বাংলা

প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও ফ্রান্সের সংস্কৃতি

CMGPublished: 2024-05-08 10:54:01
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

প্রতি নববর্ষে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং একটি জাতীয় ভাষণ দেন এবং তিনি তার অফিসে বসেই এ ভাষণ দেন। তার অফিসের বইয়ের তাকে কী কী বই রয়েছে, তা দেশ বিদেশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

প্রেসিডেন্ট সি’র অফিসে রয়েছে অনেক ফ্রান্সের সাহিত্য ও শিল্পকর্ম। যেমন ‘দ্য স্পিরিট অফ ল’, ‘লা মিজেরেবল’, ‘দ্য রেড অ্যান্ড দ্য ব্ল্যাক’ এবং ‘দ্য হিউম্যান কমেডি’ ইত্যাদি। তিনি একবার বলেছেন, “যুববেলা থেকে আমি ফ্রান্সের সাহিত্য নিয়ে আগ্রহী এবং ফ্রান্সের ইতিহাস, আর্ট, দর্শন ও সাহিত্য আমাকে আকর্ষণ করে।”

প্রেসিডেন্ট সি বই পড়তে পছন্দ করেন এবং বই পড়ার মাধ্যমে তার বিশ্বদৃষ্টি গঠিত হয়। চীনের নেতা হবার পর সাংস্কৃতিক বিনিময় তাঁর পররাষ্ট্র বিষয়ক কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়, যা চীন ও বিশ্বের নানা দেশের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়ায়।

চীন ও ফ্রান্সের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৬০তম বার্ষিকী উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট সি তৃতীয় বারের মতো ফ্রান্সে রাষ্ট্রীয় সফর করেন। সারা বিশ্ব জানতে চায় চীনের এই নেতা কীভাবে পূর্ব ও পশ্চিম দুটি সভ্যতার মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনবেন।

ফ্রান্সে, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের রাষ্ট্রীয় সফর উপলক্ষে ফরাসি সংবাদপত্র ‘লে ফিগারো' ৫ মে ‘চীন ও ফ্রান্সের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেতনা অনুসরণ করে বিশ্ব শান্তি ও উন্নয়নের যৌথ প্রচার করা’ শিরোনামে তাঁর একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে।

নিবন্ধে, প্রেসিডেন্ট সি উল্লেখ করেছেন যে, ২০২৪ সাল একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ সময়। তিনি এ সময় ফ্রান্সে আসেন এবং চীন থেকে তিনটি বার্তা নিয়ে আসেন। প্রথমত, চীন, ফ্রান্সের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে চীন-ফ্রান্স সম্পর্ককে উন্নীত করতে ইচ্ছুক। দ্বিতীয়ত, চীন উচ্চ-স্তরের উন্মুক্তকরণ অব‍্যাহত রাখবে এবং ফ্রান্সসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে সহযোগিতা গভীরতর করবে। তৃতীয়ত, বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য চীন ফ্রান্সের সঙ্গে যোগাযোগ ও সহযোগিতা জোরদার করতে ইচ্ছুক।

নিবন্ধে, প্রেসিডেন্ট সি আরও উল্লেখ করেছেন যে, চীন এবং ফ্রান্স, স্বাধীন ও স্বতন্ত্র চেতনার দুটি প্রধান দেশ হিসাবে, দীর্ঘ ইতিহাসে যখনই তারা মিলিত হয় তখনই বিশাল শক্তি সঞ্চারিত করতে পারে এবং বিশ্বের উন্নয়নের দিককে প্রভাবিত করতে পারে। একটি নতুন ঐতিহাসিক সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নে নতুন সাফল‍্য অর্জন করতে এবং উভয় দেশ ও বিশ্বকে উপকৃত করতে ফ্রান্সের সাথে হাত মেলাবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন চীনের প্রেসিডেন্ট।

বিংশ শতাব্দীর ৬০’র দশকে বেইজিং থেকে শায়ানসি প্রদেশের লিয়াং চিয়া হ্য নামে একটি গ্রামে কাজ করতে যান সি চিন পিং। কঠোর গ্রামীণ জীবনে বই তাকে সান্ত্বনা দেয়। তিনি সেই সময়ে পাওয়া সব বিখ্যাত সাহিত্য পড়েন। ‘দ্য রেড অ্যান্ড দ্য ব্ল্যাক’ তার মধ্যে একটি বই। এ বইগুলো পড়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেছেন, “স্টেন্ডহালের ‘দ্য রেড অ্যান্ড দ্য ব্ল্যাক’ খুব প্রভাবশালী একটি বই। তবে যখন মানব জগতের কথা আসে তখন বালজাক এবং মোপাসাঁর কাজ বিবেচনা করতে হবে, যেমন ‘দ্য হিউম্যান কমেডি’র একটি দুর্দান্ত প্রভাব রয়েছে।

ফ্রান্সের লেখক ও তাদের শিল্পকর্ম তাঁর মনে গভীর ছাপ ফেলে এবং তিনি ভাষণে তাদের কথা উদ্ধৃত করতে পছন্দ করেন। যেমন ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ জলবাযু পরিবর্তন বিষয় প্যারিস সম্মেলনে তিনি ভিক্টর হুগোর ‘লা মিজেরাবল’ থেকে একটি বাক্য উদ্ধৃত করে বলেন, সর্বশ্রেষ্ঠ সংকল্প সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞা থেকে আসে।

পাশাপাশি তিনি ফ্রান্সের চিত্রকলাও পছন্দ করেন। তিনি ফরাসি সুরকার বিজেট এবং ডেবুসির কাজ পছন্দ করেন। তিনি মহিমান্বিত আর্ক ডি ট্রায়ম্ফ এবং ভার্সাইয়ের মহৎ প্রাসাদ পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, নটরডেম ডি প্যারিস ফরাসী সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক এবং মানব সভ্যতার একটি অসামান্য সম্পদ।

সাম্প্রিতক বছরগুলোতে চীন ও ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক বিনিময় দ্বিপাক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০১৯ সালে ফ্রান্সের নাইসে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ শতাধিক বছরের ঐতিহাসিক ভিলা ক্রিরোসে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে আপ্যায়িত করেন। সেখানে তিনি একটি ফরাসি ভাষার ‘কনফুসিয়াসের অ্যানালেক্টসের ভূমিকা’ উপহার হিসেবে প্রেসিডেন্ট সিকে দেন। ১৬৮৮ সালে ছাপা এ বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা হয়, প্রিয় পাঠক, এ বই কনফূসিয়াসকে জানার একটি চাবি। ফরাসি প্রেসিডেন্ট বলেন, ভলতেয়ার এবং মন্টেসকুইউসহ বিখ্যাত চিন্তাবিদ কনফুসিয়াসের চিন্তাধারা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। প্রেসিডেন্ট সি এ উপহার অনেক পছন্দ করেন এবং এ বই এখন চীনের জাতীয় গ্রন্থাগারে রক্ষিত আছে।

১৭তম শতাব্দীতে ইউরোপ ও চীনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ছিল। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ১৮তম শতাব্দী সারা ইউরোপ মহাদেশে চীনা ধারা দেখা দেয়। ওই সময়ে ফ্রান্সের চীন-বিশারদরা কনফুসিয়ানিজম অধ্যয়ন করেন এবং তাঁর চিন্তাধারা সারা ইউরোপে প্রচার করেন।

অনেক সাংস্কৃতিক গবেষকও চীন ও ফ্রান্সের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় লক্ষ্য করেন। আধুনিক চীনের বিখ্যাত পণ্ডিত কু হং মিং তার একটি বইয়ে এভাবে লিখেছেন, এ বিশ্বে যেন শুধু ফ্রান্সের মানুষ চীন ও চীনা সভ্যতা বুঝতে পারে, কারণ তাদের চীনের মতো বিশেষ এক ধরনের মানসিক বৈশিষ্ট্য আছে।

২০২৪ সালের পয়লা এপ্রিল, চীন-ফ্রান্স সংস্কৃতি ও পর্যটন বর্ষের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প হিসেবে ‘রাজপ্রাসাদ যাদুঘর ও ভার্সাই প্রাসাদ, ১৭ ও ১৮তম শতাব্দীতে চীন ও ফ্রান্সের আদানপ্রাদন’ শিরোনামে একটি প্রদর্শনী বেইজিংয়ে উদ্বোধন হয়। সেখানে ২০০টির বেশি পুরাকীর্তি প্রদর্শিত হয়।

চীনা প্রেসিডেন্ট মতে চীন ও ফ্রান্স অভিন্নহৃদয় বন্ধু হতে পারে, কারণ দু’দেশের আছে গভীর সাংস্কৃতিক ভিত্তি। গত বছরের এপ্রিল মাসে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট চীনের কুয়াং চৌতে সফর আসেন এবং সেখানে প্রেসিডেন্ট সির সঙ্গে বৈঠক করেন। দু’জন একসাথে ঐতিহ্যবাহী চীনা বাদ্যযন্ত্র ‘কুছিনে’ বাজানো পাহাড় এবং প্রবাহিত জল শিরোনামে একটি সংগীত উপভোগ করেন। এ সংগীতের নামকরণ সম্পর্কে একটি কাহিনী শোনান প্রেসিডেন্ট সি। তিনি বলেন, প্রাচীন চীনে ইউয়ু পো ইয়া ও জুং জি ছি নামে দুই ব্যক্তি ছিলেন। তারা পরস্পরের অভিন্নহৃদয় বন্ধু। কেবল অভিন্নহৃদয় বন্ধু এ সংগীত বুঝতে পারে।

২০১৪ সালে, প্যারিসে জাতিসংঘ সংস্থা ইউনস্কোর সদর দপ্তরে প্রেসিডেন্ট সি একটি ভাষণ দেন এবং সেখানে হুগোর একটি কথা তিনি উদ্ধৃত করেন। এ বিশ্বে সবচেয়ে বিশাল হল সমুদ্র। তার চেয়ে বিশাল হবে আকাশ আর আকাশের চেয়ে বিশাল হবে মানুষের মন। উন্মুক্ত মনোভাব দিয়ে বিভিন্ন সভ্যতা গ্রহণ করতে হবে বলে জানান চীনা প্রেসিডেন্ট।

এক দশক পর ইউনেস্কোর তৎকালীন মহাপরিচালক, ইরিনা বোকোভা, এখনও স্পষ্টভাবে প্রেসিডেন্ট সির ভাষণটি মনে রেখেছেন। প্রেসিডেন্ট সি বলেছেন, বর্তমান বিশ্বে মানুষ বিভিন্ন সংস্কৃতি, জাতি, ধর্ম ও সামাজিক ব্যবস্থায় বাস করে। সবাই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল একটি অভিন্ন স্বার্থের সমাজ গড়ে তুলেছে।

বোকোভা বলেন, দশ বছর হলেও প্রেসিডেন্ট সির কথা এখনও অর্থবহ।

৬০ বছর আগে, ১৯৬৪ সালের ২৭ জানুয়ারি চীন ও ফ্রান্স কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে এবং পূর্ব ও পশ্চিমা দুনিয়ার বিছিন্নতা ভেঙে দিয়েছে। এটি বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে বহুপক্ষবাদের দিকে এগিয়ে দিয়েছে এবং নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।

প্রেসিডেন্ট সি একবার বলেছেন, চেয়ারম্যান মাও সে তুং ও জেনারেল ডি গল অসাধারণ বুদ্ধি ও সাহস নিয়ে পূর্ব -পশ্চিম সহযোগিতার একটি দরজা খোলেন এবং স্নায়ুযুদ্ধে আটকে পড়া বিশ্বের জন্য আশার আলো বয়ে আনেন।

বেইজিং ইউনিভার্সিটি অফ ফরেন স্টাডিজের ইইউ ও আঞ্চলিক উন্নয়ন গবেষণালয়ের পরিচালক চুই হং চিয়ান বলেন, চীন ও ফ্রান্সের আছে স্বাধীন সভ্যতা এবং তার মধ্যে কিছু মিল রয়েছে।

তিনি মনে করেন, গভীর ইতিহাস ও সংস্কৃতির কারণে চীন ও ফ্রান্স বিশ্বের উন্নয়ন ও পরিবর্তন নিয়ে গভীরভাবে উপলবদ্ধি করে। দেশ দুটি অন্যদের নেতৃত্বে থাকতে চায় না, আর অন্যদেরকে নির্দেশনাও দিতে চায় না।

ফ্রান্সের সাংবিধানিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফবিয়াস বলেন, ফ্রান্স ও চীন বহুপক্ষবাদ ও শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন সমর্থন করে। বিশ্ব সংকটে পূর্ণ, এবং শান্তি বজায় রাখার এবং টেকসই উন্নয়ন এগিয়ে নেয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। এটি ফ্রান্স এবং চীনের মতভেদকে অতিক্রম করে একসাথে পালন করার গুরুত্বপূর্ণ একটি মিশন।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn