চলতি বাণিজ্যের ৪৮তম পর্ব
চলতি বাণিজ্যের ৪৮তম পর্বে থাকছে:
১. চীন-ভিয়েতনাম দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নতুন পর্যায়ে উন্নীত করার প্রত্যয়
২. প্রযুক্তিগত কার্যক্রম বাড়াতে চীনে আরও বিনিয়োগ করছে মার্কিন সংস্থা জিই হেলথকেয়ার
৩. চীন-মালয়েশিয়ায় ভিসামুক্ত সুবিধা চালু, বিপুল সংখ্যক পর্যটক বিনিময়ের সম্ভাবনা
চীন-ভিয়েতনাম দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নতুন পর্যায়ে উন্নীত করার প্রত্যয়
সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: চীন-ভিয়েতনাম দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন পর্যায়ে উন্নীত করার ব্যাপারে জোর দিয়েছেন চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং। রাষ্ট্রীয় সফরে ভিয়েতনাম গিয়ে দেশটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে সি চিনপিং এ কথা বলেন। দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে সি চিনপিং বলেন, এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশ ও আসিয়ানের সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে এই অঞ্চলে কৌশলগত ভূমিকা পালন করছে ভিয়েতনাম। এর আগে ভিয়েতনাম পৌঁছালে চীনা প্রেসিডেন্টকে গার্ড অব অনার দেয় দেশটির সামরিক বাহিনীর চৌকশ দল।
ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নুয়েন ফু ট্রং এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট ভো ফান থুওং-এর আমন্ত্রণে বুধবার দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে সস্ত্রীক ভিয়েতনাম পৌছান চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং। এয়ার চায়নার বিশেষ বিমান পৌছালে প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংকে স্বাগত জানান ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী ফাম মিন চিন।
এ সময় বিমানবন্দরে চীন ও ভিয়েতনামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার প্রায় ৪শ’ প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
এরপর জাকযমকপূর্ণ মোটর শোভাযাত্রার মাধ্যমে রাজধানী হ্যানয়ের প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে পৌঁছান চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও তার স্ত্রী ফং লি ইউয়ান। এ সময় তাকে স্বাগত জানান ভিয়েতনামের ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতা নুয়েন ফু ট্রং ও তার স্ত্রী।
সামরিক বাহিনীর সদস্যরা গার্ড অব অনার প্রদান করে।
চীনা প্রেসিডেন্টের ভিয়েতনাম সফরে দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়ন, কৌশলগত সহযোগিতা আরও টেকসই ও গভীর করার ব্যাপারে নানা বিষয় নিয়ে আলাপ করেন তারা। বিশেষ করে আলাদা বৈঠক হয় ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। এ সময় সি বলেন, চীন ও ভিয়েতনামের মৈত্রী দীর্ঘকালের।
সি চিনপিং, চীনা প্রেসিডেন্ট
“ছয় বছর পর আমি আবারও ভিয়েতনাম সফরে এলাম। প্রতিবারই এখানে এসে আমি নতুন হ্যানয় সিটিকে আবিষ্কার করি। এ সময়ের মধ্যে ভিয়েতনামের উন্নয়ন কাজের অগ্রগতি ও পরিবর্তন দেখে আমি সত্যিই আনন্দিত। আমি ও সাধারণ সম্পাদক ট্রং বেশ কিছু সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর প্রত্যক্ষ করেছি। এসব চুক্তি চীন ও ভিয়েতনামের মধ্যকার গুরত্বপূর্ণ সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। আমি আশা করি নতুন যুগে দু’দেশের সম্পর্কের নতুন অধ্যায় সৃষ্টি হবে। এতে, দু’দেশের জনগণের জন্য আরও বেশি কল্যাণ বয়ে আনা যাবে এবং এই অঞ্চল ও বিশ্বের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে আরও সক্রিয় অবদান রাখা যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।“
ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী জানান, এক চীন নীতি মেনে চলার ব্যাপারে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এ সময় দুই দেশের সহযোগিতা আরও বাড়ানোর অঙ্গীকার করেন তিনি
ফাম মিন চিন, প্রধানমন্ত্রী, ভিয়েতনাম
“আপনার এই ঐতিহাসিক সস্ত্রীক ভিয়েতনাম সফর আমাদের দল ও সাধারণ মানুষের জন্য বহুল আকাঙ্ক্ষিত। ভিয়েতনাম কঠোরভাবে এক চীন নীতি মেনে চলে এবং চীনের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নকে আমরা সমর্থন করি এবং এটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি বড় দেশ হিসেবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং শান্তি, উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতার জন্য যে বৈশ্বিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তাকে আমরা দৃঢ়ভাবে সমর্থন করি। এই উদ্যোগের উপর ভিত্তি করে ভিয়েতনাম সরকার সক্রিয়ভাবে চীনা স্টেট কাউন্সিলের সঙ্গে সহযোগিতা করে যাবে এবং দুই দেশের ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যকার সমঝোতা অনুযায়ী নেওয়া সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে।“
সফর শেষ করে বিদায় বেলায় চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান ভিয়েতনামের সাধারণ মানুষ ও প্রবাসী চীনারা। বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে রাস্তার দু’পাশে জড়ো হয়ে, চীন ও ভিয়েতনামের জাতীয় পতাকা নেড়ে, প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে উষ্ণভাবে বিদায় জানায়।
বিমানবন্দরে এগিয়ে দেন ভিয়েতনামের সংসদের চেয়ারম্যানসহ দেশটির নেতৃবৃন্দ।
কোম্পানি প্রোফাইল:
প্রযুক্তিগত কার্যক্রম বাড়াতে চীনে আরও বিনিয়োগ করছে মার্কিন সংস্থা জিই হেলথকেয়ার
সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: চীনা বাজারে প্রবেশ করতে উদগ্রীব মার্কিন স্বাস্থ্যসেবাদানকারী কোম্পানি জিই হেলথকেয়ার। বিশেষ করে চীনের বাজারের বিপুল সম্ভাবনা, উদ্ভাবন ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যাপারে চীনাদের আগ্রহ এখানে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করছে এই মার্কিন প্রতিষ্ঠানটিকে। কোম্পানিটির কর্মকর্তারা বলছেন, চীনা গ্রাহকদের রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী সর্বোচ্চ মানের সেবা নিশ্চিত করা প্রতিশ্রুতিকে সামনে রেখেই কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তারা।
চীনে সদ্য শেষ হওয়া সাপ্লাই চেইন এক্সপোতে অন্য বহু প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানির মতো অংশ নেয় মার্কিন স্বাস্থ্যসেবাদানকারী কোম্পানি জিই হেলথকেয়ার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কোম্পানিগুলোকে চীনে বিনিয়োগে উৎসাহি দিতেই আয়োজন করা হয় এ মেলার। তাইতো এই প্রদর্শনীর স্লোগান ঠিক করা হয় ‘কানেক্টিং দ্য ওয়ালর্ড ফর এ শেয়ারড ফিউচার’ বা অভিন্ন ভবিষ্যতের জন্য বিশ্বকে সংযুক্ত করা।
এ প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে চোখ খুলে যায় মার্কিন কোম্পানি জিই হেলথকেয়ারের। বেইজিংয়ের এই প্রদর্শনীতে তারা বহুমূখী সম্ভাবনার খোঁজ পায়। চীনা গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কোম্পানিটির প্রধান বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন ও সেবা বিভাগের কর্মকর্তা কেনেথ স্টেচারর্সস্কি জানান, চীনা বাজারের একেবারে গভীরে প্রবেশ করে গ্রাহকদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করতে চান তারা।
কেনেথ স্টেচারর্সস্কি, বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন ও সেবা বিভাগের কর্মকর্তা, জিই হেলথকেয়ার
“চীনে আমাদের যে প্ল্যান্টটি আছে তা সারা বিশ্বের সবচেয়ে বড়। এমনকি আমরা সারা বিশ্বের সব দেশে চীন থেকেই মালামাল সরবরাহ করি। কাজেই আমরা কেবল শ্রমিকের কারণে নয় বরং সরবরাহ সেবার কারণেই এখানে বেশি বিনিয়োগ করি। যদিও ১৯৯০ সালে যখন প্রথম বিনিয়োগ করা হয় তার প্রধান কারণ ছিলো পর্যাপ্ত শ্রমিক পাওয়ার সুবিধা। তবে এখানে বর্তমানে জিই হেলথকেয়ারের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি প্ল্যান্টটি রয়েছে, আর আমরা চীনে আরো বেশি বিনিয়োগ করে যাবো। এই বিনিয়োগ আমাদের কোম্পানিকে আরও বেশি বড় করা ও প্রযুক্তি নির্ভর করার জন্য সহায়ক হবে।“
কোম্পানিটি বলছে, অংশীদারি ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে কেবল চীনেই তাদের ১ হাজারের বেশি সরবরাহকারী আছে।
ভিনদেশে চীন:
চীন-মালয়েশিয়ায় ভিসামুক্ত সুবিধা চালু, বিপুল সংখ্যক পর্যটক বিনিময়ের সম্ভাবনা
সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: নাগরিকদের জন্য ভিসামুক্ত সুবিধা নিশ্চিত করেছে চীন ও মালয়েশিয়া। ফলে ভিসা ছাড়াই চীন ও মালয়েশিয়া সফরের সুযাগ পাচ্ছে দুই দেশের নাগরিকরাই। এরইমধ্যে এই ভিসামুক্ত সুবিধার আওতায় চীনা পর্যটকদের স্বাগত জানাতে শুরু করেছে মালয়েশিয়া।
মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর কুয়ালা লামপুর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। এটাই আবার মালয়েশিয়ার সবচেয়ে উন্নত ও ব্যস্ততম বিমানবন্দর। সম্প্রতি এখানে দেখা মিলছে চীনা পর্যটকদের ভিড়। চীন-মালয়েশিয়া ভিসামুক্ত সুবিধার আওতায় মালয়েশিয়া ঘুরতে আসছেন চীনা পর্যটকরা। কেবল তাই নয়, ভিসুমুক্ত সুবিধা দেওয়ায় মালয়েশিয়া সফরের হিড়িক পড়েছে চীনা পর্যটকদের মধ্যে।
নতুন এই ভিসামুক্ত সুবিধা কার্যকর হওয়ার পর থেকে শীত মৌসুমের শুরুতেই এমন পর্যটক ঢল প্রত্যক্ষ করতে শুরু করে মালয়েশিয়া। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে মালয়েশিয়া সফরের সুযোগ নিচ্ছেন। এমনই একজন চীনা শিক্ষার্থী জানান, তিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফেরার পথে মালয়েশিয়ায় ট্রানজিট নিয়েছেন এবং ভিসা মুক্ত প্রবেশের সুবিধা কাজে লাগিয়ে কয়েকদিন দেশটি ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
চীনা শিক্ষার্থী
“ভিসামুক্ত প্রবেশ নীতির ফলে আমি মালয়েশিয়ার সিটি সেন্টার ও অন্যান্য স্থাপনা ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছি।“
এই নীতি অনুমোদনের পর মালয়েশিয়া প্রাথমিকভাবে চীনা নাগরিকদের জন্য ৩০ দিনের ভিসামুক্ত প্রবেশ সুবিধা কার্যকর করেছে। মালয়েশিয়ায় এই সুবিধা কার্যকর হয়েছে চলতি ১ ডিসেম্বর থেকে। চীনা পর্যটকদের আরও বেশি সুবিধা দিতে মালয়েশিয়ার ট্যুরিজম বোর্ড নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশেষ করে বিমানবন্দরে ১৪টি নতুন ইমিগ্রেশন কাউন্টার খুলেছে তারা।
আম্মার আব্দুল গফার, মহাপরিচালক, মালয়েশিয়া ট্যুরিজম প্রমোশন বোর্ড
“চীনা পর্যটকদের জন্য আমরা এই সুবিধা তৈরি করেছি আবার একই সুবিধা আমরাও নিচ্ছি। কারণ মালয়েশিয়া অবস্থান করার জন্য এটা একটা বেশ ভালো সুবিধা। আমাদের বিশ্বাস তারা তাদের পরিবার, বন্ধুসহ আমাদের এখানে বেড়াতে আসবে এবং মালয়েশিয়ার নানা পর্যটন স্থাপনা ঘুরে দেখবে।“
এদিকে, চীনা নাগরিকদের দেওয়া এমন সুযোগে কেবল মালয়েশিয়ার বিমান পরিবহন শিল্পের মুনাফাই বাড়েনি, বরং মালয়েশিয়ার হোটেল ও পর্যটন শিল্পে রীতিমত চাঙ্গাভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
নিং ছিউ ইউং, ব্যবস্থাপক, অলিভ ট্রি হোটেল পেনাং
“মালয়েশিয়ার ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশন খুবই খুশি এবং এই ভিসামুক্ত সুবিধাটির ব্যাপারে দারুণ উৎসাহ নিয়ে কাজ করছি। আমরা আশা করি এই পুরো মৌসুমে বিপুল সংখ্যক চীনা পর্যটক আসবে।“
উভয় দেশের অর্থনীতি ও পর্যটন শিল্পের জন্যই চীন-মালয়েশিয়া ভিসামুক্ত প্রবেশ সুবিধা কাজে লাগবে বলে মনে করেন মালয়েশিয়ার উপ-বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী। তিনি জানান, দুই দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেবে উভয় দেশের মধ্যকার এই পর্যটন বিনিময়।
লিউ ছিন তোং, উপ-বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী
“ভিসামুক্ত নীতি কেবল দুই দেশের পর্যটক বিনিময় নয়। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বার্তাও দেওয়া যে এই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়ার উপর চীন আস্থা রাখতে পারে এবং মালয়েশিয়ান পর্যটকদেরও তারা আস্থায় নিতে পারে। আবার মালয়েশিয়ার জন্যও চীনা পর্যটকদের উপর বিশ্বাসের চিহ্ন এই ভিসামুক্ত সুবিধা। আমরা আশা করি এই সম্পর্ক আরও বহুদূর ও নানা ক্ষেত্র পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে।“
কেবল মালয়েশিয়া নয়, ইউরোপের দেশ ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও স্পেনের নাগরিকরাও পাবেন চীনে ভিসামুক্ত প্রবেশের সুযোগ। ভিসা ছাড়াই পর্যটন, ব্যবসা এবং আত্মীয় কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে মালয়েশিয়াসহ এসব দেশের নাগরিকরা ১৫ দিন পর্যন্ত অবস্থান করতে পারবেন চীনে।