বাংলা

চীনের কুইচৌ প্রদেশের লিউপানশুই শহরের তাওয়ান জেলার হাইকা গ্রামের এক প্রাথমিক স্কুলের মজার ও আকর্ষণীয় গল্প-China Radio International

criPublished: 2021-01-04 18:28:05
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

আজকের আসরে চীনের কুইচৌ প্রদেশের লিউপানশুই শহরের তাওয়ান জেলার হাইকা গ্রামের এক প্রাথমিক স্কুলের মজার ও আকর্ষণীয় গল্প আপনাদের সাথে শেয়ার করবো। এ স্কুল কুইচৌ প্রদেশের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় চিউছাইপিংয়ের পর্বতমালায় অবস্থিত। এখানকার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৩৬০ মিটার। দূরবর্তী এলাকায় অবস্থিত এ স্কুলে আগে মাত্র একজন শিক্ষক ও ৮ জন শিক্ষার্থী ছিল। ২০১৯ সালের আগে এখানকার প্রাথমিক স্কুলের শেষ ক্লাস পর্যন্ত শিক্ষার্থী থাকতো না। তবে বর্তমানে স্কুলে মোট ১০৭ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে। সবাই এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র শিখেছে। তাই স্থানীয় গ্রামবাসীরা এটাকে ‘রক অ্যান্ড রোল স্কুল’ বলে ডাকে।

গ্রামের বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এখানকার ঘরবাড়িগুলোর মধ্যে দূরত্ব বেশি। গ্রামের বাচ্চাদের পাহাড় অতিক্রম করে স্কুলে যেতে হয় এবং স্কুল থেকে বাসায় ফিরে কৃষিকাজও করতে হয়। কারণ, তাদের অনেকের পিতামাতা অন্যান্য শহর বা জেলায় চাকরি করেন। অতীতকালে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কখনও হাসিমুখ দেখা যেতো না। সারাদিন তারা চুপচাপ থাকতো, কেউ লেখাধুলায়ও আগ্রহ দেখাতো না তেমন একটা। পরে একজন শিক্ষকের আগমন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জীবনে বড় পরিবর্তন বয়ে আনে। ২০১৬ সালে কু ইয়া নামক একজন শিক্ষক স্কুলের বিশেষ শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি গিটার বাজাতে পছন্দ করেন। তিনি যখন গিটার বাজান, তখন গিটারের শব্দ ছাত্রছাত্রীরা মনোযোগ দিয়ে শুনে থাকে। পরে তিনি গিটার নিয়ে স্কুলের ক্লাসরুম আসা শুরু করেন এবং ছাত্রছাত্রীদের গিটার বাজাতে উত্সাহ দেন। শুরুর দিকে স্কুলে কোনো বাদ্যযন্ত্র ছিল না। বাজেটও যথেষ্ঠ নয়। স্কুলের প্রেসিডেন্ট জনাব চেং লুং বলেন, তিনি জেলার ১০টিরও বেশি প্রাথমিক স্কুলে গিয়েছেন এবং মাত্র দু-তিনটি স্কুলে বাদ্যযন্ত্র পেয়েছেন। তিনি স্কুলের জন্য ৪টি বাদ্যযন্ত্র ভাড়া করেন।

তারপর থেকে স্কুলের শিক্ষক কু অন্যান্য জায়গা থেকে কয়েক ধরনের বাদ্যযন্ত্র খুঁজে নেন। বর্তমানে স্কুলে গিটার, টাম্বুরাইন ও বেথসহ মোট ২০০টির বেশি বাদ্যযন্ত্র রয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা সহজ বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারে এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা বেথ, টাম্বুরাইন ও ড্রাম কিট শিখতে পারে। লাঞ্চের পরে বাদ্যযন্ত্র বাজানোর সুখী সময়।

যদিও ছাত্রছাত্রীদের বাদ্যযন্ত্র শেখার আগ্রহ বেশি, তবে পেশাগত সংগীতজ্ঞান একটু দুর্বল। তাই প্রতিবারের রিহার্সাল সবার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ সম্পর্কে শিক্ষক কু বলেন, বাচ্চারা বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পছন্দ করে। পরে একটি সংগীতদল গঠনের চেষ্টা করেন তিনি। প্রথমবার সংগীতদলের সদস্য বাছাই করার সময় কেউ জানত না সংগীতদল মানে কী? পরে শিক্ষক কু ৫ জন সদস্যের সংগীতদল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। একজন গায়ক, একজন বেসিস্ট, দু’জন গিটারিস্ট এবং একজন ড্রামার। সংগীত বাজানোর পদ্ধতি ও প্রদর্শিত ভঙ্গি সবই শিক্ষকের নির্দেশনায় করে তারা।

হাইকা প্রাথমিক স্কুলের প্রেসিডেন্ট জনাব চেং লুং গ্রামের শিক্ষাদানে ২০ বছরেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন। কারিগরি স্কুল থেকে গণিত মেজর নিয়ে স্নাতক হওয়ার পর তিনি অন্যান্য মেজরেও পড়াশোনা করেন। এর আগে গ্রামের স্কুলে সংগীত ক্লাসও চালু হয়েছে। তবে শিক্ষক সংগীততত্ত্ব ঠিক জানেন না, তাই ধীরে ধীরে সংগীত ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়।

শিক্ষক কু আসার পর তিনি সংগীতের সুর সহজভাবে শেখানোর পদ্ধতি বের করেন। পরে তিনটি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে ক্লাস শুরু করেন। প্রতি ১০ মিনিটে এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজানোর পদ্ধতি সবাইকে বুঝিয়ে দেন। এভাবে স্কুলের সংগীতদল গত দুই বছরের মধ্যে মোট ৪টি গান শিখতে পেরেছে। ৫ জন মেয়ে নিয়ে গঠিত সংগীতদলের নাম ‘ইয়ু’, যার অর্থ হল পরস্পরের সাথে পরিচিত হওয়া। ৫ জনের কোনো পেশাদার প্রশিক্ষণ নেই। শূন্য থেকে সংগীতের সুর শিখতে হয় তাদের। প্রত্যেকের জন্য বাদ্যযন্ত্র বাজানো নতুন ব্যাপার। মঞ্চে দাঁড়িয়ে অনেকে ভয় পায়। সে জন্য শুরুর দিকে শিক্ষক কু তাদের পারফরমেন্স নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন। পরে মেয়েরা আরো পরিশ্রম করতে শুরু করে ও মনোযোগ দিয়ে গান গাওয়া ও বাদ্যযন্ত্র বাজানোর চেষ্টা করতে থাকে। ধীরে ধীরে গানের সুরের সাথে নৃত্য করা শেখে তারা। তখন শিক্ষক কু তাদের অনুষ্ঠান রেকর্ড করে ওয়েবসাইটে আপলোড করেন। এভাবে মেয়েদের সংগীতদলের অনুষ্ঠান ধারাবাহিকবাবে চলতে থাকে। প্রতিবছর দু’তিন বারের মতো জেলা বা শিক্ষা বিভাগের পার্টিতে গান গায় তারা। মেয়ে লুও লি সিন এবং লুও ছুন মেইয়ের বাবা গ্রামে কৃষিকাজ করেন। তিনি কয়েকবার মেয়েদের অনুষ্ঠান দেখেছেন এবং খুবই পছন্দ করেছেন। যদিও সংগীত তিনি বোঝেন না, তবে তিনি পাহাড়ের লোকসংগীত গাইতে পারেন। মেয়েকে বাদ্যযন্ত্র শেখায় কোনো বাধা দেননি তিনি এবং মাঝে মাঝে তিনি অনলাইনে তাদের ভিডিও উপভোগ করেন। তবে যাদের পিতামাতা শহর বা জেলায় চাকরি করেন, তারা বাচ্চাদের অনুষ্ঠান কখনো দেখেননি।

মেয়ে সিয়োংহুই সর্বশেষ সংগীতানুষ্ঠানে পারফর্ম করেছে। তার গাওয়া ‘জেলার মেয়ে’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয় ও সুমধুর। নতুন গঠিত এ সংগীতদলের বাচ্চাদের অনেকে জন্মগ্রহণ থেকে কিছুদিন আগ পর্যন্তও গ্রামের বাইরে যায়নি। কিন্তু তাদের ভিডিও অনলাইনে জনপ্রিয় হওয়ার পর তারা বাইরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। গত বছর থিয়ানচিন টেলিভিশনের আমন্ত্রণে তারা থিয়ানচিনে অনুষ্ঠান রেকর্ড করতে যায়। তাদের প্রথম বিমানে চড়ার অভিজ্ঞতাও হয় তখন। মেয়ে লুও লি সিন শহরের উঁচু ভবন ও সুউজ্জ্বল নিয়ন লাইট দেখে অবাক ও খুশী হয়। সে বলে যে, কল্পনার চেয়ে আরও সুন্দর, তাই বড় হওয়ার পর আরো দূর জায়গা ঘুরে দেখবে।

আসলে গ্রামের বাচ্চারা পাহাড়ের বাইরে যেতে আগ্রহী। কারণ গ্রামে থাকলে কৃষিকাজ করতে হয় এবং প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া-আসার রাস্তা অনেক দূর। মেয়ে লি মেই ইন শাংহাই বা বেইজিংয়ে যেতে চায়। কারণ, টেলিভিশনে সে রাজপ্রাসাদ ও পার্ল টাওয়ার দেখেছে, যা অনেক সুন্দর। বড় শহরের সংগীতদলগুলোও তাকে আকর্ষণ করে থাকে।

সংগীতদলের গানের মধ্যে একটি বেশ পছন্দ করে মেয়ে লি। গানের নাম ‘সাধারণ পথ’। গানের একটি কথা তার মনে বেশি দাগ কেটেছে। কথাটি হলো: ‘আমি তোমার বা তার মতো, রাস্তার পাশে বুনো ফুলের মতো’। ‘আমি সাধারণ মানুষ। এ গানের কথা যেন আমার অভিজ্ঞতা।’—সে এমন কথা বলল।

কয়েক বছরের সংগীতচর্চার পর স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা অপরিচিত লোক দেখে এখন আর ভয় পায় না। তারা আগের চেয়ে আরও আত্মবিশ্বাসী। মনের ভাবনা সাহসের সাথে প্রকাশ করতে পারে। গিটার শেখার পর মেয়ে লি মেই ইনও সাহসের সাথে প্রদর্শনী উপভোগ করতে পরে। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া তাদের জন্য খুশীর ব্যাপার হয়ে উঠেছে।

২০০২ সাল থেকে বর্তমান স্কুলের প্রেসিডেন্ট চেং লুং হাইকা গ্রামে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এ গ্রাম হান ও ই জাতিঅধ্যুষিত এলাকা। এখানকার কৃষি উত্পাদন পরিবেশ দুর্বল এবং কোনো খনিজ সম্পদ নেই। তাই গ্রামের ৩৬০টি পরিবারের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা ৩০০টিতে দাঁড়িয়েছে। অতীতকালে গ্রামের বিদ্যুত্, জল ও রাস্তা—কিছুই ছিল না। শিক্ষকরা শুধু জেলায় মিটিংয়ে অংশ নেওয়ার সময় গোসল করতেন। স্কুল থেকে প্রেসিডেন্ট চেংয়ের বাড়িতে যেতে পায়ে হেঁটে তিন-চার ঘন্টা লাগে। প্রথম দিন গ্রামে আসার সময় তিনি পথ হারিয়ে ফেলেন। স্কুলে পৌঁছে দেখেন বাচ্চারা বাড়িতে চলে গেছে। আরেকবার তিনি ভারী কুয়াশায় অন্য একজন গ্রামবাসীকে ধাক্কা দিয়ে বসেন।

গত ২০ বছর ধরে হাইকা প্রাথমিক স্কুলে কোনো সিনিয়র শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিল না। পড়াশোনা করতে চাইলে জেলার স্কুলে যেতে হয়। অনেক শিক্ষকও এখান থেকে চলে যান। ২০১৪ সালে স্কুলে মাত্র ১ জন শিক্ষক ও ৮ জন শিক্ষার্থী বাকি ছিল। তিনি অন্যান্য জায়গা থেকে নতুন শিক্ষক সংগ্রহের চেষ্টা চালান। ২০১৬ সালে শিক্ষক কু ইয়া প্রেসিডেন্ট চেংয়ের উত্সাহে ৪ জন শিক্ষকের সাথে হাইকা প্রাথমিক স্কুলে আসার আবেদন করেন। স্কুলের জন্য ছাত্রছাত্রী খুঁজে পেতে প্রেসিডেন্ট চেং প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে ঘুরতে থাকেন। স্কুলে আসার উপযোগী বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের রাজি করানোর চেষ্টা করেন। তখন কোনো কোনো বাচ্চার বাবা-মা কৌতুক করে বলেন: ‘যদি স্কুলে ফিরে যেতে হয়, তাহলে আমার বাচ্চাকে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়তে হবে।’ স্থানীয় ই জাতির বাচ্চারা ম্যান্ডারিন ভাষায় দুর্বল। তাই স্কুলের ক্লাস শেষে শিক্ষকরা অতিরিক্ত সময় বাচ্চাদের হান ভাষা শেখান। হোমওয়ার্ক শেষ করে রাত ১০টির দিকে তারা বাচ্চাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেন।

শুরুর দিকে গ্রামের বাচ্চাদের মধ্যে অর্ধেকের বাড়িতে বাবা-মা ছিল না। স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে নিজের জন্য রান্না করতে হতো বাচ্চাদের। পরে শিক্ষক চেং ও কু বাচ্চাদের জন্য রান্না করা শুরু করেন। স্কুল থেকে বাচ্চাদের বাড়িতে যাওয়ার সময় কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসও সাথে করে নিয়ে যেতেন।

বাচ্চাদের সুন্দর প্রদশর্নীর জন্য সুন্দর কাপড়চোপড়ও লাগে। মেয়ে লি মেই ইনের শহরে গানের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সময় শিক্ষক কু ইয়া ২০০ ইউয়ানেরও বেশি দামী সাদা স্কার্ট তাকে কিনে দেন। অনলাইনে শিক্ষক কু’র ভিডিও পোস্ট আগে বেশি জনপ্রিয় হয়নি, প্রতিদিন মাত্র ২০ থেকে ৩০টি লাইক পেতো। তবে ২০২০ সালের গ্রীষ্মকালে ভিডিও হঠাত্ ব্যাপক জনপ্রিয় ও সুপরিচিত হয়ে ওঠে। চীনের অনেক পেশাদার সংগীত মহলের ব্যক্তিও তাদের গানের প্রশংসা করেছেন।

তখন থেকে শিক্ষক কু অনেক উদ্বিগ্ন ছিলেন। কারণ, অতিরিক্ত মনোযোগ পাওয়ার পর বাচ্চাদের ওপর বেশি মানসিক চাপ পরতে পারে। অথচ বর্তমানে পড়াশোনা তাদের জন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাই প্রতিটি কনসার্ট শেষ করে শিক্ষক কু বাচ্চাদের বলেন যে, জনপ্রিয় হলেও ভালভাবে লেখাপড়া করতে হবে, সেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

ছাত্রীদের জন্য সংগীতচর্চা স্বপ্নের মতো। শিক্ষক কু’র আরও বেশি শিক্ষার্থী সংগীত শিখতে চায়। এখন প্রথম সংগীতদলের মেয়েরা মাধ্যমিক স্কুলে চলে গেছে এবং জেলায় তাদের নতুন জীবন শুরু হয়েছে। মেয়ে ইয়ান সিং লি তার সংগীতদলের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষক কু’র সাথে পরিচয় স্মরণ করে একটি গান রচনা করেছেন। গানের নাম তাদের সংগীত দলের নামে ‘ইয়ু’। গানের কথায় সে লিখেছে: ‘তুমি বহুবারের মতো আমাদের চেষ্টাকে উত্সাহ দাও, নিজের স্বপ্নের বাস্তবায়নে যাত্রা করি। তোমার সাথে পরিচয় হওয়ার কারণে আমাদের নতুন অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে।’

সুপ্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, সময় দ্রুত চলে যায়, আজকের অনুষ্ঠান তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে এলো। নতুন বছরের শুভকামনা জানিয়ে বিদায় নিচ্ছি। সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন। আগামী বছরের প্রতি সোমবারে আবার দেখা হবে, কথা হবে। যাইচিয়ান।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn