বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে সহায়ক বিআরআই
বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর পেয়ারা থেকে দূরে তাকালে, দেখা যায় একটি উঁচু কুলিং টাওয়ার কারখানার উপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কারখানাটি চীন ও বাংলাদেশের যৌথ বিনিয়োগে নির্মিত দেশটির বৃহত্তম বিদ্যুৎ কারখানা—পায়রা। এটি, প্রতিটি ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ২ ইউনিটের আল্ট্রা-সুপারক্রিটিকাল কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
বাংলাদেশের কয়লার মতো খনিজ সম্পদের অভাব রয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে, বিদ্যুত্ ক্ষেত্রের অবকাঠামো যথেষ্ট নয়। অর্থনীতির দ্রুত বৃদ্ধিতে সৃষ্ট বিদ্যুত্ চাহিদা বাড়ার পরিস্থিতিতে দেশটির বিদ্যুত্ সরবরাহের বিরাট ঘাটতি আছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
এক অঞ্চল এক পথ উদ্যোগে’র (বিআরআই) আওতায় ২০১৬ সালে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু করে চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএমসি) এবং বাংলাদেশের নর্থওয়েস্ট পাওয়ার কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে গঠিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-চীন বিদ্যুত্ কোম্পানি। ‘
২০২২ সালে বিদ্যুত্ কারখানার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কারখানাটির বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু হবার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সার্বিক বিদ্যুতের সম্পূর্ণ কভারেজের নতুন যুগে প্রবেশ করেছে।
“পায়রা বিদ্যুত্ কারখানা বাংলাদেশের বিদ্যুত্ সরবরাহের দৃঢ় ভিত্তি।” কোম্পানির চীনা পক্ষের সাইট প্রযুক্তি ম্যানেজার ওয়াং সিয়াংজি বলেন, প্রতি বছর বিদ্যুত্ কারখানা বাংলাদেশের জন্য ৮৫৮ কোটি কিলোওয়াট স্থিতিশীল ও নির্ভরশীল বিদ্যুত্ সরবরাহ করতে পারে। যা সারা দেশের বিদ্যুত্ চাহিদার প্রায় ১০ শতাংশ।
এ ছাড়া পায়রা বিদ্যুত্ কারখানা স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য ৮ হাজার ৪০০টি কর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টি করেছে এবং প্রায় ৬ হাজার ৩০০ জনকে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এর মাধ্যমে এটি স্থানীয় মেধাশক্তি লালনের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে।
প্রকল্পে চার বছর ধরে কাজ করছেন বাঙালি প্রকৌশী হক। তিনি বলেন, “শূন্য ভিত্তি থেকে এ পর্যন্ত চীনা প্রকৌশলী হাতে ধরে আমাকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছেন। এখানে কাজ করার জন্য আমি খুব গর্বিত।” তিনি আরো বলেন, অনেক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পরও চাকরি পেতেন না। কিন্তু বিদ্যুত্ কারখানা তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ এনে দিয়েছে।
প্রকৌশলী হক আরো জানান, বিআরআইয়ের আওতায় যৌথ নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য অনেক সহায়ক। বিদ্যুত্ বিভাগ শুধু বহু-সুবিধা ক্ষেত্রের অন্যতম। পায়রা বিদ্যুত্ কারখানা ছাড়া বাংলাদেশের আরো অনেক জায়গায় বিআরআইয়ের কারণ উন্নয়ন হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ নতুন জ্বালানি উন্নয়ন করার চেষ্টাও চালিয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তি, অভিজ্ঞতা ও অর্থের অভাব দেশটির জ্বালানি রূপান্তরের পদক্ষেপ বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া দেশটির ‘২০৪১ ভিশন’ বাস্তবায়নের ওপরও প্রভাব ফেলে। কিন্তু চীনা অংশীদারের অংশগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে এসবই পরিবর্তিত হয়।
২০১৯ সালে হুয়াসিন হোল্ডিংস কোম্পানি লিমিটেডের বিনিয়োগে ময়মনসিংহ ফটোভোলটাইক প্রকল্প শুরু হয়। পরের বছরের শেষ নাগাদ প্রকল্পের অপারেশন চালু হয়। চীন থেকে আনা প্রায় ১.৭ লাখ সৌর প্যানেল স্থাপন করে প্রকল্পটি সৌরশক্তিকে বিদ্যুতে পরিণত করে, আলোকিত হয় হাজার হাজার পরিবার। এ বিদ্যুত্ কেন্দ্রের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশ ৫০ হাজার টনের বেশি কার্বন নির্গমন কমিয়েছে।
স্থানীয় কৃষক ফজলুর বলেন, “আমাদের এখানে ফটোভোলটাইক পাওয়ার স্টেশন থাকাতে খুব ভাল হয়েছে। আগে, এখানকার বিদ্যুত্ সরবরাহ সীমিত ছিল। মাঝেমাঝে বিভ্রাট ঘটতো। এখন ফটোভোলটাইক পাওয়ার স্টেশনের কারণে বিদ্যুত্ সরবরাহ স্থিতিশীল হয়ে উঠছে।”
তিনি আরো বললেন, পাওয়ার স্টেশনটি শুধু স্থানীয় পর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে তা নয়, এটি নগরায়নের মানও উন্নীত করছে। স্টেশনটির কারণ মানুষ আশপাশে কৃষিকাজ ও ব্যবসা শুরু করেছে। একটি সাধারণ গ্রাম, শহরে পরিণত হয়েছে। মানুষের আয় বেড়েছে, জীবনযাপনও সুবিধাজনক হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় শহর কক্সবাজারে দেশটির প্রথম কেন্দ্রীভূত বায়ু শক্তি প্রকল্পের ২২টি ব্লোয়ার ঘুরছে।
চীনের উলিং পাওয়ার কর্পোরেশন লিমিটেড প্রকল্পটি বিনিয়োগ ও উন্নয়ন করে, পাওয়ার চায়না ছেংদু ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন লিমিটেড প্রকল্পটির সাধারণ নির্মাণকাজ করে। ২০২৩ সালের অক্টোবর চালু হবার পর থেকে প্রকল্পটি মোট ৮ কোটি কিলোওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন করেছে। অনুমান করা হচ্ছে, প্রতি বছর ১৪.৫ কোটি কিলোওয়াট সবুজ বিদ্যুত্ সরবরাহ করে, ১ লাখ পরিবারের বিদ্যুত্ চাহিদা পূরণ করে, ৪৪.৬ হাজার টন কয়লা খরচ কমায় এবং ১ লাখ টন কার্বনডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হ্রাস করে।
বাঙালি প্রকৌশলী আলম জানান, বায়ু-বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রত্যেক বায়ু ঘূর্ণনযন্ত্রে সর্বশেষ চীনা প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। যা সহজে সেকেন্ডে ৫.২ মিটারের বাতাসের গতিবেগ মোকাবিলা করতে পারে।
উলিং পাওয়ার বাংলাদেশের শাখা কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার হেই চাও বলেন, “এটি হলো বিনিয়োগ পক্ষ হিসেবে চীনা প্রতিষ্ঠান প্রথমবারের মতো বায়ু শক্তিকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে এবং দেশটির নতুন জ্বালানি উন্নয়নের জন্য এটি একটি মাইলফলক প্রকল্প।” প্রকল্পের নির্মাণ প্রক্রিয়ায় কোম্পানি চীনা পরিকল্পনা, চীনা মানদণ্ড, চীনা সরঞ্জাম ও চীনা প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। স্থানীয় পক্ষের স্বীকৃতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের জন্য প্রথম দফা বায়ু বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের ব্যবহারিক মেধাশক্তি লালন করেছে।
“এটি হলো আমাদের দেশ আরো দূষণমুক্ত ও আরো টেকসই জ্বালানি সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প।” এটি চালু হবার অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব রহমান এমন কথা বলেন।
বিদ্যুত্ কেন্দ্র ছাড়া চীনা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের ট্রান্সফরমার সাবস্টেশন এবং বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিশন লাইনের নির্মাণ, সম্প্রসারণ, আপগ্রেড ও রূপান্তরের মতো প্রকল্পে অংশ নেয়। ফলে কার্যকরভাবে বাংলাদেশের পাওয়ার গ্রিড উন্নীত করে স্থিতিশীল অপারেশন এবং ট্রান্সমিশন ক্ষতি হ্রাস লক্ষ্য বাস্তবায়নে সহায়তা দেয়।