বাংলা

গ্রামীণ শিশুদের সঙ্গীত স্বপ্ন

CMGPublished: 2022-06-22 11:16:53
Share
Share this with Close
Messenger Pinterest LinkedIn

চীনের হুনান প্রদেশের সবচেয়ে উত্তরে পাহাড়ের পাদদেশে একটি স্কুল আছে। তার নাম সুয়াং সি পিং মাধ্যমিক স্কুল। স্কুলে ৭০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত একটি অ্যাকর্ডিয়ন ব্যান্ড আছে। তাদের সংগীতের সুন্দর আওয়াজ শান্ত গ্রামে বেজে ওঠে।

২০১৪ সালে এ অ্যাকর্ডিয়ন ব্যান্ড গঠন করেন শিক্ষক কুও ওয়ে সিয়াং। তিনি অনেক শিশুকে সঙ্গীতের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। প্রতিমাসে শিক্ষক কুও একবার আউটডোর ক্লাসরুম অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সুন্দর সঙ্গীত সেখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যের সঙ্গে মিলে গেছে।

কুও ওয়ে সিয়াংয়ের বাড়ি ছাং শা শহরে। সুয়াং সি পিং স্কুলে যেতে দু ঘন্টার গাড়ি যাত্রা দরকার এবং পাহাড় অতিক্রম করতে হয়। আগে তিনি নিজে গাড়ি চালিয়ে আসতেন, তবে একবার একটি দুর্ঘটনা হয়েছে। তখন ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন শিক্ষক কুও, তখন তার খুব ক্লান্তি বোধ হয়। ফলে দু-এক সেকেন্ডের মতো চোখ বন্ধ করেছিলেন। ঠিক সে মুহূর্তে গাড়িটা পাশের রেলিংয়ের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে। শিক্ষক কুওয়ের বয়স ৬৮ বছর। এ দুর্ঘটনার কথা জেনে অনেক চিন্তিত স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। সবাই সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা শিক্ষক কুওকে পিকআপের দায়িত্ব বহন করবে।

কুও ওয়ে সিয়াংয়ের মনে অনেক আগে থেকেই জন্ম নেয় একজন গ্রামীণ শিক্ষক হবার স্বপ্ন। ২০১৪ সালে তিনি হুনান ক্যাবরে থিয়েটার থেকে অবসর নিয়েছেন এবং ছাং শা শহরের পাশে গ্রামীণ স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কাজ করার সুযোগ খুঁজে পেয়েছেন। তখন তিনি সুয়াং সি পিং মাধ্যমিক স্কুলের অধীনে একটি প্রাথমিক স্কুলে একটি অ্যাকর্ডিয়ন ক্লাসের আয়োজন করেন। ওই সময়ে স্কুলে মাত্র ৪টি ক্লাসরুম ছিল এবং খেলার মাঠ কর্দমাক্ত ছিল। নিজের খরচে কুও ওয়ে সিয়াং ২০টি অ্যাকর্ডিয়ন কিনেছেন এবং উপহার হিসেবে ছাত্রছাত্রীদেরকে দিয়েছেন। প্রতি দু-সপ্তাহে একবার তিনি এ স্কুলে এসে ক্লাস নিয়েছেন। অনেক শিশু প্রথম বারের মতো অ্যাকর্ডিয়ন দেখে এবং তারা এই যন্ত্র বাজাতে আগ্রহী হয়। পরে আরও দুটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীরাও শিক্ষক কুওর ক্লাসে যোগ দেয়। মোট ২০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে শিক্ষক কুও’র। বর্তমানে অ্যাকর্ডিয়ন ব্যান্ডে রয়েছে ৭৫ জন সদস্য। তারা অনেক বছরের মতো শিক্ষক কুও’র কাছ থেকে অ্যাকর্ডিয়ন বাজাতে শিখেছে। শুরুতে তারা শীট সঙ্গীত জানতো না, তবে এখন তারা সুন্দরভাবে বাজাতে পারে।

কুও ওয়ে সিয়াং বলেছেন, গেল ৮ বছরে তার জন্য সবচেয়ে কঠিন একটি ব্যাপার হল ছাত্রছাত্রীদের মা-বাবার ভুল বুঝা দূর করা। তাদের প্রশ্ন হল, অ্যাকর্ডিয়ন বাজানো জানা দরকার আছে কি? এটা শিখলে লেখাপড়ার সময় হবে না, কী করা যায়? এমন প্রেক্ষাপটে, কুও ওয়ে সিয়াং শিশুদের বাড়িতে গিয়ে তাদের বাবা-মার সঙ্গে কথা বলেন। গেল দু বছরে তার শিক্ষার্থীদের কয়েকজন পেশা হিসেবে অ্যাকর্ডিয়ন বাজানোকে বাছাই করেছে। চেন ইং ছি তাদের একজন। গত বছর তিনি নান চাং বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকর্ডিয়ন বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। তার মা জানিয়েছেন, শুরুতে তারা মেয়েকে অ্যাকর্ডিয়ন শিখতে বাধা দেন। পরে তিনি দেখেছেন, প্রতিমাসে শিক্ষক কুও স্কুলে এসে শিশুদেরকে শিখিয়ে দেন, তার চিন্তা দূর হয়ে যায় ।কুও ওয়ে সিয়াং বলেছেন, অনেকে স্কুলে কিছু টাকা দিয়েছেন বা কয়েক বার আসার পর আর আসেন না। তা টেকসই নয়। আমি এ কাজ স্থায়ীভাবে করতে চাই। গত বছর চেন ইং ছি ছাড়া আরও দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকর্ডিয়ন বিভাগে ভর্তি হয়েছে। এ দেখে কুও ওয়ে সিয়াং খুব আনন্দিত । তিনি বলেছেন, আমার ছাত্রছাত্রীরা পেশাদার শিল্পী বা বিশেষজ্ঞ হোক, তা আমি চাই না। আমি চাই, তাদের আস্থা বৃদ্ধি পাক এবং তারা মর্যাদাবান হোক।

সুয়াং সি পিং মাধ্যমিক স্কুলের ৬০ শতাংশের ছাত্রছাত্রী বাবা-মায়ের কাছে থাকে না। তাদের বাবা-মা গ্রাম ছেড়ে শহরে কাজ করেন। গত ৮ বছরে কুও ওয়ে সিয়াংয়ের সাহায্যে শতাধিক শিশু পাহাড়ের বাইরে গিয়েছে। তারা বড় মঞ্চে অ্যাকর্ডিয়ন বাজিয়েছে এবং নানা পুরস্কার পেয়েছে। পাশাপাশি, শিশুরা আস্থা ও আনন্দ পেয়েছে।

তবে, বয়সের কারণে কুও ওয়ে সিয়াংয়ের শারীরিক অবস্থা ভাল না। তিনি কত দিন পর্যন্ত এ কাজ করতে পারবেন এবং শিশুদের সঙ্গীত স্বপ্ন কীভাবে পূরণ হবে, তা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। কুও ওয়ে সিয়াও বলেন, যত দিন তিনি যেতে পারবেন, তত দিন পর্যন্ত শিক্ষক হিসেবে কাজ করবেন। পাশাপাশি, তিনি এ কাজ কার হাতে দিয়ে যাবেন, তা নিয়ে তিনি চিন্তা করছেন। তার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কেউ এ দায়িত্ব বহন করতে পারবে কি না? বা তার বন্ধু ও অন্য অ্যাকর্ডিয়ন অনুরাগীরা পারবেন কি না? তাও তিনি ভাবছেন। বর্তমানে সুয়াং সি পিং স্কুলের ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী একটি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারে এবং তারাও আশা করে, এটা স্কুলের একটি ঐহিত্যে পরিণত হতে পারে। সুয়াং সি পিং স্কুলের সংগীত শিক্ষক ইয়ান খেই ওয়েন বলেছেন, শিশুদের সংগীত প্রতিভা দেখে আমি বিশ্বাস করি, গ্রামের শিশুরাও সঙ্গীত উপভোগ করে। আমি এ স্কুলে থাকব এবং তাদের বাদ্যযন্ত্র শিখিয়ে দেব।

শিক্ষ কুওয়ের অবস্থা শুনে অনেক ছাত্রছাত্রী তাকে নিয়ে চিন্তিত। একদিন ক্লাস শেষে শিক্ষক কুও অনেক চিঠি পেয়েছেন। সংগীত শিশুদের জন্য উপকারী এটি সবাই জানে। শিক্ষক কুওয়ের কাজের সবচেয়ে কঠিন বিষয় দীর্ঘ পথ বা নিম্ন বেতন নয়, বরং শিশুদেরকে সংগীত শিক্ষা গ্রহণ করাতে তাদের বাবা-মাকে রাজি করানো। এখন শিশুদের লেখাপড়া ভাল হয়েছে। পাশাপাশি, তারা ভাল বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারে। তা দেখে তাদের পরিবারও শিক্ষক কুওয়ের কাজের স্বীকৃতি দিয়েছেন। এ গ্রামে সবসময় শোনা যায় সুন্দর সুর।

কুও ওয়ে সিয়াং বার বার জেদ ধরার কথা উল্লেখ করেন। কাজে জেদ ধরার কারণে শিশুরা বড় মঞ্চে উঠতে পারেন এবং গ্রামের ভবিষ্যতে দেখা যায় আরও সম্ভাবনা। তিনিও ভাবেন ভবিষ্যতে তার বদলে কেউ কি এ কাজে অবিচল থাকতে পারবে। আশা করি, আরও বেশি মানুষ শিক্ষক কুওয়ের গল্প দেখে তার মতো এ কাজ করতে পারবে এবং এ সুন্দর সুর চিরকাল এ গ্রামে বাজতে থাকবে।

Share this story on

Messenger Pinterest LinkedIn