বাংলা

চেংতু: চীনের একটি বৃহত্ স্মার্ট নগর

CMGPublished: 2023-03-15 17:18:52
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের সি ছুয়ান প্রদেশের রাজধানী চেংতু। তার স্থায়ী লোকসংখ্যা ২.১ কোটির বেশি এবং জিডিপি ২ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ৩২২ বিলিয়ন ডলার)। বড় একটি শহরের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় আধুনিক প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। চেংতু তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

এখানকার রাস্তাগুলো স্ট্রিট লাইট সেন্সর সিস্টেম দিয়ে সজ্জিত। পথচারীর সংখ্যা অনুপাতে লাইটের উজ্জ্বলতা বাড়ে কমে। তা জ্বালানি সাশ্রয়ী হিসেবে সর্বমহলের প্রশংসা অর্জন করেছে। চেংতু শহরের সেতুর ওপর মনিটরিং ব্যবস্থা স্থাপিত হয়েছে। কোন অস্বাভাবিক তথ্য দেখা গেলে এসব মনিটর স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুলিশকে জানিয়ে দেয়। বাসিন্দাদের বাসায় কোন বড় আবর্জনা থাকলে অনলাইনে বুকিং করলে কর্মীরা বাসায় এসে তা রিসাইকেল করে যায়। যদি আপনি চেংতু শহরে বাস করেন, তাহলে এ শহরকে একটি স্মার্ট শহর মনে করতে পারেন।

চেংতু শহরের বাসিন্দারা যে কোন সমস্যায় পড়লে একটি হটলাইন নম্বরে ফোন দিতে পারেন। আর তা হলো ১২৩৪৫। এর মাধ্যমে অধিবাসীরা শহর পরিচালনায় নিয়োজিত নানা বিভাগের কাছে নিজেদের কথা জানাতে পারেন। যেমন: জানুয়ারি মাসে মিস কাও তার কোম্পানির ইক্যুইটি পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। তবে তার ব্যবসার পরিধি কোম্পানির নামের সাথে মিলছিল না। তাই এ কাজটি তিনি করতে পারেন না। এমতাবস্থায় তিনি হটলাইনে (১২৩৪৫) ফোন দেন। তার পর তার কোম্পানি যেখানে আছে সেখানকার সরকারি কর্মীরা দ্রুত তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এবং চার ঘণ্টা পর তার সমস্যা সমাধান হয়ে যায়।

চেংতুর হাইটেক জোনে রয়েছে ৩.৬ লাখের বেশি কোম্পানি এবং তাদের সরকারি নীতি, আর্থিক সহায়তা সহ ৬টি ক্ষেত্রে সেবা প্রদান করা হয়। হটলাইনে হাইটেক জোনের লোকজন এ সেবা গ্রহণ করতে পারেন।

এ হটলাইনে আসা কল ধরতে প্রতিদিন ২০০জন কর্মী থাকেন এবং ২৪ ঘণ্টা এ লাইন সচল থাকে। প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার কল পান তারা।

স্থানীয় বাণিজ্য ব্যুরো, আবাসন ও নগর-পল্লী উন্নয়ন ব্যুরোসহ ১০০টি সরকারি বিভাগ এ লাইনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। শহর থেকে জেলা পর্যন্ত নাগরিকরা যখন কল করেন, তাদের চাহিদা অনুযায়ী অপারেটর সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নাগরিকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দেয়। পাশাপাশি, নাগরিকরা মোবাইলের মাধ্যমেও নিজের অভিযোগ ও দাবির জবাব দেখতে পারেন।

এ হটলাইন বড় একটি ডেটাবেসও বটে। বিগ ডেটার সাহায্যে চেংতু শহরের নানা বিভাগ সমস্যা সম্পর্কে সতর্কতা পেতে পারে। চেংতু চীনের প্রথম কয়েকটি স্মার্ট পরিবহন শহরের মধ্যে অন্যতম। গত ২৪ জানুয়ারি চেংতুর সি সিয়াং গ্রামের বাসিন্দা মিস্টার হু হটলাইনে ফোন করে জানিয়েছেন, তার গ্রামের ব্লু বেরি চাষ কেন্দ্র থেকে পু চিয়াং জেলা যাবার যাত্রীবাহী বাস ছিল না। তাই তিনি তার ব্লুবেরি সময় মতো ওই জেলায় বিক্রি করতে পারেন না। তার ফোন পেয়ে চেংতু পরিবহন বিভাগ বিগ ডেটা দিয়ে বিশ্লেষণ করেছে এবং আবিষ্কার করেছে যে গ্রাম থেকে জেলা পর্যন্ত স্থানীয়রা অনেক বেশি যাতায়াত করে। তারা মেলা করতে এবং ব্লুবেরি বিক্রি করতে যান। পাশাপাশি, শহরের বাসিন্দারা ভ্রমণ করতে এ রুটে যান। একই দিন বিকেলে পু চিয়াং জেলার পরিবহন বিভাগকে এ তথ্য জানিয়েছে চেংতু পরিবহন বিভাগ এবং পরবর্তী দিনে চালু হয় ওই গ্রাম থেকে পুচিয়াং জেলা পর্যন্ত যাত্রীবাহী বাস। প্রতিদিন দুবার আসা-যাওয়া করে এ বাস। বর্তমানে স্থানীয়রা কাজ করতে এবং শহরের বাসিন্দারা ভ্রমণ করতে এ বাস বেশি ব্যবহার করেন।

২০২২ সালে বিগ ডেটার সাহায্যে চেংতু শহরে ১০৬টি বাস স্টেশন ও সাবওয়ে যুক্ত স্থলের অবস্থান পরিবর্তন করা হয়েছে। সারা শহরে ৯০ শতাংশ সাবওয়ের পাশে ৫০ মিটারের মধ্যে রয়েছে বাস স্টপ। বিগ ডেটা বিশ্লেষণ করে ব্যবহারকারীর চাহিদা অনুযায়ী, শেয়ারিং বাইকের অবস্থানও সমন্বয় করা হয়। যেখানে ব্যবহারকারী বেশি সেখানে বেশি শেয়ারিং বাইক রাখা হয়।

বিমান, রেল, সাবওয়ে, বাস, সড়ক পথ, ট্যাক্সিসহ ১৫টি পরিবহন ক্ষেত্রের ডাটা নিয়ে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে চেংতু। প্রতিদিন ৬০ কোটির বেশি নতুন ডেটা আপডেট হয়। পাশাপাশি, শহরের ৯২টি সংস্থা এর সব গতিশীল ডেটা দেখতে পারে, যা নানা বিভাগের সহযোগিতা ও সমন্বয়ে সমর্থন করে।

বসন্ত উৎসব ও বড়দিনের ছুটির সময়ে যাতায়াতের চাপও বেশি থাকে। এসময় বিগ ডেটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। গত ১৫ জানুয়ারি রাত ৮টায় প্ল্যাটফর্ম মনিটরিং ব্যবস্থা আবিষ্কার করে যে ২৩ ঘণ্টা পর ১৫টি ট্রেন দেরিতে চেংতু পূর্ব স্টেশনে পৌঁছাবে। এদের যাত্রী সংখ্যা ৮১৬০ জন। তাই প্ল্যাটফর্ম দ্রুত এ তথ্য বাস, সাবওয়ে ও ট্যাক্সিকে জানিয়ে দিয়েছে। দেরিতে আসা যাত্রীদের সেবা প্রদানে সবাই আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়। ফলে মধ্যরাতে একটা রেল স্টেশনে দেরিতে আসা যাত্রীরা ভালভাবে স্টেশন ছেড়ে গেছেন।

চেং তু শহরের ছিং ইয়াং এলাকার স্মার্ট পরিচালনা কেন্দ্রে ঢুকলে দেখা যায় বড় একটি পর্দা। সেখানে শহরের নানা ডেটা পাওয়া যায়। লাইট, সেতু, পরিবহন ইত্যাদি। তা মনিটর হিসেবে শহরের ‘স্বাস্থ্য’ অর্থাৎ সুষ্ঠু অপারেশন পর্যবেক্ষণ করছে। তারা শহরকে একজন মানুষ হিসেবে তার নানা অঙ্গের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করে। যখন কোন বিষয়ে সমস্যা হয়, তখন পুলিশকে জানানো হয়। শহরের স্বাস্থ্যের সূচক নিরাপত্তা, পরিপাটি, সুশৃঙ্খল এবং সুবিধাজনক চারটি বিষয় নিয়ে গঠিত হয়। যেমন: আজ শহরের স্বাস্থ্য সূচক ৯১ পয়েন্ট; তার মানে শহরের পরিচালনা স্ট্যান্ডার্ড পরিস্থিতিতে আছে। যদি তার পয়েন্ট ৮৪ হয়, তাহলে নানা সূচক বিশ্লেষণ করে সমস্যা সমাধান করতে হয়।

২০২২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সি ছুয়ান প্রদেশের লু তিং জেলায় ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। চেংতু শহরে একটি সেতুর মনিটরিং সিস্টেম অস্বাভাবিক ডেটা আবিষ্কার করে। চেংতু শহর পরিচালনা কমিটি পর্যবেক্ষণ ডেটা পেয়ে সেতুতে গিয়ে চেক করে এবং নিশ্চিত করে যে ভূমিকম্প সেতুর কাঠামোর ওপর কোন নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি।

পাশাপাশি, পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাও কমিউনিটি পরিচালনায় সাহায্য করতে পারে। যেমন: একদিন দেখা যায়, একাকী বসবাসকারী প্রবীণ লিউ দাদার বাসায় বিদ্যুতের ব্যবহার ২৪ ঘণ্টায় লক্ষণীয় ভাবে কমেছে। এ তথ্য দ্রুত লিউ দাদার কমিউনিটির কর্মীদের কাছে পাঠানো হয়। তারা লিউ দাদার বাসায় দেখতে যান। তারা দেখেন, লিউ দাদা অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছেন, তারা দ্রুত তাঁকে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন। গত জুলাই মাস থেকে চেংতু শহরের চিন নিউ এলাকায় একাকী বসবাসকারী প্রবীণদের জন্য এমন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। প্রবীণদের অনুমোদন পেয়ে তাদের বাসায় বিদ্যুৎ ব্যবহার পর্যবেক্ষণ এবং স্মোক ডিটেক্টর স্থাপন করা হয়। তা সব সময় তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে।

এ ক্ষেত্রে আরেকটি উদাহরণ হলো চিন নিউ এলাকার একটি পুরাতন রাস্তা। এর দু’পাশে রয়েছে খাবারের স্ট্রিট এবং ৬০টির বেশি রেস্তোরাঁ। আগে এর বাসিন্দারা রেস্তোরাঁর ধোঁয়া নিয়ে অনেক অভিযোগ করতো। এ সমস্যা সমাধানে কমিউনিটি ৪৯টি রেস্তোরাঁয় তেল ও ধোঁয়া তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা চালু করে। যদি তেল ও ধোঁয়ার পরিমাণ স্ট্যান্ডার্ড ছাড়িয়ে যায়, তাহলে এ ব্যবস্থা সক্রিয়ভাবে সতর্কতা পাঠাবে। স্মার্ট প্ল্যাটফর্ম পুলিশকে ডাকবে। তত্ত্বাবধান চালু হবার পর বাসিন্দাদের অভিযোগ অনেক কমেছে।

আগে কমিউনিটির কর্মীদের প্রতিদিন নানা ফর্ম পূরণ করতে হতো। এখন স্মার্ট প্ল্যাটফর্মের সাহায্যে তাদের কাজ অনেক সহজ হয়েছে। তারা একবার ফর্ম পূরণ করলে সব তথ্য সক্রিয়ভাবে নানা ফর্মে চলে যায়। তাতে কর্মীরা আরও বেশি সময় নিয়ে বাসিন্দাদের সেবা প্রদান করতে পারেন।

কমিউনিটি হল তৃণমূল প্রশাসনের মৌলিক ইউনিট। কমিউনিটির কাজ যদি স্মার্ট ও কার্যকর হয়, তাহলে শহরের পরিচালনা আরও সুষ্ঠুভাবে চলবে।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn