বাংলা

পরিবেশ দুষণে দায়ী কার্বন থেকে সার, কোক, বিয়ার তৈরি? লেখক: ইমরুল কায়েস

CMGPublished: 2022-09-19 14:23:20
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

পৃথিবীর পরিবেশ দুষণ এবং ওজোন স্তর ধ্বংসে সবচেয়ে বেশি দায়ী কার্বণ গ্যাস। এটা আমাদের সবারই জানা। সংক্ষেপে এই গ্যাসকে কার্বণ বা গ্রীন হাউজ গ্যাসও বলা হয়ে থাকে। বিশ্বে শিল্পায়ন যত বেড়েছে কার্বণ নিঃসরনের পরিমাণ তত বেড়েছে। শিল্পোৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল, কয়লাসহ বিভিন্ন ফসিল ফুয়েল ব্যবহারের ফলে বাতাসে কার্বণ নিঃসরণ বাড়ছে। বিশ্বের সর্বোচ্চ কার্বণ নিঃসরণকারী দেশ হলো চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও রাশিয়া। উৎপাদন ও উন্নয়নের গতি ঠিক রেখে কার্বণ নিঃসরনের পরিমাণ কিভাবে কমানো যায় তা নিয়ে চিন্তা ও গবেষণার শেষ নেই বিজ্ঞানীদের। প্রতিবছরই বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে কার্বণ নিঃসরনের মাত্রা কমানো নিয়ে আলোচনা সমালোচনা ব্যাপক মাত্রায় হয়ে থাকে। নি:সৃত কার্বণ তিলে তিলে পৃথিবীর ওজোনস্তরকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ফলে ক্ষতিকর সুর্যরশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে এসে তাপমাত্রা বাড়িয়ে চলেছে। তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে ধীরে ধীরে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে পৃথিবীর নিচু দেশসমূহ অদুর ভবিষ্যতে ডুবিয়ে দেবে বলে বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা। সেকারণে কার্বণ নিঃসরণ কমাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্পকারখানায় কয়লার ব্যবহার বন্ধে বড় বড় দেশগুলো থেকে নানাভাবে প্রতিশ্রুতি আদায় করতে চায় বিশ্ববাসী। যদিও এ ব্যাপারে এখনও ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি প্রভাবশালী দেশগুলো। তবে এককভাবে কিছু কিছু দেশ কার্বণ নিঃসরণের মাত্রা কমাতে নানা পদক্ষেপ নেয়া অব্যাহত রেখেছে। দেশগুলোর মধ্যে চীন অন্যতম।

একসময় চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের পরিবেশ দূষণ ছিল মারাত্মক পর্যায়ের। তবে গত ১০ বছরে চীন সরকারের নেয়া নানা পরিবেশবান্ধব নীতি ও ব্যবস্থার ফলে বেইজিংয়ে এখন পরিবেশ দূষণ নেই বললেই চলে। এসব ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে বেইজিংয়ে দূষণমুক্ত জ্বালানীর যানবাহন চালু, রাজধানীল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক বনায়ন, বেইজিংয়ের পার্শ্ববর্তী হুপেই প্রদেশে কয়লা নির্ভর ইস্পাত ও লোহার কারখানা বন্ধ করা, রান্না ও শিল্পকারখানায় কয়লার ব্যবহার কমানো, সৌর ও বায়ু থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানো ইত্যাদি। বর্তমানে চীন বায়ু থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম। চলতি বছর ২০২২ সালে বেইজিংয়ে সরকার এক লাখ নতুন গাড়ীর নাম্বার প্লেট ইস্যু করেছে। এরমধ্যে ৭০ শতাংশই বরাদ্দ রাখা হয়েছে দূষণমুক্ত জ্বালানি চালিত গাড়ির জন্য। চীনের লক্ষ্য ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বণ নিরপেক্ষ বা জিরো কার্বণ নিঃসরণকারী দেশে পরিণত হওয়া। ২০৩০ সালের মধ্যে শক্তি উৎপাদনের ২৫ শতাংশ ফসিলজাত নয় এমন জ্বালানি থেকে আসবে বলে ঠিক করা হয়েছে। লক্ষ্য অর্জনে নানা ধরনের পরিবেশ বান্ধব নীতির সুফল পেতে শুরু করেছে চীনের বাসিন্দারা।

এখন চীনের লক্ষ্য পরিবেশ দূষণ ও ওজোনস্তর ধ্বংসের জন্য দায়ী ক্ষতিকর কার্বণকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়। ইতোমধ্যে সেই প্রযুক্তিও উদ্ভাবন করে ফেলেছে দেশটি। চীনের হুয়ানেং ক্লিন এনার্জি রিসার্চ ইনস্টিটিউট এই ক্ষেত্রে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছে। ৩১ আগস্ট বেইজিংয়ে অবস্থিত হুয়ানেং ক্লিন এনার্জি রিসার্চ ইনস্টিটিউটে গিয়ে বিষয়টি স্বচক্ষে দেখেছি। প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবিত প্রযুক্তি অভিভূত করার মত। হুয়ানেংয়ের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি বাতাস থেকে কার্বণকে শোষণ করে। এজন্য ব্যবহার করা হয় একটি উচ্চ প্রযুক্তি ক্ষম

তাসম্পন্ন টাওয়ার। এরপর শোষিত কার্বণের বড় অংশ মাটির নিচে সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে মাটির নিচে রক্ষিত কার্বণের সাথে নানা ধরনের কেমিকেল মিশিয়ে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে জ্যুওলজিক্যাল ফরমেশনের জন্য অপেক্ষা করা হয়।

সবচেয়ে অবাক করা ও মজার তথ্য হল শোষিত কার্বণকে শুধু মাটির নিচে জ্যুওলজিক্যাল ফরমেশনের জন্যই রাখা হয় না। বায়ুমন্ডল থেকে শোষিত কার্বণকে অন্যান্য কাজ ও পণ্য তৈরিতেও ব্যবহার করছে হুয়ানেং রিসার্চ ইনস্টিটিউট। এই গবেষণাগারে শোষিত কার্বণকে ব্যবহার করে সার, কোক, বিয়ার উৎপাদন করছে প্রতিষ্ঠানটি। কার্বণের সাথে এমোনিয়া যৌগ মিশিয়ে প্রস্তত করা হচ্ছে সার। এই সার মাটির উর্ববরতা বৃদ্ধিতে খুবই কার্যকরী। আবার কার্বণের সাথে নানা ধরনের কেমিকেল মিশিয়ে কোক এবং বিয়ারও তৈরি হচ্ছে। তবে এখনও কার্বণের এই ইতিবাচক ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হয়নি। হুয়ানেংয়ের কার্বণ শোষণাগারে স্বল্প পরিসরে কার্বণকে এসব পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করা হচ্ছে। শিগগিরই এর বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হবে বলে আশা করছে প্রতিষ্ঠাণটির কর্ণধাররা। কিভাবে কার্বণ থেকে সার, কোক ও বিয়ার তৈরি হচ্ছে তা স্বচক্ষে দেখে যারপর নাই অভিভূত হয়েছি। বিজ্ঞানের কল্যাণে প্রযুক্তির গুণে কোথায় চলে গেছে এরা। অদুর ভবিষ্যতে হয়তো ব্যাপক পরিসরে কার্বণ থেকে এসব পণ্য তৈরি হবে। এক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা থাকবে সামনের সারিতে। তখন কার্বণ নি:সরণ নিয়ে বিশ্বে এমন মাতামাতি বা রেষারেষি হয়তো আর থাকবে না। কার্বণ শোষণের ফলে পরিবেশ দূষন যেমন কমবে তেমনি রক্ষিত হবে ওজোনস্তর। বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে এটা হবে একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

চীনে এবং চীনের বাইরে হুয়ানেংয়ের এ ধরনের বেশ কিছু কার্বণ শোষণাগার রয়েছে। সর্ব প্রথম ২০০৮ সালে বেইজিংয়ে কার্বণ ক্যাপচার সেটআপ বা শোষণাগার স্থাপন করা হয়। এটি বছরে তিন হাজার টন কার্বন বায়ুমন্ডল থেকে শোষণ করতে পারে। এখন পর্যন্ত সাংহাইয়ে স্থাপিত হয়েছে হুয়ানেংয়ের সবচেয়ে বড় কার্বণ শোষণাগার। এটি বছরে এক লাখ ২০ হাজার টন কার্বন শোষণ করতে সক্ষম। চলতি বছরে শেষ হওয়া অস্ট্রেলিয়ায় স্থাপিত হুয়ানেংয়ের কার্বণ শোষণাগার বছরে এক লাখ ১০ হাজার টন কার্বণ শোষণ করতে পারবে। সবচেয়ে বড় কার্বণ শোষণাগারটি তৈরি হচ্ছে চীনের গানসু প্রদেশে। ২০২৩ সালে এর নির্মাণকাজ শেষ হবে। এটি চালু হলে বছরে ১৫ লাখ টন কার্বণ বায়ু মন্ডল থেকে শোষণ করা সম্ভব হবে।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn