আকাশ ছুঁতে চাই ৫৮
১. ছোট শহর থেকে অসীম আকাশে
২. হানফু ভাগ্য বদলে দিলো পুরো গ্রামের
৩. একজন উদ্যোক্তা ফুলের মতো বিকশিত হন
নারী ও শিশু বিষয়ক অনুষ্ঠান আকাশ ছুঁতে চাই থেকে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। আমাদের অনুষ্ঠানে আমরা কথা বলি নারী ও শিশুর অগ্রযাত্রা, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, সাফল্য, সংকট সম্ভাবনা নিয়ে। আমরা কথা বলি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের অধিকার নিয়ে।
ছোট শহর থেকে অসীম আকাশে
জীবনে চলার পথ সব সময় মসৃণ নয়। জীবনের কঠিন অধ্যায় মাড়িয়ে, বন্ধুর পথে ভেবেচিন্তে পা ফেলতে হয়। সময় সুযোগমতো নিজের সেরাটাও ঢেলে দিতে হয়।
পাশাপাশি জীবনে অনেক ত্যাগ স্বীকারও করতে হয়। কষ্ট ও সাধনা ছাড়া কখনো সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানো যায় না। পুরুষদের পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বে সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস, অদম্য ইচ্ছাই এর মূল চালিকা শক্তি। তেমনি এক অদম্য চীনা নারী প্যান হংলিন। চীনের ছোট এক শহর থেকে হয়েছে ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট হয়েছেন তিনি। প্রতিবেদনে থাকছে বিস্তারিত..
চীনের ছংছিয়ের হেছুয়ান জেলার ছোট এক শহরের জন্ম প্যান হংলিনের। বাড়ির একেবারে খুব কাছে রানওয়ে থাকায় শৈশব-কৈশোর থেকেই উড়োজাহাজের সঙ্গে পরিচয়। অবাক দৃষ্টি উড়োজাহাজের উঠা-নামা দেখতেন প্যান। আর এখান থেকেই মনের মধ্যে বুনতে থাকেন স্বপ্ন, একদিন এই উড়োজাহাজে করেই দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াবেন।
পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের অপছন্দের কারণে মনের মধ্যে লালিত সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। স্নাতক হওয়ার পর দীর্ঘ চার বছর ধরে একটি হাসপাতালে নার্স হিসেবে কাজ করেন এই নারী।
তবুও, তিনি তার শৈশবের স্বপ্ন ভুলে যাননি। স্বপ্ন পূরণের জন্য তিনি টেলিভিশন এবং সংবাদপত্র থেকে ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। সকল বাধা অতিক্রম করে মাত্র ২৪ বছর বয়সে কয়েক ধাপ পরীক্ষার পর তিনি ছংছিং ভিত্তিক একটি এয়ারলাইন ‘ওয়েস্ট এয়ারে’ ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে যোগ দেন।
চাকরীর শুরুর দিকে তাকে পড়তে হয়েছিল নানামুখী চ্যালেঞ্জে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে এতো উচ্চতায় কর্ম ক্ষেত্র হওয়ায় মানিয়ে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন মনে হয়েছিল। পাশাপাশি দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকাটাও ছিল বেশ কষ্টের। সঙ্গে ছিল ‘ওড়ার ভয়’।
বর্তমানে প্যান হংলিন পা রেখেছেন ৩০ এর কোঠায়। চলতি বছর বসন্ত উৎসবকে কেন্দ্র করে চীনে বেড়েছে ফ্লাইট সংখ্যা। সঙ্গে বেড়েছে হংলিনের ব্যস্ততাও।
পাশাপাশি তিনি কেবিন ক্রু প্রধান এবং ওয়েস্ট এয়ারের কেবিন বিভাগে চিকিৎসা প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করছেন।
প্যান জানান, পেশাদার ভূমিকা যতই পরিবর্তিত হোক না কেন, জনসাধারণের সেবা করার বিষয়ে তার মানসিকতার কোনও পরিবর্তন হবে না। যতদিন সম্ভব হবে যাত্রীদের আরও ভাল পরিষেবা দিতে প্রস্তুত তিনি।
হাসপাতালে নার্স হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতার কারণে তিনি জরুরী পরিস্থিতিতে উড়োজাহাজের যাত্রীদেরও সাহায্য করে থাকেন। প্যানের সহকর্মীরা বলছেন যে তার সঙ্গে উড়োজাহাজে ভ্রমণ করা নিরাপদ ও আস্থার।
প্রতিবেদন ও কণ্ঠ: শুভ আনোয়ার
সম্পাদনা: শান্তা মারিয়া
হানফু ভাগ্য বদলে দিলো পুরো গ্রামের
চীনে এখন চলছে ঐতিহ্যবাহী পোশাকের ট্রেন্ড। লোকজ ঐতিহ্যের প্রতি বাড়ছে আগ্রহ। এই আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে অনেক নারী নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন। এমনি একজন নারী ওয়াং রান। তিনি হানফু ডিজাইনার। শুনবো তার গল্প।
ওয়াং রান একজন ফ্যাশন ডিজাইনার। বিশেষ করে হানফু এবং ঐতিহ্যবাহী মামিয়ানছুন বা ঘোড়ার মুখের মতো স্কার্ট তৈরিতে তিনি দক্ষ। ওয়াং রানের জন্ম শানতোং প্রদেশে। চীনের শানতোং প্রদেশের ছাওসিয়ান কাউন্টি আগে ছিল দারিদ্র্যপীড়িত। কিন্তু এখন এটি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় পারফর্মিং কস্টিউম উৎপাদনকারী কাউন্টি। অবিশ্বাস্য গতিতে এগিয়ে চলছে এখানকার হানফু শিল্প।
এই কাউন্টির জনসংখ্যা ১.৩ মিলিয়ন। এটি শানতোং এর সবচেয়ে জনবহুল কাউন্টি। এখান থেকে অনেক শ্রমিক কাজের সন্ধানে চীনের বড় শহরগুলোতে চলে গেছেন। ১৫ বছর আগে কয়েকজন গ্রামবাসী চিন্তা করেন যে হানফু তৈরি করবেন। ফটো স্টুডিও এবং মঞ্চে পরিবেশনার জন্য এ ধরনের কস্টিউম হানফু তৈরির উদ্যোগ নেন তারা। চীনের ই-কমার্স ব্যবসা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে অবস্থার পরিবর্তন হয়। ২০০৯ সালে এই হানফু প্রস্তুতকারকরা অনলাইন দোকান খোলেন এবং দেখেন যে তাদের পোশাক বেশ ভালো বিক্রি হচ্ছে।
পরবর্তি বছরগুলোতে আরও গ্রামবাসী হানফু ব্যবসায় যোগ দেন। উৎপাদন অথবা অনলাইনে বিক্রির কাজে যোগ দেন তারা। বর্তমানে সারাদেশে হানফু বিক্রির ৪০ শতাংশই উৎপাদিত হয় ছাওসিয়ানে। ২০২৩ সালে এই কাউন্টির হানফু বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ বিলিয়ন ইউয়ান বা ৯৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
ওয়াং রানের জন্ম ২০০০ সালের পরে। তিনি গত কয়েক বছরে ছাওসিয়ানে উৎপাদন চেইনের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ দেখেছেন। গ্র্যাজুয়েশনের পর তিনি হোমটাউনে ফিরে এসে হানফু ডিজাইনের কাজ শুরু করেন।
ওয়াং রান বলেন , ‘এখন উন্নতির এই পর্যায়ে ছাও কাউন্টির কর্মীরা চেষ্টা করছেন ঐতিহ্যবাহী চীনা সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেয়ার এবং আরও বেশি ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক উপাদানকে সংযুক্ত করার। আমি আমার হোমটাউনের উন্নয়নে অবদান রাখতে চাই। বিশেষ করে মামিয়ানছুনের নকশা উন্নয়নে কাজ করছি।’
ঐতিহ্যকে ব্যবহার করে নিজের এলাকার উন্নয়নে যেমন তিনি অবদান রাখছেন তেমনি নিজের ক্যারিয়ারেও উন্নতি করছেন।
প্রতিবেদন ও কণ্ঠ : শান্তা মারিয়া
একজন উদ্যোক্তা ফুলের মতো বিকশিত হন
চীনে অনেক নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন যারা নিজের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকে বিকশিত করছেন। এমনি একজন নারী উদ্যোক্তা হলেন ছিয়ান চিং। তিনি লুসি কিউ জুয়েলারি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। শুনবো তার গল্প।
চীনের নারী উদ্যোক্তা ছিয়ান চিং কখনও ভাবেননি তিনি অলংকারের ডিজাইনার হবেন এবং অলংকার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের মালিক হবেন। এই কাহিনী যেমন বিস্ময়কর তেমনি অনুপ্রেরণা মূলক।
১৯৯০ এর দশকে চীনের রেনমিন ইউনিভারসিটি থেকে ইংরেজি ভাষা বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেন ছিয়ান। এরপর বিভিন্ন বড় বড় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। বেশ উন্নতিও করেন। সেসময় চীনে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী সারাহ রান্ডের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় তার। তিনি দেখেন যে সারাহ বেশ চমৎকার চীনা ঐতিহ্যবাহী অলংকার পরেন। বিশেষ করে তার মুক্তার অলংকারগুলো খুবই সুন্দর। তিনি জানতে পারেন সারাহ চীনা ডিজাইনের অলংকার পছন্দ করেন। তার মুক্তাগুলোও চীনের।
ছিয়ান চিং জানতে পারেন যে চীনে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মিঠাপানির মুক্তা উৎপন্ন হয়। তিনি আরও জানেন যে চীনের মুক্তা সৌন্দর্য ও আকারে অনন্য।
তিনি ২০১৬ সালে নিজের কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রতিষ্ঠানের নাম লুসি কিউ জুয়েলারি। তার ইংরেজি নাম লুসি। তাই নিজের নামেই এই প্রতিষ্ঠান শুরু করেন তিনি। আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ছিয়ানের কোম্পানির একটি বৈশিষ্ট্য হলো তিনি ক্রেতার চাহিদা মতো ডিজাইনে গহনা বানিয়ে দেন। এর ফলে তার প্রতিটি অলংকারই অনন্য। তার গ্রাহকরা পছন্দসই পণ্যের সঙ্গে আরও অনেক কিছু উপহারও পান। ছিয়ান মনে করেন একজন উদ্যোক্তা ফুলের মতো বিকশিত হন। তাকে অনেকে সূর্যমুখী ফুলের মতো মনে করেন। কারণ তিনি সূর্যের দিকে বা সাফল্যের দিকে তাকিয়ে আছেন।
ছিয়ান মনে করেন জীবনে কখনও হতাশ হতে নেই বা থেমে যেতে নেই। যে কোন বয়সেই নতুনভাবে শুরু করা যায় এবং অদম্য মনোবল নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়। তিনি বলেন নারীর জীবন সবসময়েই সুন্দর। একজন নারী বিশ বছরেও সুন্দর, চল্লিশ বছরেও এমনকি ষাট ও সত্তর বছরেও যদি তিনি সঠিক সাজসজ্জা বেছে নিতে পারেন।
প্রতিবেদন: শান্তা মারিয়া
সম্পাদনা: রহমান
কণ্ঠ: আফরিন মিম
সুপ্রিয় শ্রোতা আকাশ ছুঁতে চাই অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছি আমরা।
অনুষ্ঠানটি কেমন লাগছে সে বিষয়ে জানাতে পারেন আমাদের কাছে। আপনাদের যে কোন পরামর্শ, মতামত সাদরে গৃহীত হবে। আসন্ন লণ্ঠন উৎসবের শুভকামনা জানিয়ে আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। আবার কথা হবে আগামি সপ্তাহে। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
সার্বিক সম্পাদনা : ইয়ু কুয়াং ইউয়ে আনন্দী
লেখা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: শান্তা মারিয়া
অডিও সম্পাদনা: রফিক বিপুল