রামের বাচ্চারা স্কুলে ভর্তি হতো স্বাভাবিক বয়সের চেয়ে বেশি বয়সে। কারণ, পাহাড় থেকে লতার সিঁড়ি বেয়ে নেমে স্কুলে যাওয়া কম বয়সী বাচ্চাদের জন্য প্রায় অসম্ভব। তাই তারা একটু বেশি বয়সে স্কুলে যাওয়া শুরু করতো। যেমন, বুছিয়ে ১১ বছর বয়স থেকে প্রাথমিক স্কুলে যাওয়া শুরু করে। তখন প্রতি সপ্তাহে একবার সে বাড়ি থেকে স্কুলে যেতো। প্রতিবার বাড়ি থেকে স্কুলে যাওয়ার সময় তার পিতা দড়ি দিয়ে তার কোমর বাঁধতেন, যেন সে লতার সিঁড়ি থেকে নিচে পড়ে না যায়। ছোট বাচ্চা হলেও, তাকে চাল ও আচার বহন করে ৭ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হতো। স্কুলে যাওয়ার পথে তাকে ঠাণ্ডা নদীর পানি ও তুষার অতিক্রম করতে হতো এবং স্কুলে পৌঁছার পর সারাদিন তার পা ঠাণ্ডাই থাকতো। প্রথম দুই বছর স্কুলে তার সহপাঠির সংখ্যা ছিল মাত্র ৭/৮ জন। তবে পঞ্চম শ্রেণীতে সংখ্যা কমে দাঁড়ায় মাত্র ২/৩ জনে। এদের মধ্য থেকে মাধ্যমিক স্কুলে মাত্র সে নিজে একা যেতে পেরেছে।

ক্লিফ গ্রামের ৫০ বছর বয়সী ই জাতির বাসিন্দা মো সে জি কু স্মৃতিচারণ করে বলেন, এ গ্রামের বাচ্চারা অনেক দেরিতে স্কুলে ভর্তি হতো। কারণ, লতার সিঁড়ি শুধু বড়দের জন্য। বাচ্চাদের জন্য এই সিঁড়ি নয়। বাচ্চারা স্কুলে যেতে না-পেরে শুধু মাটিতে খেলাধুলা করে সময় কাটাতো। তার ছোটবেলা কেটেছে ক্লিফ গ্রামে। তিনি পাহাড়ের বাইরে যেতে আগ্রহী ছিলেন। তবে, মাধ্যমিক স্কুল থেকে স্নাতক হওয়ার পর পরিবারের দরিদ্রতার কারণে অধিক পড়াশোনা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, অতীতে এ গ্রামের বাচ্চাদের জন্য উচ্চশিক্ষা গ্রহণ অনেক কঠিন ব্যাপার ছিল। ১৯৯৩ সালে তিনি আথুলের গ্রামের অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে দয়িত্ব পালন করতে শুরু করেন। কারণ, বাইরে থেকে আসা শিক্ষকরা কম সময়ের মধ্যেই চলে যেতেন। এ অবস্থায় মাধ্যমিক স্কুল পাস করা মো সে জি কু সবচেয়ে উপযোগী প্রার্থীতে পরিণত হন। পরের ১১ বছর তিনি ক্লিফ গ্রামের বাচ্চাদের চীনা ভাষা ও গণিতসহ বিভিন্ন বিষয়ে পড়িয়েছেন এবং অনেক ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাবঞ্চিত থাকার অভিজ্ঞতার স্বাক্ষী হয়েছেন।

স্কুলে যাওয়ার রাস্তা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর অন্যতম। গ্রাম থেকে সবচেয়ে কাছের মাধ্যমিক স্কুলে যেতে প্রায় ৫০ কিলোমিটার হাঁটতে হতো। গ্রামের ছাত্রছাত্রীরা ভোর ৪টার দিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করতো। রাস্তায় ক্ষুধা লাগলে শুধু ভুট্টা ও আলু খেতো এবং সন্ধ্যা ৬টায় স্কুলে পৌঁছাতে সক্ষম হতো।

শিক্ষক মো সে জি কু’র অভিজ্ঞতা অনুসারে, বিপজ্জনক রাস্তা, দরিদ্র পিতামাতার শিক্ষার প্রতি অনীহা ইত্যাদি কারণে বাচ্চারা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকতো। ক্লিফ গ্রামে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ ছিল না মোটেই।

বু ছিয়ে ছোটবেলাতেই অর্থের মূল্য বুঝতে শেখে। কারণ, তার পরিবারের বার্ষিক আয় ছিল মাত্র ২০০০ ইউয়ান, যা ভুট্টা বিক্রি করে মিলত। আর তার নিজের বার্ষিক পড়াশোনার খরচ ছিল প্রায় ৬০০ ইউয়ান, যা পরিবারের মোট আয়ের তিন ভাগের এক ভাগ। তার পরে আরও তিন জন বোন জন্ম নেয়। তাই পরিবারের আর্থিক বোঝা আরও বাড়ে। তাদের পিতা মো সে উ হার বয়স মাত্র ৪৮ বছর তখন। কিন্তু জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত তাকে বেশি বয়স্ক মনে হতো। ছোটবেলায় তিনি ১৩ বছর পর্যন্ত পাহাড়ের বাইরে যেতে পারেননি। স্কুলে যাওয়ার সুযোগও হয়নি তার। তাই তিনি ম্যান্ডারিন ভাষা পড়তে পারেন না। ২৮ বছর বয়সের সময় তিনি চাকরি নেওয়া জন্য উত্তর চীনের ছাংছুন শহরে যান। তবে ভাষাগত সমস্যার কারণে মাত্র এক মাস পর ক্লিফ গ্রামে ফিরে আসতে বাধ্য হন। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, তাঁর বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখাতে তিনি সম্ভাব্য সবকিছু করবেন।

২০০৮ সালে ক্লিফ গ্রামের বাসিন্দা এ দে লাই ক্য জেলা থেকে একটি টেলিভিশন গ্রামে নিয়ে আসেন। এটি ছিল ক্লিফ গ্রামের প্রথম টেলিভিশন। গ্রামের সব বাসিন্দা তার বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে টেলিভিশন দেখত। বাইরের বিশ্বের দৃশ্য প্রথমবারের মতো তাদের সামনে তুলে ধরে এই টেলিভিশন। এ দে লাই ক্য মাধ্যমিক স্কুলের পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত থেকে অবশেষে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং তারপর নিজের জন্মস্থানে ফিরে আসেন।

ই জাতির লেখক আক্যচিউশে বলেন, দারিদ্র্যতায় অভ্যস্ত হওয়া দুঃখজনক ব্যাপার। ৩৬ বছর আগে ক্লিফ গ্রামের একজন কলেজ পাস করেন। উনি জেলাশহরে বাড়ি করেন। লেখক আক্যচিউশে তার সাথে কথা বলেন। লেখক তাকে বলেন, অতীতে গ্রামের পিতামাতারা বাচ্চাদের পড়াশোনায় মনোযোগ দেননি। তবে, যখন উনি কলেজ পাস করেন ও জেলাশহরে চাকরি পান এবং প্রতিদিন মাংস ও ভাত খাওয়ার সুযোগ পান, তখন স্থানীয় গ্রামবাসীরা শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পারেন।

এ সম্পর্কে স্থানীয় জিরমো উপজেলার সিপিসি’র সম্পাদক আজিআনিউ বলেন, অতীতে লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত বাচ্চাদের স্কুলে ফিরেয়ে নিতে অনেক বোঝাতে হতো। তবে, এখন পরিস্থিতি বদলেছে। এখন প্রতিটি পরিবারের বাচ্চারা পড়াশোনা করে। যেসব বাচ্চা পরীক্ষায় ভালো করে, সেসব বাচ্চার পিতামাতা গ্রামের শ্রেষ্ঠ অতিথি হিসেবে বিভিন্ন দাওয়াতে আমন্ত্রণ পান। এখন গ্রামের বাবামারা বাচ্চাদের পড়াশোনায় অনেক উত্সাহ দেন।

বুছিয়ে’র বাবা মোসেউহা বাচ্চারা শিক্ষিত হয়েছে বলে গর্বিত। যদিও উনি অশিক্ষিত মানুষ, তবে তিনি জানেন তাঁর ছেলে পড়াশোনায় ভালো। ২০১৪ সালে ক্লিফ গ্রামের পবর্তের পাদদেশে লের প্রাথমিক স্কুলঘর নির্মিত হয় এবং ২০১৬ সালে লোহার সিঁড়িও তৈরি করা হয়। ২০২০ সালে ক্লিফ গ্রামের ৮৪টি দরিদ্র পরিবার জেলার নতুন বাড়িঘরে স্থানান্তরিত হয়। এখন চাওচুয়ে জেলায় প্রাথমিক স্কুলে ভর্তির হার ৯৯.৮৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে; মাধ্যমিক স্কুলেও ভর্তির হার ৯৯.৮৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ৩০২২২ জন দরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ছেলে বুছিয়ে তাদের একজন। তার লক্ষ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগ থেকে স্নাতক হওয়া। লক্ষ্য অর্জনের জন্য সে প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৫টায় জেগে ওঠে ও মধ্যরাতে ঘুমায়। সে বলল, ‘শহরের বাচ্চারা আমার চেয়ে ভালো পড়াশোনার পরিবেশ পায়। তারা অনেক পরিশ্রমও করে। তাই আমাকে আরও বেশি চেষ্টা করেতে হবে।’

১৭ বছর বয়সের মেয়ে মোসেলাজুও লের প্রাথমিক স্কুল থেকে পাস করে চাওচুয়ে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয়েছে। সে ক্লাসের সবচেয়ে বয়স্ক মেয়ে। ছোটবেলায় তাকে লতার সিঁড়ি বেয়ে স্কুলে যেতে হতো। তখন থেকেই সে পরিশ্রম করে আসছে। সে বড় হয়ে একজন চীনা ভাষার শিক্ষিকা হতে চায়, জন্মস্থানের বাচ্চাদের শিক্ষায় নিজের অবদান রাখতে চায়।

বর্তমানে ক্লিফ গ্রামের বাসিন্দারা সবাই সুখী জীবন কাটাতে পারছেন। পিতারা পাহাড়ে গোলমরিচ ও জলপাই চাষ করেন, মাতারা জেলায় পড়াশোনা করা বাচ্চাদের যত্ন নেন। তাদের কাছে পরিবারের সবার একসঙ্গে থাকা ও মাস গেলে বেতন পাওয়া সবচেয়ে বড় সুখের বিষয়।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn